গোলাম কবিরের কবিতা
তুমি, সেই তুমিই তো
তোমার কথা মনে হতেই
আচানক বুকের ভিতরটা তোলপাড় শুরু করে,
ভূমিকম্পে সৃষ্ট নদীর গতিপথ বদলে যায়,
তীব্র স্রোতস্বিনী কোনো নদীর ঘূর্ণিপাকে
পড়ে যাওয়া মানুষের মতো
স্মৃতির ঘূর্ণিঝড়ে বেহাল হয়ে যাই!
কখনো কখনো সাড়ে তিন হাজার বছরের
ভূলে যাওয়া কোনো এক প্রাচীন নগরের
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে হঠাৎ করেই
যেমন খুঁজে পাওয়া কোনো একটা স্বর্ণমূদ্রা
দেখে খুশিতে চিৎকার করে ওঠে
খননকারী দলের কেউ একজন,
আমারও এমন হয়!
মনেহয় আমিও তোমাকে খুঁজে পেয়েছি
ভালোবেসে সেই হরপ্পা সভ্যতার
প্রাচীন নিদর্শনের মতো যাকে ভীষণ যত্নে
রেখেছি হৃদয়ে আমার,
তুমি, সেই তুমিই তো!
ঐশ্বর্যবান ও ছেলেটার দৈন্যতা
ছেলেটা বললো –
” তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না!
এতোদিন যা বলেছো
সব মিথ্যে বলেছো!
এখন সব বুঝি!
জানো তো, ভালোবাসলে
মানুষ অন্ধ হয়ে যায় !
যাকে ভালোবাসে
তার সবকিছুই ভালোবাসে!
আমিও তাই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।
তোমার সকল ঐশ্বর্য – দৈন্যতা,
খোলা হাওয়ায় উড়তে থাকা
দীঘল কালো চুলের গভীর অরণ্য,
থুঁতনির নিচের কালো তিল,
তোমার শরীরের মহুয়া ঘ্রাণ, এমনকি
তোমার গায়ে লেগে থাকা নোনাঘাম –
সবকিছুই অলৌকিক ঐশ্বর্য ও অমূল্য মনেহয়!
তুমি আমার কাছে এমনই একজন!
কিন্তু তুমি যে আমায় একটুও ভালোবাসো না,
ভীষণ কষ্ট লাগে যখন বুঝতে পারি ;
কিন্তু কেনো যে মানতে পারছি না !
তোমাকে ভালোবাসার অসুখ
আমার কেনো যে ভালো হচ্ছে না!
কেনো যে ভালো হচ্ছে না! “
মেয়েটা শুধু তার কথা শুনে
নিঃশব্দে মৌন নদীর জলের মতো
ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলে গেলো দূরে কোথাও।
ইউরেকা, ইউরেকা
বহুকাল ধরেই ভালোবেসে
আকুল প্রার্থনায় তোমাকে চাইছিলাম।
তুমি বললে, ” একটু ভালো করে খুঁজে দ্যাখ! “
দেখলাম, আমার বুকের মধ্যে
শুধুই তুমি নামের এক বিস্তীর্ণ
সবুজ পাহাড়ের সারি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে
পৌরাণিক যুগের খননকৃত নির্দশনের মতো!
আমি ঝানু প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো খুঁজতে খুঁজতে
তোমাকে পেয়ে গিয়ে হঠাৎ করেই স্ববিষ্ময়ে
বিপুল উল্লাসে আর্কিমিডিসের মতো
” ইউরেকা, ইউরেকা ” বলে চিৎকার করে উঠলাম!
তারপর থেকে এই চোখ দুটো
পৃথিবীর সকল কিছু থেকে
নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে অন্ধ হয়ে গেছে!
সম্পর্ক
সম্পর্কের শিথিলতায় কাছে থেকেও
অনেকে থাকে হৃদয় থেকে অনেক দূরে,
উষ্ণ হলে বহুদূরে থেকেও কেউ কেউ
হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকে
সাজেকের ছুঁয়ে ফেলা মেঘের মতো।
বন্ধুহীন এই শহরে
সবাই জানে আমার কতো বন্ধু স্বজন!
মোবাইলে শুধু একবার ডাক দিলেই
ছুটে চলে আসে তারা সদলবলে।
আনন্দ করি, গান গাই একসাথে,
দম ফাটানো হাসিতে ফেটে পড়ি এক একদিন!
কখনো দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসি
সবাই মিলে শহুরে কোলাহল থেকে
একটু পালিয়ে বাঁচতে অথচ সত্যি বলতে
ওরা কেউই আমার বন্ধু নয়!
যার বা যাদের সঙ্গ পেলে মনেহয়
দিনগুলো এতো ছোটো কেনো!
কিংবা ধরো যাদের কাছে নিজের হৃদয়ে
জমে থাকা গোপন ব্যথাগুলো বলে
হালকা হওয়া যায় কিংবা
জল ছেড়ে আসা হাঁসের মতো
গা ঝাড়া দিয়ে আগের মতো হওয়া যায় ;
আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই এই শহরে।
ওরা সবাই এক একজন গুড়ের মাছির মতো,
যতোক্ষণ গুড় আছে, ওরা আছে!
গুড় শেষ তো ওরাও উড়ে যায়
অন্য কোথাও নির্দ্বিধায়!
এই শহরের মানুষ এখন প্রকৃত অর্থে বন্ধুহীন!
এখানে একজন মানুষের জন্য প্রকৃত বন্ধুর
দূর্ভিক্ষ সবসময় লেগেই থাকে,
সবাই কেমনজানি কচ্ছপের মতো
নিজেকে গুটিয়ে রাখে!
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে না কেউই।
বন্ধু মানে যে উদার আকাশ
এখন তা আর অনুভব হয় না!
এখন সবাই বোঝে যার যার প্রয়োজন,
যা ফুরিয়ে গেলেই আর দেখা মেলে না।
দুঃখ ভোলা রাতে
কোনো একদিন দুঃখ ভোলা রাতে
দুঃখগুলো সব বুক পকেটে রেখে
একলা রাতের অন্ধকারে
বেরিয়ে পড়ি ঘর ছেড়ে!
সেদিন ইচ্ছে করছিলো
আমিও রাতজাগা পাখিদের মতো
দুঃখ ভুলতে উড়ে যাই
দূর আকাশে ডানা মেলে!
আহা, মানুষ যদি উড়তে পারতো!
আচ্ছা, উড়তে পারলে হয়তোবা
সময়টুকু কাটতো ভালো
নানান দেশ ঘুরে ঘুরে
কিন্তু একটা সময় ক্লান্তি এলে
যখন একটুখানি বিশ্রামের জন্য
চোখ দুটো বন্ধ করতাম ;
ঠিক তখনই তো দুঃখগুলো
সব ফিরে এসে ভিড় করতো চোখের পাতায়,
দুঃখ ভুলে ঘুম কী আর তখন হতো বলো?
তাই তো এখন দুঃখ ভোলা রাতে
আরও কিছু দুঃখ বুনি
যতন করে রেশমি সুতোয়,
আরও কিছু দুঃখ কিনি সাধ করে।
নিওলিথ স্বপ্ন এবং অভিমান
তোমাকে ঘিরে আমার কতো যে
নিওলিথ স্বপ্ন ছিলো কিন্তু সেসব
হারিয়ে গেছে ইকারুসের আকাশে!
তারপর বুকের মধ্যে কিছু অভিমান
জমে বিশাল এক পাহাড় হলো এবং
কিছু তার মেঘ হয়ে অপার আকাশের
বেদুঈন মেঘদলের সাথে
মিতালি গড়ে তুললো।
তারপর! আমিও কঠিন পণ করলাম,
আর কোনো কথাই বলবো না তোমার সাথে
কিন্তু কী আশ্চর্য! তুমি সামনে আসতেই
জমাট বাঁধা সব অভিমানের পাহাড় ভেঙে
পড়লো এবং বুকের ভিতর জমে থাকা
অভিমানের মেঘগুলো গলে জল হয়ে
গড়িয়ে পড়লো গন্ড বেয়ে অথবা সেইসব
অভিমানী মেঘ লক্ষ্মণ সেনের মতো
পালিয়ে গেলো পিছনের দরজা দিয়ে।
আমার আফ্রোদিতি
আস্ত একটা পৌরাণিক নদী
আমার বুকের ভিতরে নিভৃতে
বয়ে যায় কুলকুল করে!
আমি তার গান
শুনতে পাই রাত্রিদিন!
কখনো সে গুনগুন করে গান গায় আমার
বুকের ভিতরে একান্তই আপন আনন্দে
আবার কখনো সে বিলাপ করে গভীর রাতে।
নদীটা আমার হৃদয়ে কোনো স্মার্ট সুন্দরীর
চোখের কাজলের মতো কিংবা
তার কপালের মধ্যিখানে বড়ো লাল
টিপের মতো লেপ্টে থাকে সর্বক্ষণ।
যখন আমি ওর পাশাপাশি শুয়ে থাকি
তখন টের পাই বুকের ভিতর তোলপাড়
করে জ্বলতে থাকা কামনার আগুন,
তখন মনেহয় আমার সমস্ত শরীরে
কেমন একটা শিরশির অনুভূতি চলে আসে।
মনেহয় ও যেনো আমার আফ্রোদিতি!
আরো পড়ুন- বদরুজ্জামান আলমগীরের কবিতা