পদাবলিপ্রচ্ছদ

একগুচ্ছ কবিতা- মাহমুদা আক্তার

খুব জানতে ইচ্ছে করে

এখনো কি তোমার শহরে বৃষ্টি নামে?
আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেঁয়ে যায়?
দমকা হাওয়ায় গাছের পাতা ঝড়ে পড়ে?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আচ্ছা! টিনের চালে শব্দ করে বৃষ্টি হয়?
শব্দটা আমার খুব পছন্দের।
বৃষ্টির পানিতে শিউলি ফুল ভেসে আসে?
মনে আছে তোমার?
তুমুল বৃষ্টিতে যখন
শিউলি ফুল ভেসে আসতো,
তুমি আমার জন্য তুলে রাখতে।
এখনো কি আমার জন্য শিউলি ফুল তুলে রাখো?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বৃষ্টি এলে তুমি তোমার কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান তুলতে
আমি অপলক নয়নে তোমায় দেখতাম
আর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তোমার গান শুনতাম,
সাথে থাকতো তোমার প্রিয় চিড়ে ভাজা আর লেবু চা।
আচ্ছা! আজও কি বৃষ্টি এলে আগেকার দিনের মতো
তুমি রবীন্দ্রনাথের গান আর চিড়ে ভাজা নিয়ে বসো?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বিকেলে শরৎচন্দ্র পড়ার কালে
চায়ের কাপে আমার কথা মনে পড়ে?
আমার রেখে আসা একপাড়ের শাড়ি
আর আলতার বাটি এখনো কি আছে?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।
সাঁঝের বেলায় যখন সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতাম
তুমি শিউলি ফুলের মালা নিয়ে আসতে,
আমি খুব যত্ন করে সেই মালাকে
আমার আয়নার কোণে ঝুলিয়ে রাখতাম।
আচ্ছা! শুকনো শিউলি ফুলের মালা এখনো আছে?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।
মনে আছে তোমার?
আমি যেদিন মারা গেলাম
শিউলি ফুলের রঙের শাড়ি পড়া ছিলো।
শিউলি ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে ছিলো সারা ঘরজুড়ে
হয়তো সেদিন আমার শেষ দিন ছিলো বলেই।
আচ্ছা! আজও কি শিউলি ফুলের ঘ্রাণ আছে?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আজ আমার শহরে বৃষ্টি নেমেছে, তুমুল বৃষ্টি
যেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো,
সবকিছু জলে টইটুম্বুর
শিউলি ফুল ভেসে আসছে।
আজ আমি খুশিতে আত্মহারা।
আমার হাসি, কাঁচের চুড়ি আর নুপুরের শব্দ
তোমার খুব প্রিয় ছিলো।
আচ্ছা! আজও কি তোমার মনে পড়ে আমার কথা?
আমার না! খুব জানতে ইচ্ছে করে।

কেউ একজন থাকুক

মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ একজন থাকুক শেষ বিকেলের গল্প হয়ে।
সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে নীড়ে ফেরার পর
দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলাতে বুলাতে গল্প হবে
সাথে থাকবে ধোঁয়া তোলা এক কাপ চা।
মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ একজন থাকুক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা হয়ে।
টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে
আর আমি সর্ষে তেলে চাল-ডাল মেখে
মৃদু আঁচে চুলোয় তার প্রিয় খিচুড়ি বসাবো।
মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ একজন থাকুক শীতের সকালে।
কুয়াশাচ্ছন্ন পথে হাঁটার সময় যখন আমার শীত করবে
সে এসে তার চাদরটায় আমায় মুড়িয়ে নেবে।
মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ একজন থাকুক আমার বারান্দাটায় ।
আমি যখন গুনগুন করে গান গাইবো
তখন সে নিরব হেসে আমায় আঁড়চোখে দেখবে।
মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ একজন থাকুক
যে বকুলের মালা নিয়ে আসবে প্রতিদিন
যাতে আমি আমার খোপায় বাঁধতে পারি।
মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ একজন থাকুক
যে আমার প্রিয় শখগুলোর যত্ন নেবে।
যা আমি বহু বছর ধরেই
নিজের মাঝে ধারণ করে এসেছি।
কেউ একজন থাকুক….

ঠাঁই

মাঝে মাঝে খুব অবাক হই এটি ভেবে
তোমরা যে মেয়েটিকে অকর্মা বলতে
সে আজ সর্বেসর্বা।
ঠিকভাবে শাড়ি পড়তে পারে না,
হাঁটতে পারে না বলতে
সেই মেয়েটা এখন এলাকার
সবচেয়ে বড় শাড়ির দোকান’টার মালিক।
আজ সে হাজারো রমনীর জন্য
জামদানী, বেনারসি শাড়ির যোগানদার।
ঠিকমতো চুল বাঁধতে পারে না
বলতে যে মেয়েটাকে!
সে পাড়ার সবচেয়ে প্রিয় বিউটি পার্লার চালায়।
বউ, ঝিয়েরা সাজার জন্য
তার দুয়ারে ধর্ণা ধরে,
সারি করে বসে থাকে অপেক্ষায়।
কখন আগের জনের সাজ শেষ হবে?
যে মেয়েটিকে রান্না ভালো নয়,
নুন-মরিচের বালাই নেই বলতে
সেই মেয়েটা আজ
বিশাল ভাতঘরের মালিক
যেখানে খাবার খাওয়ার জন্যে
লোক জড়ো হয়ে থাকে।
ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না
এই বলে যাকে গালমন্দ করতে
সে আজ হাজারো মানুষের সামনে বক্তব্য রাখে।
তার জোড়ালো কন্ঠে মাতিয়ে তোলে
সামনে বসে থাকা জনসমুদ্র’কে।
নিমিষেই তার গানের গলায় কিংবা আবৃত্তির ছন্দে
বিমোহিত করে দেয় শত সহস্র শ্রোতাদের।
ভুলে যাও কেন তোমরা?
সবাই’কে বলছি না
শুধুমাত্র তোমরা যারা কটাক্ষ করে
কথা বলো তাদেরকেই বলছি।
তোমার জন্ম হয়েছে নারীর গর্ভে
তোমার সন্তানের ক্ষেত্রেও তাই।
নারীকে শুধু ঘরে নয়
মনের ঘরেও সম্মানের ঠাঁই’টা দিও,
সম্মান দিতে অর্থ কড়ির হিসেব কষতে হয় না
মনোভাবটা আর অন্তর্দৃষ্টি’টাই যথেষ্ঠ।

রূপান্তর 

 আমি আমার পথ’কে বদলে দিয়েছি
বদলে দিয়েছি গন্তব্যস্থল।
আমি অচেনা’কে করেছি চেনা
পর’কে করেছি আপন
পুরাতন’কে করেছি নতুন।
আমি নিকট’কে করেছি দূর
আর দূর’কে করেছি অসীম,
আমি স্বপ্নকে করেছি পূরণ
ঘর’কে করেছি স্বর্গ।
সত্য’কে করেছি প্রতিষ্ঠা
আর মিথ্যেকে দিয়েছি কবর।
আমি কন্টককে করেছি পুষ্প
বিষ’কে করেছি মধুর,
আমি কষ্ট’কে করেছি সুখ
আর অশ্রু’কে করেছি হাসি।
আমি গম্ভীর’কে করেছি হাস্যোজ্জ্বল
আর কঠিনকে সরল,
আমি ঘৃণাকে রূপান্তরিত করেছি ভালবাসায়
শত্রুতাকে মিলিয়ে দিয়েছি মিত্রতায়।
আমি এবং আমরা সবাই পারি
অসম্ভব’কে করতে পারি সম্ভবে রূপান্তর
প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, সাহস আর অধ্যাবসায়।

আত্মশুদ্ধি 

মাঝে মাঝে নিজেকে ভেঙে
আবার নতুন করে গড়তে হয়,
সম্পর্কগুলোকে পিচঢালা পথের মতো
নতুনভাবে ঢালাই করতে হয়।
নিজেকে, নিজের খেয়াল খুশিকে
পছন্দ – অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়,
কে পর, কে আপন বুঝে নিতে হয়,
কুহেলিকার মতো অন্ধবিশ্বাস থেকে
নিজেকে সরিয়ে আনতে হয়।
জীবন নদীর মতোই বহমান
নিজের পথ নিজেই করে নেয়,
কোন বাঁধা মানে না।
কখনো বাঁধা এলেও নতুন পথের সন্ধানে
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে জানে।
নিজের মাঝেই নিজেকে
নতুনভাবে আবিষ্কার করতে হয়,
নিজের ভেতরকার কথা কান পেতে শুনতে হয়।
শুনে দেখো মন কি বলে?
অনেক তো হলো৷
আর কতো?
এবার নিজেকে চিনে নাও।
নিজেকে আগলে রাখো,
নিজেকে ভালবাসো, ভালবাসতে শিখো,
নিজের ভুলগুলোকে খুঁজে বের কর।
দেখবে, তুমি কত সুন্দর!
নিজেই নিজের আলোয় আলোকিত,
নিজেই নিজের পরম আপন, পরম বন্ধু।