প্রচ্ছদসাক্ষাৎকার

জগতের আনন্দযজ্ঞে পরম শুন্যতা নিয়ে ভেসে বেড়াতে চাই- কবি এনামূল হক পলাশের সাক্ষাৎকার

কবি এনামূল হক পলাশ। নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলায় ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। কবি উদ্ভিদ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৯৪ সালে বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাটির সুবাস পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি ২০০৩ সালে ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ চাই’ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও- জীবন এক মায়াবী ভ্রমণ, অন্ধ সময়ের ডানা, অন্তরাশ্রম, মেঘের সন্ন্যাস, পাপের শহরে, তামাশা বাতাসে পৃথিবী, জল ও হিজল, অখণ্ড জীবনের পাঠ, লাবণ্য দাশ এন্ড কোং ইত্যাদি কবির প্রকাশিত কই।

প্রাচীন আরবি সাহিত্যের অনুবাদের বই- ধর্মবিশ্বাস আখ্যানের মত সুন্দর ও কবিতার অনুবাদ বই মু—আল্লাক্বা। তার কিছু কবিতা নিয়ে ইংরেজিতে ভাষান্তরিত বই CROSSING FORTY NIGHTS প্রকাশিত হযয়েছে। জমি নিয়ে- ‘ভূমি ব্যবস্থাপনার সরল পাঠ’ তার বই। শিশুতোষ বই কলমি লতার ফুল, মগড়া নদীর বাঁকে, বইয়ের পাতায় ফুলঝুরি। তিনি একাধারে কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও গীতিকার। অন্তরাশ্রম নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও  সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা করেন। এছাড়াও গণতন্ত্রের গান ও রাত্রির গান নামক দুটি গানের গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রতিষ্ঠিত কবিতাকুঞ্জর প্রথম পরিচালক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর কবিতাচর্চা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেছেন পরমপাঠ সম্পাদক ওয়াজেদ নবী’র সাথে।

ওয়াজেদ নবী: কেমন আছেন ?

এনামূল হক পলাশ: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। পরশ্রীকাতর আত্মা ছাড়া সকল আত্মার লোকজন সর্বাবস্থায় ভালো থাকে বলে আমি মনে করি।

ওয়াজেদ নবী:  লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?

এনামূল হক পলাশ:  মূলত পড়াশোনা করতে গিয়েই লেখালেখির বিষয়টা মাথায় আসে। সেই সাথে আমাদের বালকবেলায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ আমাকে ছেলেবেলায়ই এর ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে। তখন ছিলো লিটলম্যাগের যুগ। সেখানেই আমার লেখালেখির হাতেখড়ি।

ওয়াজেদ নবী:  প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কিছু বলুন।

এনামূল হক পলাশ:  স্কুল জীবনে যে সকল কবিতা লিখেছিলাম বা কলেজ জীবনের প্রথম দিকের কবিতাগুলো হারিয়ে ফেলেছি। পরবর্তীতে বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িত থাকাবস্থায় লেখা কিছু কবিতা যেগুলো বন্ধুমহলে জনপ্রিয় ছিলো সেগুলো নিয়ে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ চাই”। এই বইটি আসলে আমার জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ের নির্যাস। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “জীবন এক মায়াবী ভ্রমণ”। তারপর থেকে অবিরাম কাজ করে চলেছি। প্রতি বছর একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে এক সময় মনে হয়েছে শিশুদের জন্য কিছু কাজ করা দরকার। সে চিন্তা থেকে চারটি শিশুতোষ ছড়ার বই হয়েছে। ধর্মের নামে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা তা ভাবতে গিয়ে লেখা হয়েছে সুফি কবিতা নামে তিন শত কবিতা। এই সময়টা কয়েকজন আরব কবিকে পড়েছি। পড়তে গিয়ে ইমরুল কায়েস আর আল মা-আরি এর কবিতা অনুবাদ করেছি। সেগুলো বই আকারে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। নিজের লেখা বইয়ের গুনগান গাইবো না। সেটা সময়ে বিচার হবে। আমি মনে করি আমার দায়িত্ব হচ্ছে অবিরাম কাজ করে যাওয়া। ইতিমধ্যে কবিতা, গবেষনা, শিশুতোষ ও অনুবাদ মিলিয়ে আমার ১৭ টার বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে।

ওয়াজেদ নবী:  এখন কি লিখছেন?

এনামূল হক পলাশ:  টুকটাক কবিতা লিখছি কারণ কবি সত্ত্বাই আমার আসল সত্ত্বা। এর মধ্যে আরব ভূখন্ডের কবিতা শিরোনামে একটি পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেছি যেখানে ১০ জন আরব কবির জীবনী ও কবিতা আছে। ত্রিশজন আদিবাসী নারীর জীবনী ও কবিতার অনুবাদ, নাজিম হিকমতের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ, মাহমুদ দারবিশের ডায়েরী অনুবাদ করে যাচ্ছি। তাছাড়া সুফিবাদকে আত্মপরিচয়ের পথ হিসেবে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি এবং কিছু প্রবন্ধের কাজে হাত দিয়েছি। এগুলোর সাথে সাথে সুফি ধারার কিছু গান লেখা হচ্ছে যেগুলো সুর করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

ওয়াজেদ নবী:  আপনার কবিতার বিষয়বস্তু বা উপজীব্য নিয়ে বলুন।

এনামূল হক পলাশ:  আমি জীবন পাঠ করি। আমি জীবন লিখি। মানুষের জীবন, জীবনের অন্তর্গত লড়াই, প্রকৃতি, প্রেম, সৃষ্টির আর স্রষ্টার রহস্য আমার কবিতার বিসয়বস্তু বা উপজীব্য বিষয়।

ওয়াজেদ নবী:  আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।

এনামূল হক পলাশ:  আসলে আমি মেলা কেন্দ্রীক বই প্রকাশ বা লেখায় বিশ্বাসী না। মেলা একটি উপলক্ষ্য মাত্র। একটি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হচ্ছে মেলা। বাকি সবটা সময়ই কাজের। লেখক এবং প্রকাশকের উচিত সারাবছর কাজ করে যাওয়া। মেলায় শুধুমাত্র কাজের প্রচার করা হবে। তাই মেলার বহু আগেই আমার তিনটি পান্ডুলপি ছাপানোর কাজ শেষ করতে বলেছি সংশ্লিষ্ট প্রকাশককে। ইতিমধ্যে আমার শিশুতোষ বই “পাখ পাখালির কবিতা” ছাপা শেষ। শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে অনুবাদ গ্রন্থ ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারিবিশের “লিখে রাখো আমি একজন আরব” এবং মৌলিক কাব্যগ্রন্থ “সুফি কবিতা”। মেলার আগেই এর সব কাজ শেষ হবে। পরবর্তী বইগুলো নিয়ে মেলা শেষ হলে চিন্তা করব।

ওয়াজেদ নবী:  পাঠকদের থেকে একজন কবির প্রত্যাশা কি থাকে? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কি?

এনামূল হক পলাশ:  এভাবে কখনো ভাবিনি আগে। আমি মনে করি আগুন এবং জ্ঞান বা অনুভব ছড়িয়ে দিলে কখনো তার অধিকারীর ঘাটতি হয় না। কেউ একজন যদি আমার একটি কবিতায় অনুরিত হয় অথবা ধারন করে পুলকিত হয় তাতেই আমি সার্থক। জগতের একটি মানুষও যদি আমার কবিতায় নিজের মানসিক অবস্থাকে আবিষ্কার করতে পারে তাতেই আমি খুশি।

ওয়াজেদ নবী:  কবির কি স্বীকৃতি প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?

এনামূল হক পলাশ:  কে কাকে স্বীকৃতি দিবে? কবি হচ্ছে এমন এক সত্ত্বা যার স্বীকৃতি পাওয়া বা না পাওয়ায় তার কিছু যায় আসে না। শুধুমাত্র কবিতা লিখে জীবন নির্বাহ করা যায় না। সুতরাং এখানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কিছু নেই। আর প্রচারের মাধ্যমগুলো সিন্ডিকেট আর ভন্ডদের কবলে। এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করতে চাই না।

ওয়াজেদ নবী:  লোকে বলে কবিরা ভাতে মরে- এ নিয়ে কিছু বলুন।

এনামূল হক পলাশ:  কথা সত্য নয়। কবিরা উত্তরাধুনিক। স্মার্ট। কবিরা অনেক গুছানো ও পরিপাটি। মানুষের প্রচলিত ধারণা ভুল। অতীত বা বর্তমানের অনেক বিত্তশালী কবি ছিলেন বা আছেন। কেউ কেউ স্বভাব দোষে ভাতে মরার দশায় থাকেন তবে সেটা কবিতা লেখার জন্য নয়। কবিতা না লিখেও ভাতে মরে এমন লোকের সংখ্যা দেশে কিন্তু কম নয়।

ওয়াজেদ নবী:  একজন লেখক কবির জন্য পড়াশোনা কতটুকু জরুরী?

এনামূল হক পলাশ:  উকিল মুন্সি ত আর জীবনানন্দ দাশকে চিনতেন না। কবিয়াল মদন সরকার টি এস এলিয়টের নামই শুনেননি। তা বলে তাদের কবিসত্ত্বা নষ্ট হয়ে যায়নি। তবে পড়াশোনা করলে লেখা স্মার্ট হয়। কখনো ওভার স্মার্ট হয়ে আর সেটা স্বাভাবিক জীবনকে কমিউনিকেট করতে পারে না। তবে জ্ঞানার্জনের জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই। একজন সাহিত্যিকের মূল কাজ হচ্ছে প্রকৃতি ও জীবন পাঠ করা। পাঠোদ্ধার করে লিখে যাওয়া।

ওয়াজেদ নবী:  প্রকাশকদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য চাই।

এনামূল হক পলাশ:  অজ্ঞাত কারণে প্রকাশনার ব্যবসা এদেশে খুব একটা ফ্রুটফুল না। তাদেরকে দোষ দেই না। তবে সৃজনশীলতার নামে ভন্ড কিছু প্রকাশকের আচরণ মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। একজন প্রকাশক যার বাংলাদেশে খুব নাম ডাক আছে। ইন্ডিয়া বা ইউরোপে মেলার স্টলে বই রাখে এমন একজন আরকি। পান্ডুলিপি দেয়ার পর আমার থেকে পঁচিশ হাজার টাকা হাওলাত নেয়। প্রচ্ছদ আমিই করিয়ে দিয়েছি। রকমারিতে এড দেয়া হয়। আমার জানামতে আশিটার উপরে প্রি অর্ডার হয়। বই বের করতে প্রায় এক বছর সময় নিয়েছে। অবশেষে বই প্রকাশ হয়েছে। রকমারি থেকে অর্ডারের বই আর পাঠকের কাছে যায় না। আমি কপি পেয়েছি দুই বারে পনেরোটি। পাঠকের কাছে বই যায় না, হাওলাত টাকার খবর নাই। মনে কষ্ট পেয়েছি। আবার দেখি সেই প্রকাশক ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে বড় বড় বুলি আওড়ায়। তিনি আবার সৃজনশীল প্রকাশকদের নেতা গোছের লোক। ঠিক তার উল্টো ঘটনাও আছে। আদর্শ প্রকাশনী আমার বই প্রকাশ করেছে রীতিমতো চুক্তি করে। আমি তখন সন্মানিত হয়েছি, আনন্দিত হয়েছি। তাছাড়া সিলেটের একটি প্রকাশনী ছাড়া সবার কাছ থেকেই কমিটমেন্ট ঠিক পেয়েছি। এখন আমার বই প্রকাশ করছে বাবুই আর ঘাসফুল। তারা উভয়েই পেশাদার এবং ভরসা করার মতো প্রকাশক।

ওয়াজেদ নবী:  নিজের লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা জানতে চাই।

এনামূল হক পলাশ:  মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত লিখে যেতে চাই। তাছাড়া আর কোন পরিকল্পনা নাই। নিজেকে শুন্য করে ফেলার চেষ্টা করাই আমার লক্ষ্য। বিশেষ কোন প্রত্যাশা নাই। প্রত্যাশী হয়ে হতাশায় ডুবতে চাই না। বরং জগতের আনন্দযজ্ঞে পরম শুন্যতা নিয়ে ভেসে বেড়াতে চাই।

ওয়াজেদ নবী:  যারা লিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

এনামূল হক পলাশ:  আমি যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছি সেগুলোর মধ্যেই পরামর্শ দেয়া হয়ে গেছে। যারা লিখতে চায় তাদের উচিত প্রাপ্তির আশা না করে লিখে যাওয়া। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ একত্রিত হয়ে বিশাল আর মহান কাজে পরিণত হবে।

ওয়াজেদ নবী: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য পরমপাঠ পরিবারের তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সাহিত্যচর্চার জন্য আমাদের শুভকামনা।

এনামূল হক পলাশ:  আপনাদের জন্যও শুভকামনা।

 

ফেসবুকে আমাদের ফলো করুন- পরমপাঠ

পড়ুন- কবি রফিকুজ্জামান রণির সাক্ষাৎকার