পদাবলিমুক্তগদ্য

একগুচ্ছ কবিতা- শাহিন চাষী

দেখা

যখনই অবসর,

নিমগ্ন খেয়ালে গোর্খার মতো কান-

বাতাসের মুখে ঘুমহীন বেহালার সপ্তমী সুরে

মানুষের দীর্ঘশ্বাস,

মাটির আহাজারি,

নদীর আর্তনাদ,

বৃক্ষের কান্না…

 

আমি চোখ মেলি,

দৃষ্টির প্রচ্ছদে মাথা উঁচু

বহুবর্ণিল-নাদুসনুদুস উপাসনার ঘর

ভেতরে গিজগিজে হৃষ্টপুষ্ট উপাসক!

 

মৃত্যুই বাঁচার আশা

আমার মুখে অন্ধকার-

তোমার চোখে জেগে ওঠে বিরক্তির ঢেউ?

 

আমার প্রার্থনায় মৃত্যু

তুমি আৎকে উঠেই বারংবার বলো ছিঃ! ছিঃ!

এমন কথা ঘুণাক্ষরেও আনতে হয় না মুখে;

সে তুমি বলতেই পারো- বলে যাও।

 

তবে সময়ে চড়ে ঘুরে এসো এদিক-সেদিক,

নিশ্চয় তোমার মুখ হারাবে ভাষা

আর অসষ্কোচে মানবে-এখানে মৃত্যুই বাঁচার আশা।

 

ভালোবাসার বুকে

তোমার-আমার পা উচ্ছ্বাস মেখেই

পাশাপাশি,

সম্মুখগামী।

 

বিদ্যুচ্চমক-

ব্যস্ত ডানায় উড়ে চলে শালিক-মাছরাঙা-বক

আমাদের কাছাকাছি

রোদপোড়া শুকনো পাতা

 

দিগন্তে চোখ-

আবীরের ঠোঁটে কথারা কিশোরী কাশ:

ভালোবাসার বুকে সুক্তিবৎ দীর্ঘশ্বাস!

 

বৃষ্টির সর্বনাম

তুমি বৃষ্টির সর্বনাম- স্বচ্ছ ও সুন্দর;

 

তোমার জাগরণ:

মনের মাঠে ঘাসের মতো স্বপ্নদল,

বুকের ভেতর দুরন্ত উচ্ছ্বাস ঠিক এক বহতা

ভাবনার বনে ফুলের মেলা-

মিঠে সুবাসের চঞ্চল মাদকতা!

 

শূন্যতায়

অথবা রোদমাখা বৈরিতায়

আকাশ ভুলে এখন চেয়ে থাকি পথে

শুধু তোমারই প্রতীক্ষায়।

 

অনুনয়লিপি

আগুনের জামা পরে হেঁটে যায় রোদ

কুড়ানো শব্দরা নিঃশব্দে বদলায স্বভাব-চরিত্র

 

চোখের সামনেই

কুমারী বুকে সৌন্দর্য ধরে অবিরল হাসে আরাধ্য যৌবতী

স্তনের ঢালে সাপিনী বেণী ঠিক এক বটের ঝুরি-

অধরের কোণে দুষ্টমির চমক

 

তারপর দলবাঁধা

মখমল পালকের রেশমী ডানার ফ্রক পরা উচ্ছ্বাস,

কল্পনার মাঠে শান্তিমোড়া সুখ সদাচঞ্চল হৈমন্তিক শালিক-

আবীরের ভাঁজে চুমুর কাল্লোল

 

বাতাসে হঠাৎ বিদগ্ধ পাতার দীর্ঘশ্বাস!

জল-ছায়া খুঁজেই নিমগ্ন ঋষিবর ঘাস, নদী, তরু, পাখি..

বুকের উপকূলে অনার্য বিষাদের কালো ধোঁয়া-

নিরুদ্দেশ প্রেম

 

অত:পর শোকে মুহ্যমান মন,

আকাশের উদ্দেশে আমি লিখে চলি একটি অনুনয়লিপি

 

উষ্ণতার স্বরলিপি

তোমার চোখে তাকালাম

অতল গহীনে দুলে উঠলো হিব্রু অক্ষরে লেখা প্লাকার্ড

অনুবাদ করতে পারিনি কোনমতেই তার ভাষা;

তবে ভ্রুর উচ্ছ্বাসে বুঝেছিলাম বেশ,

আমি আর কোথাও প্রেম খুঁজিনি কোনদিন।

 

তোমার ঠোঁট দেখলাম

হাসির তর্জমায় বুকের মধ্যে স্বপ্নদল দুরন্ত গঙ্গাফড়িং

সেই থেকে আমার দেখা হয়নি আর

প্রশান্ত শরতের জ্যোৎস্নাপ্রসবা চাঁদ।

 

তোমার নিঃশ্বাসের গভীরেই জীবনের মানে,

তোমার ছায়ার সীমান্তে স্বপ্নদল, দূরদর্শী পিপীলিকা-

ঝিনুকের রঙেই মুক্তার ইতিহাস লেখা।

 

তোমার চুলের ঘ্রাণ মেখে

আর চিবুক ছুঁয়ে গাণিতিক নিয়মে বুঝেছি এতটুকুন

উষ্ণতার স্বরলিপি সুবোধ্য চিরকাল।

 

কুহক বৃষ্টি

বারবার ছুটে যায় দরোজার কাছে,

মনের উপকুলে আজান্ম চেনা ছায়ার পদধ্বনি

বুকের ভেতর অবুঝ সুখ-

হয় পিপীলিকা, নয় দুরন্ত ঘোড়া…

 

দরোজা খুলি

ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে নীল ব্যথা-

কান্ত চোখে হঠাৎ কুহক বৃষ্টি।

 

অন্তিম ইচ্ছে

দাঁড়াতে গেলেই বসে পড়ি

দুচোখে ভেজা অন্ধকারের ঢেউ

তবুও মনের গহীন ভেতর একফালি ইচ্ছে-

রাত্রির ঢালে তরল জোছনা

জোনাকির গান….

 

আমি কী পারবো যেতে

আবার কোনদিন বুকভরার পাড়ে?

কতদিন দেখিনি মায়ের হাসি!

কতদিন মাখিনি বাবার ঘ্রাণ!

 

আর একটু থাকতে

(শ্রদ্ধাষ্পদ সুবিমল মিশ্রকে নিবেদিত)

অনুভব দ্বিধাহীন-

কালের ক্যানভাসে তুমি এক কারুজ কালপুরুষ।

 

তোমার অবিচল মুখে

অপূর্ব শোভায় আকাশ জাগানো সুবাসিত নক্ষত্র

জাঁ-লুক গদার,

লুই বুনুয়েল,

ঋত্বিক ঘটক,

জেমস জয়েস…

 

আমি দেখেছি

তোমার রেটিনার শরীরে সমাজ-সভ্যতা-মানুষ

জনহীন রাস্তার নিভাষ বাতি;

 

তোমার অক্ষরের ভাঁজে

বেগবান নদীর মতো মজবুত দৃঢ়তার স্থির ছাপ,

হৃৎপিণ্ডের ভেতর ঘড়ির কাঁটা

ফেনিল দ্রোহের বিক্ষুব্ধ নম্রতা

সত্যমাখা ক্ষেদের প্রাবল্য…

 

আর একটু থাকতে-

কঠিন-কোমল চোয়ালের পাঠেই শিখে নিতাম

প্রধা ভাঙার দুঃসাহসী ব্যাকরণ,

মুখোশ ঘেঁটে মুখ সৃষ্টির নির্ভুল কলা-কানুন।

 

জীবনকথা

পেট ভর্তি ক্ষুধা,

করোটি জুড়ে অবিশ্বাস, ঘৃণা, ক্ষেদ…

পাঁজরে-কোষে ফণিমনসার মতো দুর্বিণীত ক্রোধ;

 

কাছে এসো না-

ভুলেও এসো না আকাশছোঁয়া সান্ত্বনা-মায়া নিয়ে,

কোন কিছু বুঝবার আগেই সময়ের চোখে

বিভৎস এক রাক্ষুসে মুখ,

আগুনের পাহাড়

কিংবা কয়লা অথবা ছাইয়ের স্তপ!

 

আজকাল

আমি নিজেও ঘরবন্দী-

আবেগে ভাসি না এতটুকুন আবেগ মেখে;

চারিদিকে আমারই স্বজন,

মনে ভয়- খাদ্যের জন্যে যদি শিকার হই!

 

আরও পড়ুন- জহুর কবিরের কবিতা