কবি টিটো মোস্তাফিজ: হাইকু চর্চা ও সমৃদ্ধিতে অবদান- রুশিয়া জামান রত্না
যুগের প্রয়োজনেই সাহিত্যের শাখা প্রশাখা সৃষ্টি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যে পদ্য গুহাবাসীদের মনোরঞ্জন করতো, আধুনিক যুগে এসে তার ধরন পাল্টেছে অনেকখানি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যস্ততা। জীবনে বেড়েছে গতি। তাই সময়ের প্রয়োজনেই পাল্লা দিয়ে ধরন পাল্টেছে সাহিত্যের। সৃষ্টি হয়েছে কবিতার ক্ষুদ্রতম রুপ হাইকু-র।
“এ কবিতা গান গাওয়ার কবিতা নয়। এ কবিতা অনুভবের। ” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই হাইকুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে। কবিগুরু হাইকুকে অবহিত করেছেন হৃদয়ের কৃচ্ছ্রতা বলেও। ১৯১৬ সালে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণ করেন। এরপর আরও চারবার জাপান ভ্রমণ করেছেন। সেখানে গিয়ে তার পরিচয় সাহিত্যের এই নবীন এবং আকারে ক্ষুদ্রতম প্রশাখা হাইকুর সাথে। জাপান ভ্রমণ কাহিনীতেও হাইকু নিয়ে নিজের অনুভূতি লিখেছেন, রচনা করেছেন গোটা কয়েক হাইকু। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে জাপানে আবির্ভূত এ শিরোনামহীন কবিতা বাংলা ভাষায় চর্চ করা খুব কঠিন। কারণ বাংলার সাথে জাপানি ভাষার গঠনশৈলীর পার্থক্য রয়েছে। জাপানি রীতি পুরোপুরি মেনে বাংলায় হাইকু রচনা করা সম্ভব নয়। সব ক্ষেত্রে ১৭ মাত্রা অর্থাৎ ৫+৭+৫ মানলে কবিতার সৌন্দর্য নষ্ট হবার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এপার এবং ওপার বাংলার অগণিত কবিদের মধ্যে হাইকু চর্চা করেন এমন কবি-র সংখ্যা হাতে গোনা। জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের কলকাতায় প্রথম “বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক হাইকু কবি সম্মেলন” অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সবসময়ই কর্ণ শ্রুতিমধুর সাহিত্যে অভ্যস্ত। সে কারণে শ্রুতিমধুর ধারাকে বিশেষ করে সরল ছন্দকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নিয়ে বাংলায় হাইকু চর্চা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নাটোর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক টিটো মোস্তাফিজ। তার মতে হাইকু নিয়ে পাঠক তার ইচ্ছে মতো অনুভবে ব্যাখ্যা করবে। চলন্ত জীবনে একটুখানি বিশ্রাম নিতে সাহায্য করবে একটি হাইকু। অথবা বলা যায় জানলাবিহীন বন্ধ দরজার ঘরে ভেন্টিলেটরের ভূমিকা রাখবে হাইকু। প্রচন্ড গরমে হাইকু দিবে এক চিলতে মেঘের ছায়া।
রুশিয়া জামান রত্না
হাইকুর প্রতি তার আগ্রহ জন্মে যখন তিনি জাপানে একটি প্রশিক্ষণের উদ্দ্যেশে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে জাপান ভাষা এবং হাইকুর চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “সালতামামির পঙক্তিমালা”য় অল্প কিছু হাইকু প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে পূর্ণাঙ্গ হাইকু কাব্যগ্রন্থ ” হাইকু অভিযাত্রা” এবং ২০২৩ সালে ৩য় কাব্যগ্রন্থ “এক পেয়ালা হাইকু” প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য তিনটি বই রচয়িতা প্রকাশনার ব্যানারে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও দেশের প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর হাইকু প্রকাশিত হচ্ছে। ৪র্থ কাব্যগ্রন্থ “কারাকুলের মেষ” প্রকাশ হবার অপেক্ষায়। কবি টিটো মোস্তাফিজ শুধু বাংলা নয় হাইকু রচনা করছেন ইংরেজি ভাষাতেও। বিখ্যাত All Poetry ওয়েবসাইটে তার ইংরেজি ভাষায় রচিত হাইকু প্রকাশিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেগুলো সগৌরবে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নিচ্ছে।
তাঁর হাইকু-র সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য শব্দের কারুকার্যতা। মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে প্রাধান্য না দিয়ে তিনি মূলভাবের দিকে বেশি মনোযোগী। এ ছাড়াও ঋতু বৈচিত্র্য, নিত্য জীবনের অভিজ্ঞতা, হৃদয় কোণে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত অনুভূতি, প্রেম ভালোবাসা, সংসার জীবন — এ সবই তার হাইকুর অনন্য বৈশিষ্ট্য। যেমন—
“নিজেরই মাঝে
ভেঙে পড়ে নক্ষত্র-
ছাই-চাপা আগুন”
“আষাঢ়ে শুভ্র মেঘ-
রংধনু রং ঝকমকায়
কাঁচপোকার পিঠে”
“হায় প্রাকৃতজন
মাঠে খাটে দিনরাত-
গ্রান্ড সুলতান”
শব্দ বাছাই এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি খুব সচেতন। নিজের লেখাকে অনন্য বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট করতে চালিয়ে যান নিরন্তর প্রচেষ্টা। তার বিশ্বাস বাংলা সাহিত্যে হাইকু চর্চা একসময় দারুণ জনপ্রিয় হবে। এছাড়া পাঠ্য পুস্তকে হাইকু অন্তর্ভুক্ত করলে “হাইকু সাহিত্য আন্দোলন” সফল হবে বলে তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করেন।
মূলত হাইকু অনেকটা পরমাণু বোমার মতো। আকারে ছোট হলেও এর শক্তি অনেক। উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করে হাইকু রচনা করলে তার মর্মার্থ একটি কাব্য সাহিত্যে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম। বাংলা সাহিত্যে এই হাইকু চর্চায় টিটো মোস্তাফিজ একজন প্রথম শ্রেণির কবি হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁর শব্দের অলংকার তাঁর হাইকুকে পৌঁছে দিচ্ছে অন্য মাত্রায়।
“তাক করো টিমটিমে
ধরে আনো ঘুঘু-
এরই নাম হাইকু”
*রুশিয়া জামান রত্না- উপজেলা সমাজসেবা কর্মকতা, মানিকগঞ্জ সদর।