প্রচ্ছদসাক্ষাৎকার

শুধু কবিতা পড়ে কেউ কবি হতে পারে না -রফিকুজ্জামান রণি: সাক্ষাৎকার

[কবি ও কথাসাহিত্যিক রফিকুজ্জামান রণির জন্ম ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯২। চাঁদপুরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। পেশায় আইনজীবী।

পেয়েছেন জেমকন পুরস্কার-২০১৯; চাঁদপুর জেলা প্রশাসক পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৮; দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৮; ফ্রেন্ডস অব হিউম্যানিটি বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড-২০২০; ‘এবং মানুষ’ তরুণ লেখক পুরস্কার-২০১৯; পেন বাংলাদেশ সাহিত্য পুরস্কার-২০২১; নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা-২০১৯; চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার-২০১৪; জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা-২০১৪; মুন্সিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ সম্মননা-২০২২; নতুন এক মাত্রা তরুণ লেখক পুরস্কার ২০২৩; ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম সাহিত্য পদক-২০১৩।

প্রকাশিত গ্রন্থ ৬টি: দুই শহরের জানালা (গল্প); ধোঁয়াশার তামাটে রঙ (কবিতা); চৈতি রাতের কাশফুল (গল্প); মুঠো জীবনের কেরায়া (কবিতা), অতল জলের গাঁও (কবিতা) ও স্মৃতির ছায়াশিস (গল্প)।] পরমপাঠ এর জন্য তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সম্পাদক ওয়াজেদ নবী।]

 

ওয়াজেদ নবী: কেমন আছেন?

রফিকুজ্জামান রণি: এখন পর্যন্ত ভালো আছি।

 

ওয়াজেদ নবী: লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?

রফিকুজ্জামান রণি: ছাত্র জীবনে একটি বাসায় পড়াতাম। একসন্ধ্যায় বাসার মালকিনের সামনে এসে মধ্যবয়েসী একজন নারীকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে শুনেছি, মাস কয়েক আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে। যৌতুকের টাকার জন্যে স্বামী তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। টাকা দেওয়ার মতো সাধ্য তাদের নাই। কথাগুলো আমার কিশোর মনে আঘাত করে, ভীষণ মন খারাপ হয়। রুমে এসে লিখে ফেলি ‘মরণব্যাধি যৌতুক’ শিরোনামের একটি কবিতা। অবশ্য খুবই মানহীন ছিলো সে কবিতা। তাতে কী, ওটাই যে আমার প্রথম কবিতা! সেই যে শুরু হলো, এখনও চলছি।

 

ওয়াজেদ নবী: প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কিছু বলুন।

রফিকুজ্জামান রণি: আমি মূলত লিখি কম, পড়ি বেশি। যা-ই লিখি সর্বোচ্চটা দিয়ে লেখার চেষ্টা করি। এ পর্যন্ত আমার ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে: দুই শহরের জানালা (গল্প); ধোঁয়াশার তামাটে রঙ (কবিতা); চৈতি রাতের কাশফুল (গল্প); মুঠো জীবনের কেরায়া (কবিতা), অতল জলের গাঁও (কবিতা) ও স্মৃতির ছায়াশিস (গল্প)। বইগুলো যার হাতেই পড়েছে, অন্তত মানহীন বলতে পারেনি। এরমধ্যে বেশ কয়েকটা বই ভালো মানের পুরস্কারও পেয়েছে। দেশের অনেক বিখ্যাতজনও বইগুলো সম্পর্কে পজেটিভ মন্তব্য করেছে।

 

ওয়াজেদ নবী: এখন কি লিখছেন?

রফিকুজ্জামান রণি: আইনপেশায় প্রবেশ করেছি নতুন। পেশাটা বেশ উপভোগ করছি। অল্পদিনের সংসার এবং নতুন সন্তান, আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। তাই আপাতত লেখালেখিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কিছু সময় জীবনটাকে অন্যভাবে উপভোগ করতে চাই। তারপরও সুযোগ পেলেই কবিতায় মজে থাকি।

 

ওয়াজেদ নবী: আপনার কবিতার বিষয়বস্তু বা উপজীব্য নিয়ে বলুন।

রফিকুজ্জামান রণি: আমি আগেও অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছি, এখনও বলি- আমার কবিতার প্রধান চরিত্র মানুষ এবং প্রকৃতি। তবে বৈশ্বিক প্রকরণের সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরির আপ্রাণ চেষ্টাটুকু করে যাই। সময় এবং ইতিহাসকে ধারণ করে কবিতা লেখার চেষ্টা করি।

 

ওয়াজেদ নবী: আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।

রফিকুজ্জামান রণি: আমার বইগুলো সাধারণত মেলার আগেই বেরিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, বই যখনই বের হোক না কেন, প্রকাশক সেটা যথাসময়ে মেলায় নিয়ে আসে। বই যে কেবল মেলাকেন্দ্রীক বের হতে হবে এমন ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। সারা বছর ধরে বই বের হলে যাছাই বাছাই করার করার সুযোগ থাকে। মানের দিকে নজর রাখা যায়। তাই আমার বেশির ভাগ বই মেলার আগে অথবা পরে প্রকাশিত হয়। সুতরাং মেলার ওপর আলাদা জোর দেওয়া প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এই তো গত জুন মাসে আমার একটি গল্পের বই ‘স্মৃতির ছায়াশিস’ প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন। সেটাই আসবে বই মেলায়।

 

ওয়াজেদ নবী: পাঠকদের থেকে একজন কবির প্রত্যাশা কি থাকে? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কি?

রফিকুজ্জামান রণি: কবি চায় পাঠক তাকে গ্রহণ করুক। আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়।

 

ওয়াজেদ নবী: প্রকাশকদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য চাই।

রফিকুজ্জামান রণি: এ দেশে অনেক ভালো প্রকাশক আছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি ধূর্ত এবং মুনাফাখোর প্রকাশকও আছে। একজন প্রকাশক ইচ্ছে করলে ভালো একটা লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে খুব দ্রুত সময়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এ দেশের বেশিরভাগ প্রকাশক অধিকতর মুনাফার আশায় ক্ষমতা এবং অর্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বই প্রকাশ করে। লেখার মান নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই, লেখক কতটা ক্ষমতাধর এবং বিত্তশালী সেদিকে তাদের নজর। সেসব মৌসুমী লেখকদের লেখা প্রকাশ করে তাদেরকে নিয়েই আবার মাতামাতি শুরু করে দেয়। এতে পাঠক বই কিনে বিব্রত হয়। আমি হলফ করে বলতে পারি, এ দেশের মুনাফাখোর প্রকাশকরাই বইয়ের বাজার নষ্ট করেছে। টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করে করে পাঠককে ঠকাচ্ছে তারা। লেখকদের রক্তচুষে খাচ্ছে। তবে এসবের মাঝেও ভালো ভালো কিছু প্রকাশক অবাণিজ্যিক চিন্তাধারা লালন করে বলেই এখনও সুন্দরের চর্চা একেবারেই থমকে দাঁড়ানি।

 

ওয়াজেদ নবী: কবির কি স্বীকৃতি প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?

রফিকুজ্জামান রণি: পৃথিবীর সবকিছুতেই একটা স্বীকৃতি আশা করে মানুষ। এটি দোষের কিছু নয়। যেমন একটি রাষ্ট্র নতুন করে সৃষ্টি হলে বৈশ্বিক স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কোনো রাষ্ট্রের সরকার নতুনভাবে গঠিত হলেও আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তার মানে এই নয় যে, স্বীকৃতি না পেলেই তা হারিয়ে যাবে। এই যে যেমন ইসরাইল রাষ্ট্রের কথাই ধরুন, বিশ্বের অনেক দেশ তাকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তার মানে কি দেশটা হারিয়ে গেছে? বরং দেশটির আরও আত্মনির্ভরতা বেড়েছে। স্বনির্ভরতায় ঝুঁকেছে। অবশ্য আমি নিজেও ওই রাষ্ট্রটিকে অপছন্দ করি। তাতে কী, তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বকে টেক্কা দিয়ে দেশটি এখন ধীরে ধীরে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। তাদের দাপট এবং বর্বরতা দেখে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই এখন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। সুতরাং স্বীকৃতি পেতেই হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তেমনি লেখার শক্তি থাকলে একদিন না একদিন স্বীকৃতি এমনিতেই চলে আসে। সেটা পদলেহন করে আনতে হয় না। লেখনির শক্তিসামর্থ্য দিয়ে আদায় করে নিতে হয়। তারপরও আমি মনে করি জীবদ্দশায় একজন লেখক তার যোগ্যতার স্বীকৃতি পেলে গতি বাড়ে। ভেতরে একটা আনন্দ অনুভব করে। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিংবা না পাওয়া সেটা তো আপেক্ষিক বিষয়। কারণ, আজ যাকে আমরা কবি হিসেবে খারিজ করে দিলাম, কয়েক দশক পরে হয়তো সে ব্যক্তিটিই হয়ে উঠবে পাঠক নন্দিত কবি। পৃথিবীতে এমন নজির হাজার হাজার আছে। কেউ না মানলেই যে আপনি অকবি, আর মানলেই যে আপনি মহাকবি এমন ধ্যানধারণা আমি লালন করি না। আমাদের কাজ হচ্ছে লিখে যাওয়া। সময় বিচার করবে কে কবি আর কে কবি না।

 

ওয়াজেদ নবী: লোকে বলে কবিরা ভাতে মরে- এ নিয়ে কিছু বলুন।

রফিকুজ্জামান রণি: আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি কবিরা ভাত-কাপড়ের চেয়ে নিজের শিল্পসত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই পৃথিবীর অন্য মোহ তার ভেতরে জায়গা করে নিতে পারে না বলেই পার্থিব অভাব তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনকার বেশিরভাগ কবিই স্বাবলম্বী। অনেকে তো এসি রুমে বসে কবিতা লিখছেন।

 

ওয়াজেদ নবী: একজন কবির জন্য পড়াশোনা কতটুকু জরুরি?

রফিকুজ্জামান রণি: পড়াশোনা না করে কখনও কবি হওয়া যায় না। যদিও কবি হতে গেলে একাডেমির যোগ্যতা থাকা মুখ্য নয়, কিন্তু একজন কবিকে সব ধরনের পড়া পড়তে হয়। শুধু কবিতা পড়ে কেউ কবি হতে পারে না; শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য, চিত্রকাল, ধর্মপাঠ এবং আধুনিক বিশ্বাস সম্পর্কে খেয়াল রাখতে হয়। বিশ্বের বিচিত্র ঘটনার গল্প না জানলে, সে কী নিয়ে কবিতা লিখবে?

 

ওয়াজেদ নবী: নিজের লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা জানতে চাই।

রফিকুজ্জামান রণি: জীবনের কোন কাজই পরিকল্পনা নিয়ে করিনি। তবে যা করি, মনপ্রাণ উজার করে দিয়ে করার চেষ্টা করি। আমি কাজে বিশ্বাসী, কাজ করে যেতে চাই, লেখক হতে চাই; এর চেয়ে বড় কোনো প্রত্যাশা লালন করি না। আমার প্রাপ্তি অনেক। এই বয়সে যা পেয়েছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট।

 

ওয়াজেদ নবী: যারা লিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

রফিকুজ্জামান রণি: মনে জোর নিয়ে লিখতে থাকুন, হতাশ হবেন না। পড়াশোনা করে নিজেকে ঋদ্ধ করুন, কারো কথায় থমকে দাঁড়াবেন না। তাড়াহুড়ো করে বড় হওয়ার স্বপ্ন না দেখে, সাধনা করুন। অন্যায়ের সঙ্গে আপোস না করে লেগে থাকুন, সময় একদিন আপনাকে লেখক বানিয়ে তুলবে।

ওয়াজেদ নবী: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য পরমপাঠ পরিবারের তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সাহিত্যচর্চার জন্য আমাদের শুভকামনা।

রফিকুজ্জামান রণি: আপনাদের জন্যও শুভকামনা।

 

ফেসবুকে আমাদের ফলো করুন- পরমপাঠ সাহিত্য পত্রিকা 

আরও পড়ুন- জামিল হাদীর সাক্ষাৎকার