কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

গোরাবাড়ি – মহম্মদ সফিকুল ইসলাম- গল্প

কোথায় নামবেন?,
— গোরাবাড়ি,
অটো যাত্রীর উত্তরে চালক বুঝে যান কোথায় নামাতে হবে। সেই মতো নামিয়ে দেন পাঁচিল ঘেরা প্রাসাদোপম বাড়ির গেটের সম্মুখে।
এতো বড় বাড়ি এই তল্লাটে কারো নেই। প্রতি তলা বারোশ বর্গ ফুটের। প্রথম ও দ্বিতীয় তল পৃথক দুটি কারখানার মালিকদের কাছে মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকার চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া আছে।
এছাড়াও তার আরো তিনটি বাড়ি আছে । সবগুলো একেবারে রাস্তা সংলগ্ন।একটি বাড়ির নিচের তলায় বড় ছেলের ইট, পাথর,বালি,রড প্রভৃতি নির্মাণ সামগ্রী বিক্রির দোকান।
অন্য একটি বাড়ির নিচের তলে মেজ ছেলের হাঁড়ি কুড়ি, ছাউনির টিন,এসবেসটরস,রঙ ও অন্যান্য হার্ড‌ওয়ারস দ্রব্যাদি বিক্রির দোকান।
ছোট ছেলে তার দোকান লাঠে তুলে দিয়ে লড়ি ও পিক আপ ভ্যান দেখাশোনা করে।
ছেলেরা আলাদা বাড়িতে থাকে।পৃথক সংসার।যাঁর পরিবার তার খরচ।চাল, ডাল, আটা, মশালা, আনাজপাতি প্রত্যেকে নিজের মতো কেনে। মাঝে মধ্যে গোরা নিজের টাকায় অনেকটা পরিমান মাছ, মাংস কিনে সমান ভাবে তিন ছেলের ঘরে পৌঁছে দেয়।
খোদাবক্স ওরফে গোরার নিজের আছে যশোর রোডে কাঠবল্মী, বাঁশের গোলা, অন্যত্র ইটের গোলা। বাঁশ ও কাঠের গোলা আগে সরকারি পি ডব্লিউ ডি’র জায়গায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল।পরে কারখানা মালিকের জায়গায় ফরচুন সিটি তৈরি হ‌ওয়ায় সামনের পজিশন কিছুটা ছেড়ে,ব্যবসা এক‌ই রেখে, জায়গা কিছুটা গুটিয়ে নিতে হয়েছে।
গোরার একসময় খাওয়া হতো না। থাকার ঘরদোর ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে থেকে,গ্রামে গঞ্জে বাঁশ কিনে, প্যাডেল ভ্যান নিয়ে ফেরি করে বেড়াত।
সে খুব পরিশ্রমী ছিল। চড়াদামে বাঁশ বিক্রি করায় লাভ হতো প্রচুর। কিন্তু একেবারে উল্কার বেগে তার উত্থান হবে, একথা কেউ ভাবতে পারেনি।সেও হয়তো অত বড়লোক হওয়ার কথা ভাবেনি। দূরদর্শিতা ছিল।নিষ্ঠা আর চেষ্টার ফলে যতটা চেয়েছিল তার অধিক সে পেয়েছে।
খোদাবক্সের পৈতৃক বাড়ি কদম্বগাছি।পিতা রহিম বক্সের অবস্থা ছিল দিন আনা দিন খাওয়া। পেশায় দিনমজুর।গতরে খেটে তিন মেয়ে, তিন ছেলে মানুষ করতে তাঁর হিমসিম অবস্থা। কেবল চার কাঠা ভিটেমাটি ছাড়া কোন চাষের জমি ছিল না।
গোরার প্রথম বিয়ে দেন বাদুড়িয়ার কাছে জীবনপুর গ্রামে, দরিদ্র পরিবারে। বিয়ের পর জোড় খুলতে শ্বশুরবাড়িতে যায় খোদাবক্স। দ্বিতীয় দিন সকালে বছর বারোর শালাকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে ঘুরতে যায়। আশপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও মিস্টির দোকান বা সিঙারা আছে কিনা। তার চোখে পড়েনা।শালা বাবু নিয়ামত আলিকে জিগ্যেস করল,– সিঙারা খাবি?
সে এককথায় মাথা নেড়ে জানায়,– না।
তবুও সে জানতে চায়,– আগে বল, সিঙারার দোকান কোনদিকে?
নিয়ামত তর্জনী উঁচিয়ে বলে,– ঐ দিকে।
— ঠিক আছে,এখানে বস।তোর সাইকেল নিয়ে আমি যাব আর সিঙারা নিয়ে আসব।
সিঙারা আনার নাম করে শালার স্কুলে যাওয়ার নতুন রেসিং সাইকেল নিয়ে খোদাবক্স পালিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল, আর যায়নি।ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন লজ্জায় বিষয়টা যথাসম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল। দিন দিন কানাঘুষা বাড়তে থাকে।একসময় সব জানাজানি হয়।
খোদাবক্সের শ্বশুর আনছার আলি গোপনে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, জামাই সংসার করতে চায় না। অনিচ্ছুক ঘোড়া নিয়ে সফর চলে না। মেয়ে আরফাতুনকে ছাড়িয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাস খানেক বাদে গ্রামের কতিপয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে খোদাবক্সের বাড়িতে উপস্থিত হন। ওদের আসার সংবাদ পেয়ে খোদাবক্স গোপনে পালানোর চেষ্টা করে। রাস্তার মোড়ে ওঁরা ওকে চিনতে পারেন।সে ধরা পড়ে যায়।
বিচার সালিশের পর তালাকনামায় স‌ই সাবুদ সেরে একজন সাইকেল নিয়ে,বাকিরা বাসে করে ফিরে যান। মেয়েকে বাড়িতে রেখে এসেছিলেন।বাড়ি ফিরে স‌ই করানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ছয়মাস পর খোদাবক্স গোপালপুর গ্রামের জুলেখা বেগমকে বিয়ে করে ।  প্রথমে ভ্যান চালক,পরে বাঁশের ব্যবসা শুরু করে।পরে বাঁশের গোলার মালিক হয়। গায়ের রঙ ফর্সা ছিল,তাই তখন থেকে নাম হয় গোরা।
গোরা বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবসায় নতুনত্ব আনে।একজনের কাছে কিছু বাঁশ দিয়ে বসিয়ে রাখে।সে খদ্দেরের কাছে গোরার বেঁধে দেয়া চড়া দাম হাঁকায়।
অথচ গোরা নিজের গোলায় নেয় বাঁশ প্রতি পনের, বিশ টাকা কম। খদ্দেররা গোরার গোলায় বাঁশের  দাম সস্তা ভেবে কিনে নেয়। প্রচুর লাভ হতে থাকে। জঙ্গলমহল থেকে সস্তায় গাড়ি করে কাঠবল্মী এনে চড়াদামে বিক্রি করে। অন্য একটি গোলায় মজুত রয়েছে লাখ দুই ইট।
লোকে বলে,গোরা ব্যবসার মাধ্যমে প্রমাণ করে  দেখিয়েছে যে, নিরক্ষর হলেও সে খুব বুদ্ধিমান।জমিজমা, গাড়ি বাড়ি কেনাবেচার ক্ষেত্রে বড় ছেলের সাথে পরামর্শ করে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করলেও আজ পর্যন্ত লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি।
নিরলস পরিশ্রম আর চেষ্টায় অল্পদিনেই মূল্যবান জমিজমা,গাড়ি,বাড়ির মালিক ও কোটিপতি বনে যায়।
টাকার মালিক হলেও বিশ বছর আগে গোপালপুর মসজিদে ইফতার তালিকায় তার নাম রাখা হতো না। মুরুব্বীরা বলতেন,গোরা চোটায় টাকা খাটায়।ওর ইফতার খাওয়া যাবেনা।
গোরা গোপালপুরের লোকজনকে দেখানোর জন্য পাশের মাঠপাড়া মসজিদ হাজার হাজার টাকা খরচ করে রাজকীয় ইফতারের আয়োজন করত।মাঠ পাড়ার মুসুল্লিরা গোরার ইফতার দেয়া দিনের অপেক্ষায় উৎসুক হয়ে থাকত। সেদিন মসজিদে ভিড় জমে যেত।
গোপালপুরের রোজাদারদের অনেকে মনে মনে ভাবত, একদিন গোরার ইফতার পেলে ভালো হতো। তৃপ্তি করে খাওয়া যেত। সেই দাবী এক জুম্মাবারে খুতবার আগে ওঠে।সকলে সমস্বরে সমর্থন জানায়।
গোপালপুরের মানুষের দাবী ও আগ্রহের কথা জানতে পেরে গোরা রমজানের ছাব্বিশ তারিখ ইফতার দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সেই প্রস্তাব মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে গৃহীত হয়। তারপর দশ বছর যাবত এটা ধারাবাহিক চলে আসছে।
রোহন্ডা চন্ডিগড়ের কুদ্দুস গোরার বোলেরো গাড়ি চালাত।সে এক ইংরেজি নববর্ষের আগের দিন একটা শুভেচ্ছা কার্ড নিয়ে আসে গোরার বাড়িতে।
গোরার দুই মেয়ে তখন যৌবনবতী। চপলা চঞ্চলা, সুন্দরী।বাড়ির লোকের কড়া শাসনের ফলে তারা বাইরের কারো সাথে মেলামেশার সুযোগ পেত না।গাড়ি চালানোর জন্য আসা যাওয়া করতে করতে ওদের সাথে কুদ্দুসের আলাপচারিতা শুরু হয়। ছোট মেয়ে সানজানা বেঝতে পারে কুদ্দুস তার প্রতি একটু বেশি অনুরক্ত,আকৃষ্ট। সেদিন শুভেচ্ছা কার্ডটি দুই মেয়েই পেতে উদগ্রীব ছিল।দিদি কাজলের মনোভাব বুঝতে পেরে সানজানা কুদ্দুসের হাত থেকে কার্ডটি ছোঁ মেরে নিয়ে ওপর তলায় পালিয়ে যায়।
তার হৃদযন্ত্রে ঢিপঢিপ শুরু হয়। দুরুদুরু বুকে কার্ডটি খুলে দেখে তিনটি শব্দ লেখা আছে,আই লাভ ইউ! দুহাতে রঙিন কার্ডটি ধরে তাতে একটা চুম্বন এঁকে দেয়। তার পর ডান হাতে নিয়ে, দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে আনন্দে কয়েক পাক ঘুরপাক খায়।
এরপর কুদ্দুস আসাযাওয়া কমিয়ে দিয়ে নিয়মিত মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা সোহাগী আলাপ করতে থাকে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হঠাৎ একদিন আমটি আমটি শীতের মেঘলা সকালে কুদ্দুসের বাবা জসিম আলি ও মা ছকিনা বিবি গোরার বাড়িতে হাজির হয়। তখন আসমানে রৌদ্র মেঘের আলোছায়া খেলা চলছে। তাপমাত্রা বসন্ত ঋতুর মতো নাতিশীতোষ্ণ।মাঝেমধ্যে মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বাসায় বন্দি পাখপাখালি।
কুদ্দুসের বাবা জসিম আলি তার ছেলের সাথে সানজানার বিয়ের প্রস্তাব দেয়।শুনে গোরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। মুখে প্রকাশ না করলেও এতদিন ঘর করার সুবাদে ওর স্ত্রী জুলেখা সব‌ই বুঝতে পারে। কিছু বলতে পারে না।
যার সাথে গত কয়েক বছর পিকনিক পার্টিতে একসাথে মদ ও মাংস খেয়ে বেফাঁস কথা,রগরগে গল্প হয়েছে তাকে জামাই করতে হবে একথা গোরা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।মেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন তার চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
অতিথি আপ্যায়ন ও যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করে কোন অসন্তোষ বুঝতে দেয় না। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ওদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। ওরা বিকেলে ফিরে যাবার সময় মতামত চাইলে গোরা জানিয়ে দেয়,–মেয়ের মতামতের জন্য আমাকে দুদিন সময় দিন। ওই যখন সংসার করবে ,যা চাবে তাই হবে।
ওরা চলে গেলে গোরা স্ত্রীকে বলে মেয়ের মতামত জেনে নিতে। জুলেখা মেয়ের সাথে কথা বলে বুঝতে পারে জল অনেকদূর গড়িয়েছে।সে উপলব্ধি করে যে, সানজানা অনড়।ওই ছেলে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে চায় না।
জুলেখা অনেক করে বুঝিয়ে বলে,–দিদির আগে তোর বিয়ে দিলে, দিদির বিয়ে দিতে গেলে নানা কথা উঠবে। দিদির বিয়ের পর ওর সাথেই তোর বিয়ে দোব।
জবাবে সানজানা বলে,– ওসব কথায় চিড়ে ভিজবে না। তখন যদি ঘুরে শোও।আমি কিছুতেই সেই রিস্ক  নেব না।
মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে একেবারে বেপরোয়া জুলেখা সেই কথা স্বামীকে বুঝিয়ে বলায় অগত্যা সে নিমরাজি হয়।
এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কুদ্দুসের সাথে সানজানার বিয়ে ও রেজিস্ট্রি হয়। কিন্তু খাটের বুড়ি,দান দেহাজ,উপঢৌকন কিছুই পাঠানো হয়না।
তার পরের বছর দেখাশোনা করে,বিরাট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হুমাইপুরে বড় মেয়ে কাজলের বিয়ে দেয় গোরা।
বিবাহের দু বছর পর ছোট মেয়ের কোল আলো করে ফুটফুটে মেয়ে জন্মালে আস্তে আস্তে গোরার সব দুঃখ, অভিমান, রাগ মাটি হয়ে যায়। তারপর একদিন বোলেরো গাড়ি উপহার হিসেবে জামাইকে দিয়ে দেয়।
গোরা ওর স্ত্রী ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে গত বছর হজ্জ করে এসেছে।কেনা আছে নিজস্ব গোরস্থান। সেখানে নানা রকম ফুলগাছ লাগিয়ে চারপাশ ঘেরা আছে। রোজ ভোরে ফজরের নামাজের পর নিয়ম করে ফুলগাছের গোড়ায় নল দিয়ে জল দেয়।পাতা ছাঁটে, আগাছা পরিষ্কার করে। এখন বুঝতে পারে রক্তের তেজ ধীরে ধীরে কমে আসছে।সে জেনে গেছে তার স্থায়ী ঠিকানা। দিন দুনিয়ার কথা ভাবে আর সময় পেলে আসমানের দিকে তাকিয়ে ফেলে আসা জীবনের কথা চিন্তা করে। তখন চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। অশ্রু দুপাশের গলগন্ড বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে।আবছা আলোয় পশ্চিম দিকে সূর্য হেলে পড়তে দেখে অসহায় তাকিয়ে থাকে। তার বেবাক শূন্য দৃষ্টির ভাষা কেউ বুঝতে পারে না।