প্রচ্ছদসাক্ষাৎকার

সুর ছাড়াই যে জিনিস বেজে ওঠে তারই নাম কবিতা- কবি জামিল হাদী’র সাক্ষাৎকার

কবি জামিল হাদী। জন্ম যশোরে। বেড়ে ওঠা খুলনায়। লেখালিখির সাথে যুক্ত প্রায় আঠারো বছর। প্রথম প্রকাশিত বই ‘ কোথাও না কোথাও’ বইমেলা ২০১৯।  বাংলা কবিতার নিমগ্ন সাধক জামিল হাদীর সঙ্গে তাঁর কবিতার সন্ন্যাস ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেছেন পরমপাঠ সম্পাদক ওয়াজেদ নবী।

ওয়াজেদ নবী: কেমন আছেন ?

জামিল হাদী: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

 

ওয়াজেদ নবী:  লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?

 

জামিল হাদী: গান লিখতাম শুরুতে। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় মেজোভাই পিয়ানো কিনে দিয়েছিলেন। হারমোনিয়ামকে বিদায় জানিয়ে ঐসময় পিয়ানো নিয়ে পড়ে থাকতাম রাতদিন। এমনও হয়েছে দিনের ১৩/১৪ ঘন্টা পিয়ানো বাজানো নিয়ে নিরীক্ষা করতাম।  খুলনা তখন আধা-মফস্বল শহর ছিলো। পিয়ানো শেখানোর কোনো স্কুল ছিলো না। আর ঢাকায় গিয়ে শেখার মতো বিলাসিতা করার সুযোগও ছিলো না। ইউটিউবও ছিলো না সেসময় যে টিউটোরিয়াল দেখে দেখে শিখবো। তাই হারমোনিয়ামের শিক্ষাটুকু কাজে খাটালাম আপ্রাণ। আর প্রচুর শুনতাম। এ আর রেহমান, লুডোভিকো ইনাউডি এনাদের গান, ট্র‍্যাকের ক্যাসেট বাজাতাম লাগাতার। তারপর অনেক দিন গান লেখার পর বুঝলাম এগুলো অনায়াসে কবিতা হিসেবে মানিয়ে যাবে। যদিও সেসব কবিতা / গীতিকবিতার কিছুই আমি বইতে দেইনি। বুঝেছিলাম পরে গিয়ে যে ওগুলো আসলে কিছুই হয় নাই। অল্প বয়সে সুর করা শিখে ফেলায় নিজেকে বেশি জাজ করে ফেলেছি কবিতার খাতাতেও। দুটো দুই জিনিস। অনেক ফারাক। এইতো এটাই প্রারম্ভিকা আমার কবিতায় আসার।

 

ওয়াজেদ নবী:  সিরিয়াসলি কবিতা নিয়ে কবে ভাবলেন?

জামিল হাদী:  ঐ ২০০৫/৬ এর দিকে। তখনও মনে গায়ক হবার স্বপ্ন দুর্দান্ত ভাবে তাগিদ দিচ্ছে। এর ফাঁকে কলেজের মেসে অনেক ছেলেপেলেই কবিতা লিখতো। আমি গান বানাতে পারায় নন্দিনী-মহলে বেশি পপুলার ছিলাম। সেইসময় একদিন ওস্তাদ আল মাহমুদ সাহেবের লেখা পড়ি। এরপর সিদ্ধান্ত নিই গান বাজনায় কিছু না হলে, কবিতায় নামবো। সুর ছাড়াই যে জিনিস বেজে ওঠে তারই নাম কবিতা, এইটা আল মাহমুদ সাহেবের কবিতার বই পড়েই আমার প্রথম উপলব্ধিতে আসে। গানের সফরটা আমাকে শিখিয়েছিলো কোনো জিনিসই চর্চা ছাড়া হয় না, সামনে আগায় না। তাই আমি কবিতায় আমার বক্তব্যের স্টাইল তৈরি করতে শুরু করি। আমি সরাসরি যেটা করলাম বাংলা কবিতার চার/পাঁচ জন মহীরুহ বাদে বাদবাকিদের লেখা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম। কারণ ছিলো ঐসব লেখা পড়লে আমার ভেতরে সেগুলোর ছায়া অবচেতন ভাবে চলে আসতে পারে, এই সাবধানতায়। এইভাবে টানা লিখেছি ১৪ বছর। প্রচুর আর্টফিল্ম দেখতাম, সেগুলোর রাইটারদের ডায়লগ ডেলিভারি বোঝার চেষ্টা করতাম। গান শোনা আমাকে কবিতায় হেল্প করেছে। বহুমাত্রিক ভাবে হেল্প করেছে। বিশেষভাবে ছন্দ কবিতা আমি শিখেছি নিজে নিজে। গান বানানোর সময় মাত্রা গুণে গুণে শব্দ বসাতে হয় সুরের গায়ে। ঐ অটোমেটিক প্রসেস আমাকে ছন্দকবি বানিয়েছে আমি তা জানতামও না, এই কথা আমি নতমস্তকে স্বীকার করি। আমার কবিতা লেখায় কোনো গুরু নেই, কারো কাছে গিয়ে কখনো তালিম নেইনি এই বিষয়ে, এটাও স্বীকার করি। অনুপ্রেরণা আছেন অনেকে, জসীমউদ্দিন, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, বিনয় মজুমদার, কামরুজ্জামান কামু। এনাদের লেখা না পড়লে, আমাকেও লিখতে হবে এই জ্বালানীটুকু পেতাম না।

ওয়াজেদ নবী:  এখনকার সময়ে কার/কাদের লেখা ভালো লাগে?

 

জামিল হাদী:  তেমন কারো লেখা চোখে পড়েনি যা ভালো লাগতে পারে। যদি তেমন কাউকে পেতাম, আপনার প্রশ্ন করার আগেই আমি তাকে/তাদেরকে নিয়ে আলাপ শুরু করে দিতাম। আমি পাঠক হিসেবে অতিসূঁচ মানসিকতার।

লম্বা সময় যাবত ধার দেখাতে না পারলে আমি তাকে সমাদরের সাথে ফ্লুক তকমা দিয়ে ফেলে দিতে পারি, দিয়ে থাকি।

 

ওয়াজেদ নবী:  এখন কি লিখছেন?

 

জামিল হাদী:  আপনার ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নগুলোর উত্তর। পরবর্তী বই দুটোর ছাঁচ নিয়ে ভাবছি। মানে মাথায় লেখালিখি চলছে। কলমে না।

 

ওয়াজেদ নবী:  আপনার কবিতার বিষয়বস্তু বা উপজীব্য নিয়ে বলুন।

 

জামিল হাদী:  যা সংজ্ঞামতে প্রতিষ্ঠিত আছে সেটার বিপরীত মত কী কী হতে পারে বা ঐ সংজ্ঞার ভেতরেই কিছু বাদ পড়লো কিনা সেসব ভাবা, ভেবে কিছু বের করতে পারলে তাই নিয়ে লেখা। যেটা কিক করে ব্রেনে যে এটাতো বলা যেতে পারে! এরকম আরকি। কোনো টপিক নেই।

 

অবিষয়ই আমার লেখার বিষয়। সংক্ষেপে বললে এমনই।

 

ওয়াজেদ নবী:  আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।

 

জামিল হাদী:  এবার তো ‘জেলাস লাগে’ আসছে। অর্থব প্রকাশন থেকে। এখন সেটার বিপনন আর প্রচারে ব্যস্ত আছি।

মেলায় সশরীরে যাবো কিনা এবার নিশ্চিত না। ভাবছি।

ওয়াজেদ নবী:  পাঠকদের থেকে একজন কবির প্রত্যাশা কি থাকে? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কি?

 

জামিল হাদী:  সবকিছুরই তো জানি প্রাণ আছে। পাঠক হলেন আমাদের কলমের প্রাণ, লেখালিখির প্রাণভোমরা তারাই। বহু তালেবর কমিটির হাঁটুভাঙ্গা কবিদের দেখেছি অহংকার করে এমন বলতে যে – আমি পাঠকের কথা ভেবে কিছু লিখি না, আমি আমার জন্য লিখি।

সেইসব ‘ভাবে সুনামি’ কিন্তু ‘কামে ফেণা’ মার্কা কবিদের ফেণা হয়েই মিশে যেতে দেখলাম এতোগুলো বছর ধরে। এখনো দেখে যাচ্ছি। আমি ব্লেন্ডিং এ বিশ্বাসী। নিরীক্ষা তো চলবেই। সেটাকে পাঠক ডাইজেস্ট কতটা করতে পারলো এই দায়ও তো আমারই। এখানে অহংকার দেখানোর নুন্যতম সুযোগ নাই। পাঠক গুনি না এসব যারা বলতো বা এখনো বলছে এদের কবিতার কাজ দেখবেন, সবকয়টা মার্কেট ধরার নেশায় মত্ত।

কুরআন, হাদীসের মতো অকাট্য দলিল ভিত্তিক ধর্মগ্রন্থকেও এরা ছাড় দিচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত কম জানাবোঝা স্কুল কলেজের নিব্বা নিব্বিদের আকৃষ্ট করতে এরা ধর্মবানীর সাথে মিলিয়ে ঝিলিয়ে প্রেম, পরকীয়া ঢোকাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে অসাধু জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ উচ্চ। আর কিছু তেলাপোকা রাইটার আছে, যারা এদের উপশাখা। ঐ স্টাইল ফলো করে রাতারাতি কবি খেতাব পেতে চাচ্ছে।

ফলশ্রুতিতে সবদিকেই অরাজকতা দেখতে পাচ্ছেন আপনি, আমি, আমরা।

 

আমি জানি আমার যারা পাঠক আছে তাদেরকে আমার কথা, তাদের মননে আবিষ্কারযোগ্য হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ আমি আমারটাও রাখি, পাঠকেরটাও ভাবি। সহজ হিসাব কিতাব।

 

ওয়াজেদ নবী:  প্রকাশকদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য চাই।

 

জামিল হাদী: বাংলাদেশে ব্যবসা বোঝেন এমন প্রকাশক অনেক আছেন। টাকা দিলেই নয়নাভিরাম বাহ্যিক সৌন্দর্যে ভরপুর বই তারা করে দিতে পারেন, যেসব কাজের কিছু কিছু ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ডেও রাখা যায়। তবে সত্যিকার অর্থে ভালো রাইটারকে তুলে আনার পাশে কেউ নেই। গ্রুমিং বা প্রণোদনা যাই-ই বলি কেউ নেই। কেউ কেউ এরকম করার সু-বাসনা নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইলেও তিনি দুই তিন বছর পর ময়দান-আউট হয়ে যাচ্ছেন। কারণ গিমিকে বাজার ভরে গেছে। এখানে একজন বা দুইজন প্রকাশক আলাদা ভাবে ভেবে কিছু করতে পারবেন না। কারণ পেটের দায় সবারই আছে।

 

আমাদের কাজটা এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। শুধু লেখালিখি নিয়ে মনোনিবেশ করতে পারছি না। দশবছর ধরে টাইপোগ্রাফিও শিখছি, ভিডিও এডিটিং শিখছি তিন বছরের মতো। লেখালিখি বাদে এইসব শেখাশিখি আমাকে মারাত্মক বিরক্ত করে যেহেতু আমি পুরোনোপন্থী মানুষ। তবু প্রেজেন্টেশনের যুগে এসবে না জড়িয়েও উপায় নেই।

 

আমার কথা সিম্পল – যার লেখা ভালো মানের মৌলিক রস সমৃদ্ধ হবে তাকে নিয়ে প্রকাশকরা দৌড়াবেন, নিজের লেখা নিয়ে নিজেকেই দৌড়াতে হলে আসল কাজ কখন করবো।

তবে আশাজনক ব্যাপার হচ্ছে অনেক প্রকাশককেই ২০২২/২০২৩ এ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে দেখছি।

ধন্যাঢ্য ব্যক্তি, সরকারী, বেসরকারী অফিসার আর তাদের বউদের বই তিন চার বছর খোরাকি চালাবে তাদের, এরপরতো আমাদের কাছেই ফিরতে হবে প্রকাশকদের। মানে দম আছে এমন লেখকদের কাছে।

কবি জামিল হাদী
কবি জামিল হাদী

ওয়াজেদ নবী:  কবির কি স্বীকৃতি প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?

 

জামিল হাদী:  রুচিশীল দর্শক যাকে মান্যতা দেয় সেই নায়ক। প্রজ্ঞাবান শ্রোতা যাকে শুনতে চায় সেই গায়ক,

মননশীল পাঠক যার লেখা নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে সেই কবি, সেই লেখক। কোনো স্বীকৃতির দরকার নাই।

 

কবি লিখে লিখে নিজেকে যতটুকু প্রতিষ্ঠা করেন ওইটুকুর বাইরে আর কী প্রতিষ্ঠা আছে আমি আসলে জানি না।

 

ওয়াজেদ নবী:  লোকে বলে কবিরা ভাতে মরে- এ নিয়ে কিছু বলুন

 

জামিল হাদী: কথা সত্যি। শুধু কবি কেন! আর্ট মাধ্যমে যারা কাজ করেন, তাদের কারোরই ফিক্সড ইনকাম নেই। নয়টা ছয়টা অফিস তো না এইসব কাজ। আর যাতনা না থাকলে শিল্প ক্যানভাসে জায়গা পায় না। তাই ভাতে মরার বিষয়টাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েই নামতে হবে। সাহস দেখাতে হবে। এই ব্যাপারে আমি ওস্তাদ কামরুজ্জামান কামু ভাইয়ের একটা কথাকে বেদবাক্য ভাবি। উনি ফেসবুকে একবার লিখেছিলেন – আজ থেকে বাংলাদেশে সাহিত্য চর্চা করতে আসবে এরকম যে ছেলেটা বা মেয়েটা ভাবছে, সে যেন আগে বিকল্প একটা অর্থসংস্থান নিশ্চিত করে এরপর আসে। কামু ভাই কিন্তু আমার সেই চার/পাঁচ মহীরুহের একজন।

 

ওয়াজেদ নবী:  একজন লেখক কবির জন্য পড়াশোনা কতটুকু জরুরী?

 

জামিল হাদী:  পড়াশোনাটাই তার সাহিত্য। অক্সিজেন না নিলে বাঁচবো? পড়াশোনাও তাই। জরুরী না এটা, অত্যাবশ্যকীয়। এই কাজ বাদ রেখে মানে পড়াশোনা না করে, না চালু রেখে কেউ তার মৌলিকত্ব খুঁজে পাবে না। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সেটাকে আমলে নেয়া মূর্খামি হবে।

 

ওয়াজেদ নবী:  নিজের লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা জানতে চাই।

 

জামিল হাদী:  আমার পাঠক হচ্ছে আমার প্রেস, আমার আজন্মের প্রকাশনী। তারাই আমার লেখা অগণিতকাল, আলোকবর্ষ কাল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে বলে দিয়ে যাবেন, জানিয়ে দিয়ে যাবেন, মুখে মুখে ছাপিয়ে দিয়ে যাবেন। এই বড় স্বপ্নটা দেখি।

 

অনেক প্রাপ্তি। প্রাপ্তির কোটা কানায় কানায় ভরে আছে।

 

ওয়াজেদ নবী:  প্রকাশিত বই নিয়ে বলুন।

 

জামিল হাদী: ২০১৯ এ প্রথম বই এসেছে। এরপর থেকে তো টানা লিখছি। ফেসবুকেই লিখি সব। আর আপনার ওয়েবম্যাগ তো আমার আতুঁড়ঘর। ফেসবুক বাদে দুই এক জায়গায় যা লেখা ছাপা হয়েছে তার সিংহভাগই এখানে। ভালোবাসা নেবেন। আমি কৃতজ্ঞচিত্ত স্মরণ রাখি আমাকে যারা নির্মোহ ভালোবাসেন তাদেরকে। আপনি তাদের একজন।

 

ওয়াজেদ নবী:  যারা লিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

 

জামিল হাদী: এতোক্ষণ যা বললাম সবই তো তাদের উদ্দেশ্যেই বললাম।

ওয়াজেদ নবী: আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য পরমপাঠ পরিবারের তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার কবিতার জন্য আমাদের শুভকামনা।

জামিল হাদী::  আপনাদের জন্যও শুভকামনা।

 

আরও পড়ুন- এনামূল হক পলাশের সাক্ষাৎকার

ফেসবুকে আমাদের ফলো করুন- পরমপাঠ সাহিত্য পত্রিকা