কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

কাটাকুটি- রাজিয়া নাজমী- গল্প                                                        

বলতে অস্বস্তি লাগলেও বলাটাই দরকার মনে করে আবিদ বলেই ফেলল, তরুণ বাবু অনেক রাত হয়েছে এবার মনে হয় আপনার বাড়ি যাওয়া উচিত।

তরুণ গলায় আরেক ঢোক ঢেলে দিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে বলে, বাড়ি! মশাই বাড়ি মানে কী জানেন? আবিদ তরুণের কথার অর্থ ধরতে না পেরেও তরুণের দিকে তাকালো না। লোকটা এখন চলে যাক সেটাই চাইছ সে।

তরুণ আবিদের কথায় আবার ফিরে এলো। বাড়ি বলতে কি বোঝায় সেই ডেফিনেশন না দিয়ে যায় কি করে। সোফায় আরো গা এলিয়ে দিয়ে বলল, বাড়ি কি জানেন? বাড়ি হচ্ছে একে অপরের সাথে আত্মার সম্পর্কে বাঁধা পরিবার। একগাদা কাঠ, রড সিমেন্ট দিয়ে একটা বাক্স বানিয়ে তার মধ্যে আসবাব পত্র, হাঁড়ি কুড়ি থাকলেই সেটা বাড়ি হয় না। আপনার কথা জানি না, তবে আমার যেটা আছে তা থাকার জন্য একটা বাসস্থান। রাত হচ্ছে বলে ভাবার কেউ নেই, দরজা খোলার জন্য কেউ নেই,খাবারের থালা সামনে নিয়ে অপেক্ষা করে থাকার নেই। একটানা বলে একটু দম নিয়ে সিগারেটের শেষ প্রান্তটুকু চেপে ধরে হিসহিস শব্দ তুলে সুখটানটা দিয়ে বলল, মশাই অভিমান করে বিছানায় পাশ ফিরে থাকার জন্য যেখানে কেউ নেই তার নাম নাকি বাড়ি!

আবিদের ইচ্ছে হল বলতে, তেমন বাড়ি বানাতে যা দরকার তা কী ছিল আপনার কাছে ছিলো? কিন্তু ইচ্ছে হল না বলতে। বাড়ি বানাবার ইচ্ছে থাকলেই পারা যায় না কথাটা মিথ্যে তো নয়।

হাতের মুঠোয় সেলফোন বেজেই চলেছে। না তাকালেও জানে অঞ্চিতার ফোন।

তরুণ একবার বলল, ধরছেন না কেন? ধরুন!

আবিদ বলল, অসুবিধা নেই পরে কলব্যাক করব। তরুণের চোখে মুখে মলিন হাসি মিথ্যে বলতে বাধ্য করে। নিশ্চুপ বোতাম চেপে দিয়ে সেলফোন সাইডটেবিলে রেখে দিয়ে বলে, আমার এক কলিগের ফোন ছিলো।

তরুণ আবারও বলে,ধরলেই পারতেন। আমার তেমন তাড়া নেই। আবিদ চমকে উঠলো। এর মানে কী? কতক্ষণ থাকার নিয়ত করে এসেছে এই মাতাল? ভেবেই মনে হল, নাহ, হাজার হলেও অঞ্চিতার স্বামী। একে তো বার বার ফোন কেটে দিয়ে খারাপই লাগছে। অঞ্চিতাকে অপমানিত করতে চাইছে না তবু কেমন বাঁধোবাঁধো লাগছিল তরুনের সামনে অঞ্চিতার ফোন ধরতে।

তরুণ আজই প্রথম এসেছে আবিদের কাছে। এসেছে সেই সন্ধে নাগাত।

আবিদ অবাক হয়েছিল অপরিচিত একজনকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। লোকটি কোন ভূমিকা না করেই বলে, আমার নাম তরুণ, আমি অঞ্চিতার স্বামী। ভিতরে আসতে চাই। আপনার সাথে কিছু কথা বলার আছে।

আবিদ দরজার একপাশে সরে দাঁড়াতেই তরুণ হাতের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলে, অসুবিধা নেই তো একে ঘরে নিয়ে ঢুকলে? আবিদ মাথা নাড়তেই তরুণ হেসে উঠলো, বাঁচালেন মশাই, নয়ত কতবার যে ঘর-বাহির করতে হত কে জানে। আমার একে ছাড়া একদম চলে না। অবশ্য আর একজন আছে।

আবিদ বুঝতে পারলো কিছু না বলাই ভাল। পরিচিত কাউকেই তাদের কোন অভ্যাসের বাড়াবাড়ি নিয়ে লেকচার সে কখনই দেয় না আর এতো কোথাকার কোন তরুণ কুমার।

তরুণ ততক্ষণে লিভিং রুমের সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে গেঁড়ে বসে গেছে। আবিদ জানে একে এখন চা কফির কথা বলার মানে বলার জন্যই বলা।  রান্না ঘরে রাতের ভাত বসিয়ে এসেছে, এখনি নামাতে হবে তাই রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে  বলল, আপনাকে  পানি বা অন্য কিছু দেব?

তরুণ লিভিং রুমের চার পাশ দেখতে দেখতে বলল, আরে না কিছুর দরকার নেই, যা দরকার তা সংগে করে নিয়ে এসেছি। আপনি আবার কিছু মনে করবেন না যেন।

রান্নাঘর থেকে এসে আবিদ বলল, তরুণ বাবু আপনি আমার বাড়ি খুঁজে পেলেন কি করে?

দেয়ালের একটি পেইন্টিঙের সামনে দাড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে খুব আস্তে করে বলল,অঞ্চিতাকে একদিন ফলো করেছিলাম। তারপরই বলল, এই ছবিটি কার আঁকা বলুন তো, সাক্ষরটা খুব অস্পষ্ট হয়ে গেছে।  ছবি আকাঁর ধরনটা…। আবিদ সাহেব আপনি ছবি আঁকেন নাকি?

না, আপনি?

আঁকতাম একসময়। বহুদিন ধরে হয়নি।  মাথায় ঠিক আসে না কিছু। না ঠিক বললাম না। আসে তবে ইচ্ছে হয় না। যা আসে তা আঁকতে গেলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আঁকা আর হয় না।

আপনি বোধ হয় কিছু বলতে এসেছিলেন আমাকে। আবিদ সিগারেটের ছাই ফেলার জন্য আনা চায়ের কাপ তরুণের সামনে রাখতে রাখতে বলল।

আবিদ সাহেব, আপনার কি খুব তাড়া আছে? না থাকলে আমি বসি কিচ্ছুক্ষণ?  কী জানেন আপনার এই বসবার ঘরটি কেমন চেনা চেনা লাগছে। তরুণ গুন গুনিয়ে উঠলো ‘কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম‘…

জন ডেনভারের এই  গানের কথায়  নীরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে।

আবিদ টিভি অন করল বটে তবে শব্দ নামিয়ে। হাতের কাছে রাখা গত সপ্তাহের ম্যাগাজিনটা টেনে নিলো আপাতত সময় পার করার ভরসায়।

বেশ কয়েকটা সিগারেট আর মিনি সাইজের তিনটা  হুইস্কির শিশি শেষ করে তরুণ উঠে দাঁড়িয়ে আবিদের ঘাড়ে হাত রেখে বললো, আজ উঠি। আপনার ঘরটা বেশ ভাল, আসব আমি আবার,কথা দিচ্ছি; আসব। শুভরাত্রি! ও হ্যাঁ আপনার সেই কলিগকে কলব্যাক করতে ভুলবেন না।

তরুণ চলে যেতেই আবিদ সিগারেটের ছাই ভরা চায়ের কাপ আর শিশিগুলো তুলে নিয়ে ট্র্যাশক্যানে ফেলে রাতের খাবার ফ্রিজে তুলে রাখলো। এত রাত করে খেলেই পেটে অস্বস্তি হয়। এই তরুণটা যদি এমন প্রায়ই এসে হাজির হয় তবেই হয়েছে। অঞ্চিতাকে সে বলবে? নাহ, বরং দেখা যাক তরুণ নিজেই অঞ্চিতাকে বলে কিনা।

                                                              

দুই

মাঝে মাঝে অঞ্চিতা পুরো বিছানার সবটাই ছেড়ে একদম এক প্রান্তে যতটুকু কম জায়গা নিয়ে শুয়ে থাকা যায় তাই থাকে। কেন করে সে? যত কম নিয়ে থাকা যায় তাই? খুব বেশি তো চায়নি সে তবুও জীবনের সব কিছু এক ধরনের হিসেবের মধ্যে চলে। হিসেবের খাতার মত এও অদল বদল হয় তাই জীবনের চাওয়া পাওয়া বা জীবনের চাহিদা অন্য খাতে ঘুরে গেলে ভালোবাসা তারই সাথে তাল মিলিয়ে চলে। নাহলে যার চোখ  ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালবাসার সুবাতাস  ছড়িয়ে দিত আজ সে চোখে সবসময় বিরক্তির হল্কা বয়ে যায়। কত তাড়াতাড়ি বদলে যায় সব আবেগ। ভালবাসাও চিরন্তন নয় তবে তা এতটাই ক্ষণস্থায়ী?

কিছুদিন আগে ওর কষ্ট হত, মনে হত ও কেন এখন ভালবাসে? এখন আর তাও মনে হয়  না।  দিনে দিনে সব অনুভূতিগুলো যেন বাতাসে উড়ে উড়ে মিলিয়ে গেছে কোন অজানা অন্ধকারে যেখান থেকে সেই সব নরম অনুভূতিগুলোকে আর ফেরানো যাবে না। সত্যি কি তাই? ফেরানো  কী যায় না? নাকি ফিরলেও ফিরবে কিছু কালো দাগ নিয়ে। সেই দাগগুলোতে দুঃখের, অপমানের, অবহেলার কালো কালো ছাপ আর সেগুলো গায়ে মেখে তার ভার বহন করে যাপিত জীবনের অভ্যাসের কারণে চলা আর বলা, ব্যাস এর বাইরে আর কিছুই না।

মেনেই তো  নিয়েছিলো পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসে এসে এই পরিবর্তন।  সত্যি কি ভয়ঙ্কর এক বেদনার মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে বের করে আনতে পেরেছে। তাই আজ কারো বিষবাক্যে অপমানিত বোধ করে না। জীবনের সব ভুলকে মেনে নিতে হয়েছে। ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে, ভুল মানুষকে বিয়ে করেছে। ভুল আর ভুল। তবে ভুল করে কি ভুল করেছিল? নাকি ভুল করাটাই ভবিতব্য ছিল? নয়ত কি করে সম্ভব হলো? হুট করে কী প্রেমে পড়ে গেলো? না প্রেমে হুট করে না পড়লেও রাস্তায় সেদিন হুট করে হোঁচট খেয়ে পরতেই একটা শক্ত হাত তাকে ধরে, গাড় কণ্ঠে বলেছিল আপনি ঠিক আছেন?

স্বাভাবিক লজ্জায় অঞ্চিতা আস্তে করে বলে, না না তেমন কিছু হয়নি। কেন যেন ব্যাল্যান্স হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আপনি তো এদিকেই থাকেন, আমি কি আপনার বাড়ি অবধি যেতে পারি?

আপনি, আপনি কি করে জানেন আমি এদিকে থাকি?

আমি দেখেছি আপনাকে এর আগে।

সেদিন বাড়ি অবধি বাকি পথে কী কথা বলে বলেছিলো মনে নেই সবটা, তবে সেই বিকেলটা খুব ভাললেগেছিল। অনেকদিনের শুষ্ক জীবনে যেন হাল্কা বাতাস বয়ে। অল্প পথটুকুতে ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ির গেটে এসে  মন বলছিলো বলে, ভেতরে আসবেন। অঞ্চিতা গেটের খিড়কীকে হাত রাখতেই লোকটি বলল, যাই এবার। আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করবেন।

অঞ্চিতা বিদায় নিয়ে গেট খুলে বাড়ির ভিতরের রাস্তায় পা বাড়ালো। অর্ধেক রাস্তায় এসে যে কাজ সে কখন করেনি তাই করল, ফিরে তাকালো আর একবার অচেনা লোকটিকে দেখার জন্য। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখলো গেটের মাথা থেকে কয়েক পা এগিয়ে শুখনো পাতলা দীর্ঘকায় লোকটিও ফিরে তাকিয়ে আছে।

অঞ্চিতা এক মুহূর্ত ভাবল তারপর পায়ে পায়ে আবার গেটের দিকে আগালো। গেট খুলে কাছে যেতেই লোকটি খুব উষ্ণ গলায় বলল আমি কি আপনার সাথে কথা…

অঞ্চিতা কিছু না বলেই ওর সেলফোনের নাম্বারটা দিয়ে বলল, এটা আমার নাম্বার। লোকটি চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই অঞ্চিতা বলল নামটা…

আবিদ। আমি কাছেই থাকি। আপনাকে কখন ফোন করলে ভালো হয়?

সন্ধ্যার পরে।

ফোনটা করতে আবিদ একদমই দেরি করেনি, পরের দিন অচেনা নাম্বার বেজে উঠলো ঠিক সন্ধ্যে সাতটার সময়।

আবিদ বলছিলাম। আপনি এখন কি ব্যস্ত?

না, হাতে তেমন কোন কাজ নেই এখন।

কি করছিলেন?

গান শুনছিলাম। কেমন আছেন? কাল আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। সেজন্য পরে আমার খুব খারাপ লেগেছে।

তাই? কখন কখন এধরনের খারাপ লাগা অন্যের জন্য ভাল।

তারপর প্রায় প্রতিদিন আবিদের ফোন। আপনি থেকে তুমিতে এসে গেছে নিজেদের অজান্তেই।

কি করে কেমন করে ওরা মনের এত কাছাকাছি চলে এলো জানে না। শুধু  ভীষণ ভালো লাগত আবিদের সাথে কথা বলতে। এত কথা, এত আবেগ ও আর কারো সাথে চেষ্টা করেও পারেনি।

নিয়মে বাধাঁ সম্পর্কে মনের আবেগের দাম দিয়েছে? অথচ অনৈতিকতার বেদবাক্য ঝড়ে পড়ছে চারদিকে। অপরাধ করছে যাকে ভাললাগে তাঁকে ভালোবেসে। কেন সে মনে রাখেনি এতে সিঁদুরের অপমান হবে। অথচ কেউ যে জানতে চায়নি সে সিঁদুর স্বেচ্ছায় পরেছিল কিনা? যখন সে পুরোহিতের মন্ত্রের সাথে সাথে নিয়মমতো ঘুরেছে সাতপাকে। কেউ কি জানতে চেয়েছিল ও মন্ত্র পড়ছে কিনা? কেউ কি জানতে চেয়েছিল ও মন আর শরীর এক করে হাঁটছিল কিনা? ওর দুহাত ধরে অন্যরা যখন মালাবদল  করালো তখন কেউ জানতে চেয়েছিল ওর মন করেছিল কিনা? আজ যখন ওকে শুনতে হলে ‘ তাও আবার একজন ভিন্ন ধর্মের সাথেই কেন? তখন ইচ্ছে হচ্ছিল বলতে স্বধর্মের হলে অনৈতিক হত না? কিন্তু কী হবে বলে। অঞ্চিতার কোন গ্লানি নেই যেখানে।  ইচ্ছে হচ্ছিল তার এত বছরের স্বামীর কাছে  জানতে, আমাকে তুমি কোনদিন ভালোবাসনি ভালোবাসা চাওনি। আমার কাছে শুধু চেয়েছিল আমি তোমার পরিচয় থেকে সব পালন করি। আমি তাই করে গেছি। আমাদের কখন কোন কিছু নিয়ে মান অভিমান ঝগড়া হয়নি। তবে আজ কেন তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোলাগাকে এভাবে নষ্ট করে দিতে ছুটে গেলে।

আর আবিদ তুমি? ভালো যদি বাসবে তবে অপমান কেন মেনে নিতে পারলে না। অন্যের অপমানের দায় আমায় কেন দিলে? কী ভীষণ রুঢ় শোনায় তোমার কণ্ঠস্বর আজকাল। কি অবলীলায় বলে দিল আর এসো না আর ফোন কর না।

উফ, নিজের চিৎকারেই অঞ্চিতার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আবিদকে এতবার ফোনে না পেয়ে এলোমেলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল। অঞ্চিতার কেন মনে হচ্ছে তরুণ আজ না হয় কাল আবিদের সাথে দেখা করতে যাবেই তাই আগাম বলে রাখতে চেয়েছিল আবিদকে। তরুণ অসভ্যতামি করবে না জানে তবুও। কিন্তু এসব কী স্বপ্ন দেখলো সে। তরুণের কাছে কী সত্যি সে ভালাবাসা চেয়েছিল? চেয়েছিল তরুণ অন্য অনেক স্বামীর মত জেলাস হয়ে আবিদকে কিছু বলুক?

লাইট অফ করে শুয়ে পড়ার কথা ভাবতেই দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পেলো অঞ্চিতা। তরুণ ফিরেছে। জিজ্ঞাসা করবে তরুণ গিয়েছিল কিনা? মুহূর্তে অঞ্চিতা ভেবে নিলো সে তরুণ বা আবিদ কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না। দেখা যাক কে বলে তাকে।

 

তিন

তরুণ আবিদের বাড়ি থেকে যখন বের হয়ে এলো তখন রাত বারোটা বাজে। কাছে পিঠের পাবে গিয়ে আরো খানিকটা সময় কাটানো যেত। তবু কেন অঞ্চিতার কাছেই ফিরে আসতে ইচ্ছে করলো। অল্পই পথ তবু ট্যাক্সি ধরেই ফিরে এলো। আবিদ কেন অঞ্চিতার ফোন ধরলো না। তরুণ তো ভেবেছিল আবিদ অঞ্চিতাকে ভালোবাসে। অঞ্চিতা কতবার ফোন করল। বেচারি! সেই থেকে কেমন একটা কষ্ট কষ্ট লাগছে তরুণের।

আবিদকে যা বলতে চেয়েছিল তা বলার যোগ্যই ওকে আর মনে হল না। আবিদ ধরেই নিয়েছিল তরুণ মাতাল হয়ে সব ভুলে গেছে। তরুণ হাসলো! তবে এবার সে যাবে অন্য কথা বলার জন্য। অঞ্চিতাকে যে আবিদ ভালোবাসে না সেটাই বলার জন্য। খুব মায়া হল অঞ্চিতার জন্য। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কি পাগল মেয়েটা। কিন্তু পেলে না।

বিয়ের পরপর তরুণ ভালবাসতে চেয়েছিল। ভাল একদম লাগত না তাও নয় তবে সেই ভালোলাগাটা আরও গভীর না হয়ে দিনে দিনে কেমন পানসে হয়ে গেলো। কার দিকে থেকে শুরু হল কে জানে। হয়ত তার দিকে থেকেই আগে হয়েছে। অঞ্চিতাও আঁকড়ে ধরে, জোর করে বেঁধে রাখতে চায়নি আলগা হতে থাকা বাঁধনকে।

মন্ত্র পড়া বাঁধনের জোর মনের বাঁধনের কাছে অনেক কমজোরি সেটাই প্রমাণ হয় গেলো।

অঞ্চিতাকে সেদিন এত আঘাত করে যা বলেছিল তাও অঞ্চিতার ভালোর জন্য। অঞ্চিতা যদি তরুণকে ঘৃণা করে চলে যায় তবেই হয়ত আবিদের সাথে ও ভাল থাকতে পারবে নয়ত তরুণের কী আসে যায় কে কোন ধর্মের। তরুণ কী কোনকালেই ধর্মে বিশ্বাস করতো? কিন্তু এখন তরুণ কি করবে? অঞ্চিতা যে জানে না ও আবার ভুল করতে যাচ্ছে।

চাবিটা ঘুড়িয়ে ঘরে ঢুকেই  বুঝতে পারলো অঞ্চিতা তখনও জেগে আছে তবে তার জন্য অপেক্ষা করে নয়। আবিদ যদি ওকে ওর যাওয়ার কথা জানিয়ে থাকে তবে অঞ্চিতা হয় লিভিংরুমে ওকে প্রশ্ন করার জন্য বসে থাকত অথবা হু কেয়ারস ভাব দেখিয়ে ঘুমিয়ে যেত। এর মাঝামাঝি কিছু করার মেয়ে অঞ্চিতা নয়।

বেডরুমটা এখন আলাদা হয়নি তাই সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে গিয়ে তরুণের মনে হল একটা কাজ অন্তত সে ঠিক করেছিল। একটা কিং সাইজের বেড কিনেছিল। কেনার সময় অঞ্চিতা হেসে বলেছিলে দুইজনেই ফিটফাট স্লিম, এত বিশাল বিছানা কেন? তরুণের কখন দুষ্টামি আসে না তাই সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে দিল,আমার হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাতে ভাল লাগে। বড় বিছানা না হলে তোমার গায়ে অকারণেই আমার হাত পা লেগে যেতে পারে। বলেই মনে হল অঞ্চিতা কথাটা শুনতে পায়নি। ও তখন ব্যস্ত ছিলে ম্যাচিং আলমিরা দেখতে। এ সবই বিয়ের শুরুতে। বিয়ের পরপর বোধ হয় সবাই কদিন ভাল থাকে। মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করার শপথ যতদিন মাথায় থাকে।

তরুণ পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে  শোবার ঘরে এলো। কটকটে লাইটের আলো থেকে বাঁচাবার জন্য চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে পড়লো। অঞ্চিতা কিছু একটা পড়ছিল। একটু পরেই বইটা বালিশের নিচে রেখে লাইট অফ করে দিল। তরুণ এবার নিশ্চিত আবিদ এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি।

                                               

চার    

আচ্ছা আবিদ সাহেব

সাহেবটা বাদ দিয়ে বলুন।

কেন?

কারণ আমি সাহেব নই, তাই

আচ্ছা,তবে আমিও শুধু তরুণ। বাবু নই।

ঠিক আছে,আমি এই অপেক্ষাতেই ছিলাম। এই বাবু, সাহেব, আমাদের অধীনস্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে যাই হোক তরুণ, আজ আপনি কিছু বলতে সুরু করেছিলেন। আমি শুনতে চাই।

আপনার ফোনটা কোথায়?

কেন বলুনতো?

নাহ, এ সময় ফোন আসার কথা তাই।

তরুণ, আপনি যদি জানেন এ সময় ফোন আসার কথা তবে এ সময়ে কেন আসেন? আপনি কি আমার ফোন এলো কিনা তাই দেখতে আসেন।

আবিদ, একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে ও কেন সিঁদুর পরে। জানেন হিন্দু স্ত্রী কেন  সিঁদুর পরে?

জানি, স্বামীর মঙ্গল কামনায়। তাতে অসুবিধা কোথায়?

হ্যাঁ তবে আমার জন্য সিঁদুর কেন… আমরা কী সত্যি বিবাহিত? মনে যে নাই, মাথায় সে কী করে থাকে!

এ কথাটি আপনি ওকে জিজ্ঞাসা করেছেন? যদিও উত্তর আমি জানি কিন্তু আমি আপনাকে তা বলব না। এর উত্তর আপনাকেই জেনে নিতে হবে।

আবিদ আপনার খারাপ লাগে না? এক মাথা সিঁদুর পরে যখন আপনার কাছে আসে?

না, লাগে না কারণ উত্তর আমার জানা। আপনার চেয়ে আমি অনেক বেশি জানি ওকে।

রাগাতে চাইছেন!

না রাগাতে চাইছি না। কারণ জানি আপনার কোন রাগ নেই।

তা বেশ আমাকে নিয়ে আপনাদের মধ্যে কথা হয় তবে। আবিদ, আপনি বিবাহিত?

হ্যাঁ

অঞ্চিতা জানে?

না জানার কোন কারণ তো নেই।

আর আপনার স্ত্রী?

উত্তরটা আজ দেবো না। আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আজ আপনি আসুন।

কাল আসব?

না ছুটির দিনে,

অহ; সে তো কাল বাদে পরশু। বেশ যাই আজ।

 

পাঁচ

তরুণ বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই আবিদের বাড়ির ডোর বেল চেপে দিলো। আজ প্রথম তরুণকে বেশ অন্য রকম লাগছে। মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে আগুন নিভিয়ে তবে ঘরে ঢুকল। যেন আজ নিমন্ত্রিত বলেই এইটুকু ভদ্রতা।

তরুণ, চলুন অ্যাটিকে যাই। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন সেখানে।

আবিদের পিছে পিছে তরুণ সরু সিঁড়ি বেয়ে অ্যাটিকে পা দিয়ে বিস্ময়ে থমকে গেলো। অ্যাটিকের চারদিকে ছড়িয়ে আছে রঙ তুলি, ক্যানভাস। মেঝেতে অসমাপ্ত আঁকা ছবি, কাটাকুটি ছবি। যেন ঝড় বয়ে গেছে শিল্পীর মনে। কিসের এত যন্ত্রণা ছিল শিল্পীর মনে?

তরুণের বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটার শব্দ বেড়ে চলছে। এত চেনা কেন লাগছে তুলির আঁচড়গুলো?

ধুলোমাখা একটি ফটোফ্রেমের গায়ে হাত বুলিয়ে পরিষ্কার করে তরুণের সামনে ধরে আবিদ বলে, আমার স্ত্রী। ওরই আকা সব ছবি।

বুকের ভিতর হাতুড়ি আরো জোরে জোরে পেরেকের পর পেরেক ঠুকে দিচ্ছে। আজ কী বেশি খেয়ে ফেলেছে, ভুলভাল দেখছে না তো সে? সে তো মাতাল হয় না। কী ভাবছে সে, দিনের বেলায় সে তো এক চুমুক দেয় না। একফোঁটাও খায়নি এখনও। মাথাটা এমন ঘুরছে কেন তবে!

নাকের উপরে তুলে ধরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে  তরুণ বলল, উনি কোথায়, উনি  কী…

আবিদ ছবিটি নামিয়ে রেখে বলল, নার্সিংহোমে আছে গত পাঁচ বছর ধরে। ঘুমের ভিতর স্ট্রোক করেছিল। বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে আছে। সেই থেকে ঘুমের মধ্যেই থাকে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে। চিনতে পারলেও  কথা বলতে পারে না।

অঞ্চিতা?

হ্যাঁ, অঞ্চিতা জানে। অঞ্চিতা গিয়েছিল ওকে দেখতে।

আবিদ, আমি কি একবার যেতে পারি ওকে দেখতে? একজন শিল্পী বলেই…

তরুণ, এমন করে বলছেন কেন? নাসিংহোমের কার্ড রাখা আছে কিচেনে। যাবার আগে নিয়ে যেতে পারেন। আমি আজই ফোন করে ওদের আপনার নাম জানিয়ে দেব।

আবিদকে অবাক করে দিয়েই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তরুণ বলল, আজ যাই। এত তাড়াতাড়ি তরুণ বোধহয় এই প্রথম আবিদের বাড়ি থেকে চলে এলো। বুকের ধুক ধুঁকনি থেকে মুক্তি পেতে খোলা বাতাস দরকার তার এখন। বাসস্টপে দাড়িয়ে থেকেও বাসে ওঠেনি। বাস এসে থেমেছে, দরজা খুলেছে আবার বন্ধ করে চলে গেছে। তরুণ ঠায় দাড়িয়ে ছিলে যেন কেউ এসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে।

বুকের ভিতরের হাতুড়ির পেটা থেমে গেলেও অস্থিরতা কাটেনি। ভগবান মানা সে ছেড়ে দিয়েছে কবেই তাই যে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলেও, করতে পারছে না।

 

 ছয়

তরুণ অস্থিরতায় নির্ঘুম রাত পার করে সকালেই বের হয়ে নার্সিংহোমের সামনেই বসে থাকলো। হোমের অফিস খুলতেই ডেস্কের সামনে গিয়ে নাম বলতেই মেয়েটি রুম নাম্বার বলে দিয়ে বলে, সোজা গিয়ে বাঁদিকের রুম।

আমি যাবো এখন?

মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, আপনি দেখা করতে এসেছেন না?

হ্যাঁ আমি ওকে দেখতে এসেছি।

মেয়েটি তরুণের অস্থিরতা বুঝতে পেরেই বলে, কেউ আসলে খুশি হয়।

তরুণ করিডোরের শেষপ্রান্তে এসে বা হাত মুঠি করে রুমের সামনে দাঁড়ালো। নার্সের বলা কথাটা কানে বাজছে- খুশি হয়!

দরজা ঠেলে ঢুকে তরুণ বুক পকেট থেকে চশমা বের করে রুম নাম্বারটা দেখে নিলো। ভুল করলো না তো।

এ কে শুয়ে আছে? একরাশ সাদা কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে। শুয়ে থাকার কারণেই কী শরীরটা এমন বেঁকে গেছে?  এতকাল ধরে চোখের সামনে ভেসে আসে যে তার সাথে এর যে আর কোন মিল নেই। দুইযুগ পরে এ কাকে দেখলো সে! তরুণ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই শুঁকনো হাতের ছোঁয়া পেলো।

করুন দুটি চোখ তাকিয়ে আছে, খুশির ঝলকে কেঁপে ওঠা চোখ কোথায়? ইচ্ছে হল বলতে চিনতে পেরেছ, আমি তরুণ। তোমার তরুণ। সাহস হলো না বলতে। হৃদপিণ্ডে কতটুকু দম আছে কে জানে। থাক না হয় আর কিছুদিন বেঁচে।

চিলেকোঠায় বসে ছবি আঁকতে আঁকতে রাত ভোর করে দিত যে মানুষ, সেই আজ এমন করে এখানে? তরুণের এটাও তার দেখার বাকি ছিলো

চোখের পাতায় সব সময় যেন অভিমানের জল জমিয়ে রাখত, একটু অভিমান হলেই ঢেলে দিত দুগালে। সেই মানুষটি কোন অভিমানে শুধু বেঁচেই আছে এমন করে! শুখনো চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, একটু কাঁদো সেই আগের মত আমার দেরি করে আসার জন্য।

 

দুইযুগ আগে ধর্মের দ্বন্ধের সাথে পেরে না উঠে বোকার মত ওরা পালাতে চেয়েছিল দুরে কোথাও।

ট্রেনে উঠে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ সামলাতে গিয়ে তরুণ দেরি করে ফেলেছিল পালাবার সাথীর হাত ধরে ট্রেনের বগিতে তুলতে। পায়ে পেঁচিয়ে যাওয়া শাড়ি ছাড়বার সময়টুকুতেই যা না হবার কথা তাই হল।

পিছন থেকে দুইভাই বোনের হাত ধরে টেনে নিয়ে অন্য আরেকটি ট্রেনে হিঁচড়ে টেনে তুলল।

তরুণ ট্রেনের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ধর্মের খেলা দেখলো। ওরা পাশাপাশি দুইটি ট্রেনে একই জায়গা থেকে আলাদা আলাদা গন্তব্য চলে গেল।

তরুণ কথা বলার সাহস সঞ্চার করে ফিসফিস করে বলল, খোঁজ করেছিলাম আমি। মাস পরে জানতে পারলাম তুমি বাধ্য হয়েছ অন্য কারো ঘরের হতে।

ধর্মই ছিলো আমার আমার একমাত্র পরিচয়, আমার সেই অযোগ্যতায় সেদিন ট্রেনেও তোমাকে তুলতে পারলাম না।

তরুণ শুকনো জিরজিরে হাতের উপর থেকে মাথা তুলতে বাধ্য হল অসময় বিরক্ত করা জুতোর খসে খসে আওয়াজে।

নার্স এসে বলল, আপনি আজ গেলে ভাল হয়।

তরুণ সাদা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলল, আমি আবার আসবো অবশ পা টেনে নিয়ে যেতে যেতে তরুণ ভাবলো আজ একটা ছবি আঁকবে। মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটি মুখের ছবি আজ আঁকবে।

                                            

সাত

তরুণ,  তরুণ,

ডাকটা যে  আবিদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি তবু ইচ্ছে করেই না শোনার ভান করে তরুণ যেমন চলছিলো তেমনই হেঁটে

চলল আবিদের হাতটা ঘাড়ের উপর এসে না পরা পর্যন্ত।

ওহ আপনি!

আরে মশাই সেই থেকে ডাকছি আপনাকে। কি ব্যাপার বলুনতো, একেবারে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন নাকি? কতমাস হয়ে গেলো আপনার দেখা নেই।

না না তা কেন, তা একবারেই নয় তবে একটু বিরতি দিচ্ছিলাম আমাকেও আপনাকেও। কেমন আছেন আবিদ?

তরুণ, আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। চলুন কফি সপে বসি।

তরুণ আন্দাজ করতে পারলেও একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমার সাথে? চলুন চলুন বসা যাক।

আবিদ দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে এসে বসতে বসতেই বলল, আমি বেশ লম্বা সময়ের জন্য আফ্রিকাতে চলে যাচ্ছি। ভাল অফার পেলাম তাই ছাড়লাম না।

তরুণ কফিতে চিনি নাড়তে নাড়তে অলস ভাবেই বলল, নিউইয়র্ক থেকে সুদূর আফ্রিকা, ভাল বেশ ভাল, ভাল কিছু ছাড়া যায় না। কিন্তু আপনার একজন যে পড়ে আছে নার্সিংহোমে।

সেই সবই আপনার সাথে আলাপ করব। আপনি জানেন কিনা জানিনা, অঞ্চিতা আমার সাথে যাচ্ছে না, বলতে গেলে আমাদের বন্ধুত্বটা আগের মত নেই। আমার মনে হয় ও আপনার কাছেই ফিরে গেলে ভাল।

তরুণ মনে মনে ভাবল, কি সহজে বলা যায় যা একবারেই সহজে বলার নয়। ইচ্ছে হল অট্টহাসি দিয়ে আবিদের চারপাশের সবার মুখটাকে কিচ্ছুক্ষণের জন্য বোকা বোকা করে দিতে। শুধু বলল, সে ভাবনাটা আমাদের আপনার নয়। আপনি আপনার কথা ভাবুন।

আবিদের কফির কাপটা একেবারে ঠোঁটের কাছে ছিল। তরুণের কথায় কাপটা ঝাঁকি খেয়ে দুই এক ফোঁটা পড়ে যেতেই আবিদ টিসু পেপার দিয়ে সামলে নিলো।

তরুণ খুব ধীরে কফির কাপে চুমুক দিয়ে কাল বিকেলে অঞ্চিতার বলা কথাগুলো ভাবল। অঞ্চিতা দেশে ফিরে যাচ্ছে। একেবারেই যাচ্ছে। তরুণ জানতে চায়নি অঞ্চিতার  সিদ্ধান্তের কারণ। অঞ্চিতা নিজ থেকেই বলল, জানি কিছু জানতে চাইবে না তবু বলছি, আবিদকে আমি পছন্দ করতাম, আজও করি। তবুও পারলাম না অথবা যা আমি চাই তা ওর কাছ থেকে চাই না।

কি চেয়েছিলে তা জানতে?

জানতাম, তবে তুমি জানতে না বা জানতে চাওনি। একটা মেয়ে যখন সিঁদুর পরে তখন সে সিঁদুরের অর্থ শুধু সে বিবাহিত তাই নয়। সিঁদুরের অর্থ সম্মান, ভালবাসা, নির্ভরতা, ভরসা। মাঝে মাঝে মনে হত হয়ত আমাদের কোন সন্তান নেই বলেই… কিন্তু এটাও কারণ মনে হয়নি।

অঞ্চিতার গলায় সামান্য কান্নার কাঁপন ছিল। হয়ত মা না হতে পারার কষ্টের কান্না। এরপর কিছুক্ষণ চুপ ছিল অঞ্চিতা। হয়ত ভেবেছিল তরুণ কিছু বলবে অথবা হঠাত আশা আবেগকে দমন করার জন্য চুপ ছিল। খুব অল্প সময়ে  চুপ ছিল অঞ্চিতা। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, তুমি চাইলে ডিভোর্স ফাইল করতে পার। আমি সই কর দিব।

আবিদ এতক্ষণ ধরে কী বলছিল কে জানে, হঠাত করেই আবিদের একটি লাইন কানে যেতেই অঞ্চিতার বলা বাকি কথাগুলো সরে গেলো। আবিদ রীতিমত তরুণের হাত ধরে বলছে, তরুণ আমার হয়ে আপনাকে এই কাজটা করতেই হবে। নার্সিংহোমে ওকে দেখতে যাবেন। টাকা পয়সা সব আমি পাঠাব, শুধু খেয়াল রাখবেন প্লিজ। আবিদ কিছুটা গ্লানি মাখা মুখেই বলল, প্রথম প্রথম রোজ যেতাম তারপর আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। বুঝতেই পারছেন পাঁচ বছর এক লম্বা সময়। তরুণ হাত তুলে আবিদকে কঠিন বাস্তবের দর্শন দেওয়া থেকে মুক্তি দিলো।

আবিদ তরুণের তোলা হাতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে উঠে গেলো আরেক কাপ কফি আনতে। আবিদকে খুব অস্থির লাগছে আজ। কী জানি আবিদও হয়ত এক শূন্যতায় বাস করতে করতে ক্লান্ত। হয়ত যে ঘর সে  খুঁজছে  তা আজ পায়নি। তবে অঞ্চিতা জীবনকে উলটে পালটে দেখতে গিয়ে ভুল কিছু করেনি। হয়ত বাকি জীবনে চলার ঠিক রাস্তা পেয়ে যাবে। তরুণের আজ খুব ভালো লাগলো অঞ্চিতার জন্য।

তরুণ, আমাকে কথা দিচ্ছেন তো আপনি ওর খোঁজ খবর রাখবেন?

রাখব, ভাববেন না, আমি জোহরার খেয়াল রাখব।

জোহরা! আপনি ওর নাম কি করে জানলেন? ওহ, ভুলে গিয়েছিলাম আপনিতো গিয়েছিলেন ওকে দেখতে।

এক সাথে কফিসপ থেকে বের হলেও উল্টো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তরুণের মনে হল নিউ ইয়র্কের আকাশে পড়ন্ত বিকেলের রোদের আলো আজ যেন বড্ড বেশি ঝকঝকে। ঝিরঝির বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে গুন গুনিয়ে উঠলো কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম…

 

আরও পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প- মহানগরী