কথাসাহিত্যবই আলোচনা

কালকেউটে- রোখসানা ইয়াসমিন মণি- গল্প

অনি দিনদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, চুপচাপ। আট বছরের চঞ্চল ছেলেটা হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়ায় রিতুকে ভাবাচ্ছে। পরিবর্তন যদি ধীরে ধীরে হত তাহলে সমস্যা ছিল না। রিয়ার বাসা থেকে আসার পর অনির চুপচাপ হয়ে যাওয়া রিতুকে চিন্তায় ফেলে দেয়। সে কি খালাতো ভাইদের মিস করছে? মিস করলেও বলত অনি। যতবার রিয়ার বাসা থেকে ফিরেছে ততবারই বলেছে মামণি, চল, আবার যাই খালামণির বাসায়। আমার রুধি আর নিধি ভাইয়ার জন্য খারাপ লাগে। কিন্তু এবার কিছুই বলেনি। ওখান থেকে আসার পর ছেলেটা গম্ভীর হয়ে যায়। যেন খুব ভারিক্কি এবং প্রৌঢ় হয়ে গেছে। বয়সের তুলনায় বড় লাগছে। সে কি মানসিকভাবে দ্রুত বর্ধনশীল? মানসিক বয়স বৃদ্ধি পেলে বা প্রৌঢ়বয়সী হলে বাচ্চারা কি গম্ভীর হয়ে ওঠে? রিতু জানে না ছেলেটাকে নিয়ে কী করবে? খিদে লাগলে এখন বলে না। কিচেনে গিয়ে খেয়ে আসে। কী খায় রিতু দেখতেও পায় না। খাওয়ার সময় ডাকলে বলে, আমি খেয়ে নিয়েছি। রিতু অবাক হয়। যে ছেলেকে প্লেটে তুলে না দিলে খেতে চায় না সেই ছেলে নিজে খাবার নিয়ে খায়!সে কবে এতো বড় হয়ে গেছে? ঘুমাবার সময় নিজেই কোলবালিশ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রিতুকে বলে না, মামণি জড়িয়ে ধর। কপালে চুমু খাও। রিতুর বুক খাঁ-খাঁ করে। সে রিয়াকে ফোন দেয়। একথা সেকথায়  জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ রে, বলতো তোদের বাসায় কিছু হয়েছে?

না তো আপু?

অনিটা তোদের ওখান থেকে আসার পর কেমন যেন হয়ে গেছে। চুপচাপ, বেশি কথা বলে না।

আচ্ছা আপু, আমি নিধি আর সুধিকে জিজ্ঞেস করি ওরা কিছু জানে কী না?

আচ্ছা জিজ্ঞেস করতো?

রিয়া বলে, আপু, ওরা বলছে অনি ওদের সাথেই থাকত। নিধি, সুধি বাবার দোকানে যাওয়ার সময় ওকে নিয়ে যেত। আমি সারাদিন স্কুলে থাকি। অনি তো আর একা বাসায় থাকতে পারে না। ওরা যেখানে যেত অনিও সাথে যেত। আর নিধি, সুধির বাবাও অনিকে ভীষণ আদর করত। চকলেট, আইসক্রীম,নানরুটি, গ্রীল,পরোটা যখন যা খেতে চাইত খাওয়াত।

আপু, এত টেনশন করো না। ঠিক হয়ে যাবে।

আচ্ছা ঠিক আছে রাখি।

নিধি, সুধির বাবা কামরুল হাসান। বড় ব্যবসায়ী। রিতুর ছোটবোন রিয়া। প্রাইমারি স্কুলে জব করে। রিয়ার বড় ছেলে নিধি এবার এস এস সি পরীক্ষা দেয়ায় অবসর। বাসায় থাকে না বেশি একটা। বাবার দোকানে পড়ে থাকে। নিধির পরীক্ষা শেষ হওয়ায় রিতুদের বাসায় অনি বেড়াতে আসে। কদিন বেড়িয়ে আসার পর খেয়াল করে অনি একদম চুপচাপ থাকে। রিতুর বুক ধ্বক করে ওঠে। কামরুল হাসান ওকে খুব আদর করেছে। সে আগেও অনিকে খুব আদর করত।

কামরুল হাসানের আদর ওকে প্রভাবিত করেনি তো?

ছেলেটা  কি কামরুল হাসানের ভেতর বাবাকে খোঁজে? অনুভব করছে কি যে বাবা থাকলে যখন যা খুশি খাওয়া যায় পাওয়া যায়?

ছোট মন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। রিতু বোঝে। ওর অবচেতন বাবাকে খুঁজছে। রিতুর কান্না পায়। ঘুমন্ত অনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিয়ার বাসা থেকে দুদিন হলো এসেছে। এই দুদিনেই ছেলের চোখের নিচে কালি জমেছে। চোখ খাদে নেমেছে।

ছেলেকে বুকে নিয়ে হুঁ- হুঁ করে কেঁদে ওঠে রিতু।

ছয়মাস হলো রায়হানের সাথে ওর ছাড়াছাড়ি হয়েছে। এই ছয়মাস অনি কি বাবার অনুপস্থিতি টের পেয়েছে? দিন যায়। রিতু খেয়াল করে অনি স্নানে গেলে নিজেই গামছা,প্যান্ট জামা নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। আগে রিতুর মুখের দিকে চেয়ে থাকত কাপড়ের জন্য। আম্মু আম্মু ডেকে একশা করত। রিতু গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটা কি মানসিক শূন্যতায় ভুগছে?এত চঞ্চল,হৈ- চৈ করা,সারাদিন বকবক করা ছেলেটা ধীর,স্থীর হয়ে গেছে। যে ছেলেটার বকবক শুনে রিতু বিরক্ত হত আর ধমক দিয়ে বলত বাবা, থাম এবার, অনেক হয়েছে। কত কথা বলতে পারিস, বাপরে বাপ! আমার মাথা ধরে গেছে বলে তাকে থামিয়ে দিত রিতু। আজ সে ছেলের মৌনতা দেখে ভয় পেয়ে যায়। ইদানীং খেয়াল করে খেলতে গেলে অনি একটু দেরী করে বাসায় ফেরে। কারণ কী? রিতু একদিন খেলার মাঠে যায়। সেখানে পাশের বাসার সঞ্জু, অয়ন, পুলককে দেখতে পায়। ওদের সাথে অনি নেই। অনিকে দেখতে না পেয়ে বুক

ধড়ফড় করে ওঠে। রিতু দৌড়ে সঞ্জুকে জিজ্ঞেস করে, অনি কই সঞ্জু? রিতুকে দেখে ওরা চমকে যায়। আন্টি আপনি?

হ্যাঁ, বাবা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনো সে বাসায় ফেরেনি। দেরী দেখে খুঁজতে এলাম।

সেতো আমাদের সাথে খেলে না। অয়ন বলে।

কী বলছো?

জ্বী আন্টি। আমরা খেলি। সে নদীর পাড়ে বসে থাকে।

ওখানে কী করে?

রিতুর হাত ধরে পুলক বলে, চলুন আপনাকে দেখাই।

পুলকের সাথে সঞ্জু, অয়নও আসে। ওরা যে মাঠে খেলে সেখান থেকে দূরে একটি নদী। নদীর পাড় হালকা ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বর্ষা শেষ। পাড় ঘেঁষে জল ছুঁই ছুঁই করে। পড়ন্ত সন্ধ্যার ছায়ায় কালো হয়ে ওঠে নদীর জল। সূর্যের চিহ্ন ধারেপাশে নেই। অস্তগামী শেষ রেখাটি লাল থেকে লাল হয়ে ক্রমশ নীলিমায় লীন হয়ে যাচ্ছে। টকটকে আবীরের ভেতর সূর্য হৃদয়টি রেখে যায়। টুপ করে সন্ধ্যা নামে পৃথিবীতে। ওরা এগিয়ে যায় সামনে। নদীর পাশে একটি অশ্বত্থ গাছ শূন্যে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারই পাশ থেকে অস্ফুট শব্দ ভেসে আসে। ওরা কান পাতে। সঞ্জু বলে ওঠে, আন্টি এ অনি। প্রতিদিন এখানে এসে কলাগাছের সাথে কথা বলে। রিতু অবাক হয়ে যায়। কলাগাছ!

জ্বী, আন্টি। একটি কলাগাছ আছে ওখানে। সে ওটার সাথে কথা বলে।

কবে থেকে সে এরকম করছে?

অনেক দিন থেকে।

পুলক বলে, কলাগাছটা ওইই রুয়েছে।

সে কলাগাছ পেলো কই?

আমাদের স্কুলের পিন্টুদের বাড়ি থেকে এনে এখানে রুয়েছে।

এটা যখন খুব ছোট ছিল তখন সে বলতো ওর বাবু।

মানে?

তাহলে শুনুন আন্টি। আগে সে আমাদের সাথে খেলত। যখন সে কলাগাছটি পেল তখন থেকে আমাদের সাথে খেলা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা মাঠে থাকি আর সে কলাগাছ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন বিকেলে এটাতে পানি দেয়। একটি বোতল আছে বড়। নদী থেকে ওটায় জল তুলে এনে গাছের গোড়ায় দেয়। এটার সাথে কথা বলে।

রিতু অবাক হয়ে যায় এসব শুনে। কী বলতো সে গাছের সাথে? পুলক বলে, আমরা দেখতাম সে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। বাবু বলে ডাকে।

অদ্ভুত কথা বলে গাছের সাথে।

কী রকম? রিতু প্রশ্ন করে।

বাবু ও বাবু, তোমার মন খারাপ? আমার লক্ষ্মী বাবাটা মন খারাপ করে না। তোমার জন্য অনেক খেলনা নিয়ে আসব। তোমার তো দাঁত নেই। শক্ত খাবার খেতে পার না। এই দেখ, বোতল ভর্তি দুদু নিয়ে এসেছি। দুদু খাও। তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে না?

রিতু জিজ্ঞেস করে দুধ কই পেতো?

সঞ্জু চোখ বড় করে জবাব দেয়, কীসের দুধ আন্টি! নদী থেকে বোতল ভরে যে জল  নিয়ে আসত ওটাকেই বলত দুধু। ওগুলোই গাছের গোড়ায় দেয় আর বলে, দুদু খা বাবা দুদু খা। জানিস আমার মা আমাকে দুদু খেতে দেয়। ওটার রঙ সাদা। মা বলে, দুদু না খেলে বড় হওয়া যা না। তোকে যেটা দিই ওটার রঙ নেই। না থাকলে কী হয়েছে? দুদু তো দুদুই তাই না? রিতু এসব শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ছেলেটার যে কিছু একটা হয়েছে আগেই টের পেয়েছে। এখন মনে মনে ভাবে ব্যাপারটা কয়েকদিন দেখি। এখানে এসেছি অনিকে জানতে দেব না। সঞ্জু, অয়ন,পুলকের হাত ধরে রিতু বলে,তোমরা খেলতে চলে যাও। আমি এখানে এসেছি ওকে জানতে দিও না। দেখি সে কী করে। তোমাদের চকলেট খাওয়াব। মনে থাকবে?

জ্বী, আন্টি মনে থাকবে। ওরা চলে যায়। রিতু পা টিপে সামনে এগোয়। আর একটু পরে গাঢ় সন্ধ্যার বুকে মুদ্রিত হবে আঁধার। জলের ওপর সে আস্তরণ পড়ছে। জলধারা এখনো জিইয়ে রেখেছে খানদানী সূর্যের মিনমিনে প্রতাপ। কালো আঁধারে ডুবে যাবার আগে নদী বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিদায়ী আলোকমালা।

বর্ষার ধার কমে এলেও জলের বুননে চওড়া হয়ে গেছে নদীপাড়। তারই পাশে অশ্বত্থের আড়ালে অনির কথার স্বর শোনা যায়। রিতু কান পাতে। অস্পষ্ট শব্দ। বুঝতে পারে না কিছু। হঠাৎ এক উতুঙ্গু বাতাস এসে শব্দে দোলা জাগায়। ইথারে ভেসে আসা শব্দের ভেতর রিতু দুকান সমর্পণ করে। সে শুনতে পায়…

বাবা! তুমি কবে হাঁটবে? কবে তোমার পা হবে?

কবে তুমি বাসায় যাবে? তুমি কথা বল না, কেন? তোমার কথা শুনতে আমার খুব ইচ্ছে করে! রিতু দেখে অনি দাঁড়িয়ে কলাগাছটিকে জড়িয়ে ধরে।

বাবা! ও বাবা! বাসায় চল। রাতে তোমার বুকে আমি ঘুমাব। বাবা ও বাবা! বাসায় চল! অনি কলাগাছের পাতা ধরে টানে। গাছ কি আর হাঁটতে পারে? টানাটানিতে পাতা ছিঁড়ে আসে। হাতের মুঠোয় পাতা ছিঁড়ে এলে অনি বলে, ওহহ বাবা! তুমি ব্যথা পেয়েছ? সরি,আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি।

রিতু এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। ওর হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ঝরছে। আলোড়িত করে ওঠে ভেতর। সারা অঙ্গ কেঁপে ওঠে। শরীরে একটি ঠান্ডা প্রবাহ তরতর করে বয়ে যায়। সে আর এক মুহূর্ত দেরী করে না। যে পথে এসেছে নরম পায়ে আবার সেই পথে হাঁটা ধরে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সামনে। গিয়েই সঞ্জু, অয়ন, পুলককে দেখতে পায়। ওরা বাসায় যাবার জন্য পা বাড়ায়। রিতুকে আসতে দেখে দাঁড়ায়। কী আন্টি, আপনি একা! অনি কই?

বাবারা, সে ওখানে আছে। রেখে এসেছি। আমি তোমাদের কাছে এসেছি। কিছু প্রশ্নের জবাব দেবে?

বলুন আন্টি, কী জানতে চান?

অনি কলাগাছকে বাবা ডাকছে। তোমরা বলেছ সে কলাগাছটিকে বাবু ডাকতো। ছোট বাচ্চার মতো আদর করত। যত্ন করত। এখন এটা আমি কী দেখছি?

ওহহ আন্টি এইটা? সে এখন গাছটিকে বাবা ডাকে। গাছটি যখন খুব ছোট ছিল তখন এটা করত। এখন গাছটি বড় হয়ে গেছে তাই বাবা ডাকে। শুধু তাই নয় আমরা যখন খেলতে আসি সে তখন দৌড়ে গিয়ে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে বলে, বা…. বা! বা…বা আমি এসেছি,তুমি কী করছ? কেমন আছ?

আমরা এসব দেখে খুব হাসি।

তোমরা হাস? এতদিন আমাকে এসব বলোনি কেন? রিতু কেঁদে ওঠে। ওর চোখ ছলকে খসে পড়ে বুকভাঙা অশ্রু। ভেতরের কষ্ট ও বেদনাগুলো আকস্মিক বড় হয়ে ওঠে। ওরা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। সে বাস্তবতায় ঢুকে টেনে আনে অতীত। আজ ছেলেটির এমন দুদর্শার জন্য দায়ী কে? রিতু নাকি রায়হান? রায়হান ওদের ছেড়ে চলে গেছে। ওর ফুফাতো বোন রিমির কাছে। যার সাথে ওর প্রেম ছিল।  ডিভোর্স খেয়ে বাবার বাড়ি আসার পর ওদের পূর্ব প্রেমে লাল, নীল রঙীন বেলুন ওড়ে। রায়হানের হৃদয়ে রিমির হাওয়া লাগে। একটি মেয়ের চোখের সামনে আরেকটি মেয়ে গড়ের মাঠ হয়ে মেঘমল্লা নামাবে আর আরেকটি মেয়ে চেয়ে চেয়ে দেখবে তা তো হয় না। অনেক ঝগড়া অনেক লড়াই। রিতু বহবার রায়হানকে থামাতে চেয়েছে, পারেনি। পাখির মতো উড়াল স্বভাব যার তাকে কি খাঁচায় আটকানো যায়?

শেষে ওকে ছেড়ে নিজের সমস্ত পতনকে ডেকে নেয় রিতু। দিন শেষে আত্মসম্মানটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। আজ ছয়মাস সে ডিভোর্স নিয়েছে। কিন্তু ছেলেটার ভেতর যে বাবা ঘড়ঘড় করে ডাকে তাকে কোথা থেকে এনে দেবে রিতু? কোথায় পাবে ওর বাবাকে? বাবা নামের কালকেউটে যে আরেক পৃথিবীতে হারিয়ে গেছে সে কী করে বলবে অনিকে?

সে কী করে বলবে, অনি দেখ বাবা, তোমার বাবা নেই। এই পৃথিবীর কোথাও সে নেই। তুমি যে পৃথিবী দেখছ এটা কেবল আমার আর তোমার। এখানে আমাদের অনেক কিছু নেই। এখানে যদি বেশি কিছু চাইতে যাও তাহলে দু’হাত ভরে শুধু আবর্জনাই পাবে। তুমি এখনো অনেক ছোট। কবে বড় হবে আর  বুঝবে এখানে অনেক কিছু আমাদের নয়। রিতু চোখ মোছে। পুলক, সঞ্জু,অয়ন স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা বুঝতে পারে না দুঃস্বপ্নে উম্মাদপ্রায় রিতু কত অসহায় হয়ে গেছে যাপিত জীবনের কাছে।

রিতু দৌড়ায়। মাথাটাকে সম্মুখে ঝুঁকিয়ে পা দুটো পেছনে ঠেলে দৌড়বিদদের মতো নদীর দিকে ছোটে। চারিদিকে ত্রস্ত আঁধার নেমে আসছে। আর একটু পর হলেই বোঝা যাবে না এখানেও একটি নদী আছে। আঁধার এসে নদীটিকে গ্রাস করবে। এর আগেই অনিকে ফেরাতে হবে। ওর বুকের ভেতর যত অন্ধকার জন্ম নিয়েছে এদের তাড়াতে হবে। বহু দেরী হয়ে গেছে। আর নয়। ওর কচি মনে অতর্কিতে চাঁদ নামানো যাবে না। একটু একটু করে যেমন ভোর হয়, ভোর থেকে দিন তারপর একটু একটু করে গাঢ় সন্ধ্যার প্রলেপে ঢেকে আসে প্রকৃতি, পৃথিবী তেমনি করে ওর মনো পৃথিবীতে সব নামাতে হবে।

ওর ওই পৃথিবীতে আনন্দ জমাবে রিতু। এর আগে ওর সম্পদ কলাগাছটিকে সেও ভালোবাসবে। রিতু দৌড়ায়। পেছনে ধুপধাপ শব্দ শুনে অনি ফিরে তাকায়। কলাগাছটিকে ছেড়ে দিয়ে বলে, আম্মু, তুমি এখানে?

হ্যাঁ, বাবা। তোমার দেরি দেখে আমি চলে এসেছি। কলাগাছটি তোমার? বাহ বেশ বড় হয়েছে তো!

এটা থেকে একদিন কলা বের হবে। ওই কলা আমরা খাব। তোমার হাতে লাগানো গাছ থেকে কলা বের হবে। কি দারুণ হবে তাই না?

এটা থেকে কলা বের হবে?

হ্যাঁ, বাবা, কলাগাছ থেকে তো কলাই বের হয়। তখন এটাকে কী ডাকবে?

অনি বলে, তুমি বলে দাও, কী ডাকবো?

এতদিন এটা তোমার বাবু ছিলো। এখন হয়েছে বাবা। এরপর এটাকে আম্মু ডেক। কারণ, ফলগাছগুলো মা হয়। যে গাছে ফল ধরে তাদের মা গাছ বলে। তুমিও আম্মুর ফল। তাই আমি তোমার মা। যখন গাছটিরও ফল হবে তখন এটাকে তুমি আম্মু ডাকবে। আর আম্মুরাই সন্তানের পাশে থাকে। আমিও তোমার পাশে আছি বাবা!

তুমি এতসব জানলে কীভাবে আম্মু?

বারে! তোমার একটি বাবু আছে, বাবুটা আবার বাবা হয়েছে এসব গোপন থাকে? আর কদিন পরে এটা মা হবে। খুব মজা না?

আসলেই খুব মজা।

জানো অনি! একমাত্র গাছকেই তুমি যা খুশি ডাকতে পার। আদর করতে পার, বকা দিতে পার। ওদের রাগ নেই। ওরা সব কথা শোনে।

কিন্তু ওরা কথা বলে না। বলতে পারে না।

না বাবা, ওরা সব পারে। আরেকটু বড় হও। দেখবে গাছ তোমার কথা শুনে কী করে!

সত্যি বলছ, আম্মু?

হ্যাঁ, বাবা সত্যি বলছি।

অনি মায়ের বুকে চলে আসে। ওকে টেনে নেয় রিতু। বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বলে আমার সোনা বাবাটা। আমার সমস্ত সুন্দর। চল এবার ঘরে যাই। ওরা পা ফেলে। পেছনে পড়ে থাকে অদ্ভুত আঁধারে ঢেকে আসা সবুজ প্রকৃতি। অনি যাওয়ার আগে কলাগাছটিকে আবারো জড়িয়ে ধরে বলে, গুডনাইট বাবা!

আরও পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প