একগুচ্ছ কবিতা- আতিকুর ফরায়েজী
অন্তরালে
নগরের ভিড়ে তুমি, আমি,
নিঃশব্দে হাঁটি পাশাপাশি।
রাতের বাতাসে গুমরে ওঠে অচেনা কোনো গান,
তুমি শুনো, আমি শোনাই।
তোমার চোখের আলোর নিচে
রঙিন বাতিগুলোও ফিকে হয়ে যায়,
তবু আমরা কথা বলি না—
এই আধুনিকতার পাথরে চাপা পড়ে
শব্দগুলো কেমন নিস্তব্ধ।
তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হালকা হাসি
আমার সমস্ত বিকেলটা ভিজিয়ে দেয়,
তবু যেন কিছুই হয়নি,
তুমি আমার ছায়ায় হারিয়ে যাও—
আমি তোমার পথে।
একদিন হয়তো আমরা
নতুন কোনো আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে,
চুপচাপ হাতে হাত রাখবো,
কিছু না বলেও বুঝবো,
এই ব্যস্ত শহরের পথের মতোই
আমাদের ভালোবাসা গভীর।
অপেক্ষা
একলা পথের ধারে যখন দুপুরের রোদ
গাঢ় হলুদ ছায়া ফেলে যায় গাছের পাতায়,
তখনো মন খুঁজে ফেরে তাকে,
যে হেঁটে গিয়েছিলো একদিন, হারিয়ে যাওয়া সময়ের মতো।
তার চোখের ছায়া মিশে আছে ধুলোমাখা দিনের স্রোতে,
যেনো অজানা কোনো নদীর শান্ত স্রোত,
যার তীরে দাঁড়িয়ে থাকি আজও,
অপেক্ষায়—এক ফোঁটা জল কিংবা এক চিলতে আলোর।
এমনই তো ছিলো সে,
নিঃশব্দে এসে চলে যাওয়া স্নিগ্ধ এক কল্পনা,
যার কাঁচা দুঃখের রঙ ধরা থাকতো বাতাসের ভাঁজে,
আমার ছায়ার সাথে মিশে যেতো নিভৃত সন্ধ্যায়।
কখনো কি সে জানবে—
আমার প্রতিটি আকাশ, প্রতিটি বৃষ্টি,
তার স্মৃতির কুয়াশায় জড়িয়ে আছে?
এখনো রাত জেগে শুনি বাতাসের গুঞ্জন,
যেনো সে ডাকছে দূর থেকে,
অচেনা কোনো গ্রামের অন্ধকারের দিকে।
এভাবেই রয়ে যায় তার নামহীন গল্প,
অচেনা পথিকের মতো, হারিয়ে যায় সময়ের ধুলোয়।
তবু মনে হয়,
কখনো সে ফিরবে—শুধু একবার,
যতটুকু আলো হয় একটি গভীর রাতে
বিদ্যুৎ চমকানোর কালে।
নদী ও তুমি
নদী আর তুমি-
এক হয়ে মিশে আছো দূর সীমানায়।
আমি খুঁজি তোমাকে পেরিগ্রিনির চোখে
কিংবা ব্লাক মার্লিনের সীমানায়।
তুমি অসীম, অপরিসীম হয়ে মিশে গেছো
নদীর সাথেই।
তোমার চাহনী যেন দিকভোলা নাবীকের চোখ;
মধ্যদুপুরে তৃষা হয়ে মুছে যায়।
নদীর যে তরঙ্গ আকাশে মিশে যায়
অবিচল, অস্তিত্বহীন নির্যাতিত প্রেমিকের মতো-
তুমিও তাদের চেয়ে কম নও।
তোমার আভাস যেন নদীর কিনারার চর।
সুর এসে বালুকাতে লিখে যায়,
কত গল্প ঢেউ হয়ে মিশে যায় ।
বালিতে বালিতে তার প্রমাণ
বয়ে নিয়ে বেড়ায় এ জনপদ।
তুমি তার খোঁজ রাখনি কোনোদিন।
তুমিতো তোমার স্বপ্ন নিয়ে
বুক পেতে চেয়ে আছে আকাশের দিকে।
কোনোদিন দেখিনি তোমায়।
তবু তীরে আমার বুক খা খা করে।
তোমার উপমা আর অজানা গান নিয়ে-
আমি তোমায় জানতে চাই:
আমিও নদীর সাথে লীন হতে চাই।
মায়া
শান্ত নদীর তীরে যখন সন্ধ্যা নামে ;
গায়ের গৃষকেরা ঘরে ফিরে যায়;
তখন তোমার আঙুল পরশ বুলিয়ে যায়—
আমার এলোমেলো চুলে।
বহুদূর হতে ভেসে আসা গানে
তোমার কণ্ঠের তরঙ্গ শুনতে পাই।
সে গান; জানি কোথাও তার অস্তিত্ব নাই
তবু সে বাজে— নিভৃত কোনো ছায়ার মতো।
তুমি আসো নীরবে, গভীর রাতে
তোমার পায়ে লেগে থাকে—
ভেজা ঘাসের ঘ্রাণ, ফড়িংয়ের ডানা।
তোমার চোখের তারায় জোনাকির মিটমিট আলো
আমার সমস্ত দিনকে ডেকে নিয়ে যায়—
অসীম আকাশের গায়ে সে মায়ার বাঁধনে।
যদি কখনো সেই আকাশের নীল রঙে মিশে
তোমার কণ্ঠের অনুরণন জাগে,
তবে আমিও যেন ছুঁয়ে দিই—
গোধূলির শেষ আলোর মতন
তোমার কোমল চপলখানি।
এমন করেই চুপি চুপি বয়ে যাবে
সময়ের তীর, বাতাসের হাওয়া,
তুমি থেকো গাঢ় অন্ধকারের
অতল গভীরে স্বপ্নের খোলস পরে।
হয়তো তখনও তোমার মায়ায়
কোথাও একান্তে বাজবে হৃদয়,
অবিরাম সেই সুরে; অদৃশ্যতার আলোয়।
রাতের প্রেমপত্র
রাতের আঁধারে তোমার মুখখানি ভেসে ওঠে,
মায়াবী এ চাঁদের আলোয় মিশে যায়-
তোমার হাসির রেখা।
তুমিও হয়ত বসে আছো একা।
কোনো এক ছাদের কোনে
তোমার শাড়ীর আঁচল যায় দেখা।
প্রতিটি দিনের শেষে-
তোমার স্মৃতিরা আসে।
আমার উঠোন জুড়ে
ভালবাসার হাওয়া বয়ে যায়।
তারার ক্যানভাসে ভেসে উঠে
তোমার কপালের টিপ।
যে টিপে প্রেমের কবিতা লিখি রাতের পাতায়।
রাতের শীতল হাওয়ায়
তোমার স্পর্শের অনুভূতি
গোলাপ পাপড়িতে কম্পন জাগায়।
রঙিন জোনাকিরা
ঘিরে ধরে আমার চারিধার।
তোমার প্রেমের মিষ্টি স্বাদে আমি মজে যাই,
তুমি বাসা বাঁধো আমার অস্তিমজ্জায়।
দিন এসে দিন যায়,
রাত এসে ফুরায়।
চাঁদ ডুবে, ফুল ঝরে, তারারা হারায়
আর জোনাকিরা ঘরে ফিরে যায়।
তবুও আমি বেঁচে থাকি তোমার উষ্ণতায়।
*আতিকুর ফরায়েজী- সম্পাদক: পয়স্তি ম্যাগাজিন
আরো পড়ুন- মাহদী মল্লিকের কবিতা