একগুচ্ছ কবিতা- শেখ আব্বাস উদ্দিন
প্রেয়সী
সমাধির এককোনে বসে আছি তোমার আঙুল ছুঁয়ে,
যে আঙ্গুল অভিসারে ঠোঁট ছুঁয়ে ছিল আমার
পৃথীবিতে এখন সকাল;
আজ বাজারে প্রচণ্ড ভিড়, চায়ের দোকানে
কেউ একজন লিকার চায়ের খোঁজ করছে,
আমি শুয়ে আছি কবরের বিছানায়।
নীল জ্যোৎস্নার স্রোতে ভেসে যায় অন্ধকারের প্রাবল্য
তোমার মনের আকাশে
উঁকি মারতে চাইছে সকলে
অনুভূতির পাতা উল্টে দেখতে চায়
কি কথা বলে একাকী হৃদয়
অন্তরমানসের ছবি বড় নিঃসঙ্গ হয় ।
ঝাপসা চোখের পাতা জুড়ে শব্দহীন উৎকণ্ঠা
তোমার ভাতঘুম আর আমার খবরের কাগজের
পাতা ওল্টানো—
একদিন তুমি-আমি-আমরা, সৃজনের এই মহোৎসব
থেমে যাবে মহা কলরবে।
হিসাবের খাতা খুলে রেখে
মেঠো আলপথে হেঁটে হাজির হব
শেষ বিচারের দিন।
দেখব তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছো
ত্রস্ত চোখ খুঁজে চলেছে নিবিড় প্রেম।
বিধ্বস্ত জীবনের মাঠ
সিলিংয়ে ঝুলে আছে বিবর্ণ জীবন
পচা মাছের চোখের মতো অপলক চেয়ে আছে
ভ্রুক্ষেপহীন।
নবী কাহিনীর পাতায় জুলেখার প্রেম
রামচন্দ্রপুরের ঘাটে আজ খুব একটা ভিড় নেই
পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধ বিপন্ন জীবন
রুজি-রুটির টিকিটের লাইনে
স্ট্রীট কর্নারে কিছুক্ষণ আগে বক্তৃতা করছিলেন
একজন পোড়-খাওয়া নেতা
সমাজ পাল্টাতে চেয়ে পথে নেমেছে
মন্ত্রী হয়ে সরকারি তহবিল লুটতে চায়নি বলে।
শ্রাবন সন্ধ্যায় দীর্ঘশ্বাসের মত ফিরে গেল ভিখারিনী
মেয়েটি রাজধানীর থিকথিকে ভিড় রাজপথে
যার যেখানে মৃত্যু এসেছিল সেখানেই শুয়ে আছে সে
আমি আকাশের কাছে ঠিকানা চেয়েছি তোমার
পাঠাবে বলেছে গায়ের গন্ধ।
চারদিকে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ
সোনার কাঠি – রুপোর কাঠির গল্প বলার
অবকাশ নেই একটুও
শুধু মিথ্যার সাথে সহবাস।
অদৃশ্য এসরাজ এখনও বাজে
সহস্র শকাব্দ পেরিয়ে আমি যখন পিরামিডের
পাদদেশে এসে দাঁড়ালাম,
মাথার উপর তখন গনগনে সূর্য।
একটা ধূসর ফিঙে পাখি উড়ে গেল
কানের দেওয়াল ঘেঁষে।
চারিদিকে অবহেলার ছেঁড়া ছেঁড়া চিহ্ন গুলো
ছড়িয়ে আছে অবিন্যস্ত,
নতুন বধুর শ্বশুরবাড়িতে ফেনিয়ে বলা
বাপের বাড়ির গল্প-গাথা গুলোর মত।
সময়ের গলি পথ ধরে আমি যখন
রবীন্দ্র গানের সুরের মত ধীর লয়ে
এগিয়ে যাচ্ছিলাম সুস্বাদু মৃত্যুর দিকে
ঠিক তখনই কে যেন মাথার উপর প্রশ্রয়ের হাত
রেখে বলেছিল—-“জীবন কিন্তু এমনই!”
কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই
চমকে উঠেছিলাম আমি
সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ ঝলকানির প্লাবন প্রবাহ
শিরা উপশিরা সব চৌচির হবার উপক্রম,
ঝনঝন করে উঠেছিল মস্তিষ্কের মসনদ।
চেতনার সব রং পলাশ হয়ে ফুটে উঠল মুহুর্তে
দশ দিকে সে এক আলোকিত প্রদেশ।
মশালের তীক্ষ্ণ আলোয় আমার অভ্যন্তরের গহন
অন্ধকার দূরীভূত হলো।
ঘোর কাটিয়ে চোখ মেলে মনে হল এক
অবিনাশী সত্ত্বার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি
চোখের সামনে একরাশ দরাজ আলো,
এসরাজ বেজে চলেছে অবিরাম।
উ ত্তী র্ণ স ম য়
সময়ের এই বিপন্নতা কেটে যাবে একদিন,
মৃত্যুর স্রোত পিছনে ফেলে
জীবন জাগবে আবার সেহেরি ডাকে।
একটি পতাকা উড়বে মন্দির মসজিদ গির্জায়
ভোরের আজান-সন্ধারতি মিলিয়ে দেবে
জীবনের ছায়াপথ।
প্রাণের মিছিলে হাঁটবে তোমার আমার আদিম নিবাস,
শহরে জাগবে মানবিকতা
সাদামাটা জীবনের ডালভাত
ফোনের মিসডকল
রকের আড্ডা
সব ফিরে পাবে প্রিয় পড়শী চেনা-অচেনা
সব লোকজন
আবার সেই চেনা পৃথিবী।
অন্ধকার সমুদ্র পেরিয়ে মৃত্যুর লগি ঠেলতে ঠেলতে
ভেসে যাবে নূহের কিস্তি।
লোমশ প্রেম শীর্ণ পৃথিবীর গালে টোল দেখে
উৎফুল্ল চোখ তাকাবে আবার,
মাথায় হাত রেখে দাদীর দোয়া ফিরে পাবো
অপেক্ষার প্রহর
নুয়ে পড়া ধানের শীষ
বটের ডাল লাল ফলে ভরে থাকবে
আমার পৃথিবী আবার সুস্থ হবে
মানবিক হবে দেশের নেতারা
সব ছেলে মেয়ে পড়বে জীবনের পড়া
সব পরিযায়ী ফিরে আসবে সন্ধ্যা নামার আগে
অপেক্ষমান সন্তানের কাছে
প্রেয়সীর গরম ভাতে।
দুঃখ ডিঙিয়ে গেলে
যে কখনো প্রেমে পড়েনি সে ভাবে জীবনটা বৃথা সংরাগ;
প্রেমিক বোঝে প্রেমের বিড়ম্বনা কত!
শিঙি মাছের পুষ্টিটা দেখলে শুধু, তার কাঁটার যন্ত্রণা
উপভোগ্য নয় কারো কাছে
প্রচন্ড রোদে লস্যি খেতে ভালোবাসে গড়পড়তা মানুষ
বিকেল গড়াতেই টনসিল ফুলে যায়
টনটনে ব্যথায় কুঁচকে যায় ভ্রু’র শিরা-উপশিরা
যা কিছু উপভোগের সবকিছুই বিড়ম্বিত করে সমানতালে।
ধরোনা ওই টকটকে হলুদ ফুলটার কথা
সুন্দরী তন্বী চোখের তৃপ্তি কিন্তু
ওর ভেতরে থাকা পুষ্পকীটের দল
যদি গন্ধ নিতে নাকে চেপে ধরো
বুঝবে তখন তার আগে নয়!
নির্লোভ বালক যখন ফিরিয়ে দেয়
পড়ে-পাওয়া গহনার থলি
অসহায় বাপ প্রাণ ফিরে পায়।
পৃথিবীর হেসে ওঠে মুহূর্তে
সব ফুল ফুটে ওঠে একসাথে
গর্বিত হয় সভ্যতার ইতিহাস।
*হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
আরও পড়ুন- অমিতরুপ চক্রবর্তীর কবিতা