জীবনানন্দ দাশের গল্প
মানুষের মুখের আভা
রাত দুপুর-স্টেশনে ভিড় কম নয়, কিন্তু প্রসন্নবাবুকে বাছিয়া লওয়া শক্ত নয়, কিন্তু প্রসন্নবাবুকে ধরিয়া লওয়া শক্ত নয়—ওই তো, ওই না দাঁড়াইয়া আছেন লম্বা-চৌড়ো মানুষটি—ভারী শৌখিন চেহারা, শাদা চাপদাড়ি।
হ্যাঁ, ওই তো প্রসন্নবাবু, একটা মোটা বর্মা-চুরুট জ্বালাইয়া লইয়া বুড়ো-মানুষ দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কুলির সঙ্গে বচসা করিতেছে।
শচীন তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া প্রণাম করিয়া লইয়া বলিল – ভালো আছেন
দাদাবাবু?’
প্রসন্নবাবু চশমার ফাঁকের ভিতর হইতে একবার উদাসীনভাবে তাকাইয়া-ও, তুমি?’ তারপরেই কুলির সঙ্গে তর্ক করিতে লাগিলেন আবার।
শচীন একপাশে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল, বলিল—’এদের সঙ্গে কথা বলে শেষ করতে পারবেন না দাদাবাবু, বরং আমিই কথা বলি।’
_‘থাক, তোমায় বলতে হবে না কিছু, আমার কর্তব্য আমি বুঝব।’
দাদাবাবুকে বাধা দিতে গেল না আর শচীন, বাধা দিয়া কোনো লাভ নাই, ইনি নিজের নিয়মে চলেন। মিনিট চার-পাঁচ কথাবার্তার পর কুলির সঙ্গে একটা বে-আন্দাজি দস্তুর ঠিক হইল।
প্রসন্নবাবু কুলিকে বলিলেন—’নাও মোটমাট তুলে নাও এখন।’ শচীনের দিকে ঢাকাইয়া—‘আমি যে আজ এখানে আসব তা তুমি কি করে জানলে?’
—বেশ মানুষ আপনি দাদাবাবু, তিনকড়িবাবুকে চিঠি লিখলেন, অথচ আমাদের একটু খবরও দিতে পারলেন না।’
—সে আমার অভিরুচি, কিন্তু তিনকড়িকে আমি যে ভালো মানুষ বুঝে লিখেছি সে তার অপব্যবহার করেছে দেখছি।’
– কেন?’
–“আমি যে চিঠি লিখেছি তাকে, এখানে আসছি সে-সব কথা তোমাকে বলতে গেল যে বড়।’
—’না, নিজের থেকে সেধে বলেননি কিছু।’
– তবে?’
—কথায় কথায় সেদিন আপনার কথা উঠল, তিনকড়িবাবু বললেন বুধবারের রাত্তিরের গাড়িতে আপনি আসবেন।’
কে?’
—বড় বেশি কথা বলে তিনকড়ি, হাড়হাভাতের একশেষ।’
চুরুটে দু-একটা টান দিয়া লইয়া বলিলেন—’তা তোমাকেই-বা স্টেশনে পাঠাল
—’আপনাকে নিতে এলাম।’
—’তিনকড়িরই-বা খবর কি?’
‘তার বড্ড অসুখ।’
—“কি অসুখ?’
—অনেকদিন থেকে শূলের বেদনা, এই সাতদিন হল বড্ড বেড়েছে, বিছানার থেকে উঠতেও পারেন না।’
—“তিনকড়ির বাসায় আর পুরুষমানুষ কেউ নেই?’
– ‘না।’
—’একটা চাকর অবদি না?’
– “না, ঠিক না-ঝি দুবেলা কাজ করে দিয়ে চলে যায়।’
—“তিনকড়ির ভাইপো হীরেন কে’—বলিয়া প্রসন্নবাবু চুরুটে দু-তিনটা টান দিয়া কুলিকে বলিলেন—‘রোস, সবুর কর, এখন মালপত্র মাথায় চড়াতে ওঠাতে হবে না— একটু দেরি আছে, বোস, গোটা দুই বিড়ি টান যা, চারআনা পয়সা না হয় বেশি বকশিস পাবি, সবুর কর।’
– না, সেই হীরেন অনেকদিন হয় কলকাতায় চলে গেছে।’
—’তিনকড়ির তাহলে শূলের ব্যথা চিড়িক দিয়ে উঠেছে বুঝি?”
–’আজ্ঞে হ্যাঁ।’
–‘দেখে কে?’
—মধু কবরেজ ।’
—“বেশ।’ একটু ভাবিয়া বলিলেন—’তাই হবে। আমি বলি চিঠি লিখলাম তবুও সে মানুষ স্টেশনে নেই। তা এইই তো হবে। নিজে আসতে পারল না, তোমাকে পাঠাল তাই? তা তোমাকে পাঠাল কেন? তিনকড়ির একমাত্র বন্ধু তুমি নাকি?’
শচীন কোনো জবাব দিল না।
প্রসন্ন—‘তোমার সঙ্গে এত যে সদ্ভাব তা তো জানতাম না, তাহলে পোস্টকার্ডে যে তিন লাইন তিনকড়িকে লিখেছি তিনকড়িকে তাও লিখতে যেতাম না। সোজা কোনো এক হোটেলে-ফোটেলে গিয়ে উঠতাম।’
শচীন—দাদাবাবু আমাদের ওপর বড্ড চটে গেছেন দেখছি, গতবার যখন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল’-
জীবনানন্দ দাশের গল্প
প্রসন্নবাবু বাধা দিয়া—‘গতবার? সে তো প্রায় তিন বছর আগের কথা!’
—“হ্যা। আমার শ্বশুরবাড়িতে। সেই সদাশিব মানুষ, দাদাবাবু মানুষের ওপর চটা তো আপনার অভ্যাস নয়।’
প্রসন্নবাবু চুরুট টানিতে টানিতে কোনো উত্তর দিলেন না।
শচীন—’চলুন।’
—কোথায় যাব?’
–‘আমাদের বাসায়।’
– ‘এ দেশে যদি কোনো ভদ্রলোকের বাসায় উঠি তাহলে তিনকড়ির ওখানেই উঠব।’ “তিনকড়িবাবুকে তো আমি বলে দিয়ে এসেছি যে তার বাসায় উঠবেন না আপনি।’
-“তাহলে কোথায় উঠব?
“তিনকড়িবাবু জানেন যে স্টেশন থেকেই আপনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব, সব ব্যবস্থাও করা হয়েছে।”
“তিনকড়ি আর বউমা তাহলে এখন ঘুমুচ্ছে?” —’হ্যাঁ, খুব নির্বিবাদে ‘
প্রসন্নবাবু ঘড়ি দেখিয়া কহিলেন—’রাত তো একটা।
—আর দেরি করা যায় না দাদাবাবু, চলুন।’ দাদাবাবু চলিলেন বটে, কিন্তু ওয়েটিং রুমের দিকে । কুলিও সঙ্গে সঙ্গে জিনিসপত্র লইয়া সেইখানেই রাখিল
একটা মস্তবড় বেতের ইজিচেয়ারে বসিয়া প্রসন্নবাবু আর একটা চুরুট জ্বালিলেন । শচীন— ‘ব্যবস্থা তাহলে আপনার এইরকমই হল?”
—হ্যাঁ, আজকের রাতের মতো, তারপর কাল সকালে’-
—“আপনি আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের মানুষ, শ্বশুরের বড় বন্ধু, পার্বতীও দাদাবাবুর নামে অজ্ঞান, অথচ আপনি’—
—’পার্বতীর কাছ থেকেই তোমাদের সংসারের সমস্ত পরিচয় পেয়েছি আমি, তারপর আর দুদণ্ডের জন্যও সে জায়গা মাড়াতে ইচ্ছা করে না।’
‘পার্বতী আমাদের নামে কি বলল আবার?’
-মুখে বিশেষ কিছু বলেনি সে, কিন্তু তার আপাদমস্তক সমস্ত চেহারাখানাই অনেক কথা বলে। সোনার প্রতিমার মতো মেয়ে ছ-বছর শ্বশুরবাড়ি করে এসেই একেবারে পাকসিটে ইতর চেহারা বানিয়ে ফেলল, তোমাদের জীবনের কদর্যতা—’
—’এখানে এলেই পার্বতীর শরীর কেমন ভেঙে পড়ে দাদাবাবু, আমি—’
—’পার্বতী বলেই কেন শুধু, তোমাদের সংসারের সব মেয়েমানুষদের দিকেই তাকিয়ে দেখো, এ সংসারে এলেই কেমন একটা অকথ্য কদর্যতা তাদের ঘিরে ধরে, বুকের ভিতর অপরিতৃপ্তি নিয়ে বাসা বাঁধে, তারপর তাও যায় শুকিয়ে, মানুষ নামে এক একটি সাক্ষাৎ অমানুষ হেঁসেলে রোয়াকে উঠানে ঘুরে বেড়ায়। চুরুটে টান দিয়া প্রসন্নবাবু—’এরা নিজেরাও যেমন কষ্ট পায়, অন্যকেও তেমনি দুঃখ দেয়। এরা মনে করে মানুষের জীবনের মূল কথা হচ্ছে সহিষ্ণুতা ও বেদনা।
-তা ঠিক নয় দাদাবাবু।
-“কিন্তু বেদনা ও সহিষ্ণুতার ভিতরেও অনেকখানি মাধুর্য যে আনতে পারা যায়, সাংসারিক নানারকম অভাব অপরাধের মধ্যেও দাক্ষিণ্য সহানুভূতি কল্পনা ও উপলব্ধির সাহায্যে জীবনটাকে যে স্নিগ্ধ সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে পারা যায়, এরা তা কিছুতেই বুঝবে না। এক-একজনে এক-একটা পোড়া কাঠ। ভিতরে আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে, যেকোনো মুহূর্তে বিৱসভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়তে পারে।’ প্রসন্নবাবু চুরুটের ঘই ঝাড়িয়া ফেলিয়া বলিলেন- তোমরা মনে করেছিলে পার্বতীর এরকম জীবনে রূপান্তরিত হবে।’ মাথা নাড়িয়া বলিলেন— ‘না, তা হয় না। সে সে জাতের মেয়ে নয়।’ চুরুটটা নিভিয়া গিয়াছিল, পকেটের থেকে দেশলাই বাহির করিয়া প্রসন্নবাবু—‘তাই খুব তাড়াতাড়িই তোমাদের সংসার ছেড়ে চলে গেল পার্বতী, আমি যতদূর জানি বাপের বাড়ি থেকে সে আর ফিরবে না।—তোমার ঠাকুরদা যতদিন বেঁচে ছিলেন তোমাদের বাড়িতে প্রায়ই আমি আসা-যাওয়া করেছি, তখনই আমি বুঝেছিলাম জীবনের সুন্দর ব্যবহারে সে মানুষটি যেমন সমৃদ্ধ তার ছেলেপিলেরা তেমনি অধম।’ চুরুটে এক টান দিয়া প্রসন্নবাবু—‘এই তো চার বছর আগেও একবার এসেছিলাম তোমাদের এখানে পার্বতী তখন প্রায় বছর দেড়েক হল তোমাদের বাড়ি বধূ হয়ে এসেছে। তুমি গিয়েছ কলকাতায়, টিউশান করছ, দেশের বাড়িতে তোমার ঠাকুরদাদা মৃত্যুশয্যায়, তোমাদের সংসারের যে বিকৃত রূপ দেখলাম আমি ইহজীবনেও তা ভুলব না।’ চুরুটে আবার এক টান দিয়া বলিলেন—‘জীবনের যত ছোট কথা, ছোট রুচি, ছোট কাজে এইসব নিয়ে দিনরাত আস্তাকুঁড়ের মাছির মতো গিজ গিজ সংসারে স্ত্রী-পুরুষে মিলে ভন ভন করছে, দেখে জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে হয়।’ ছাই ঝাড়িয়া লইয়া—‘পার্বতী কোনোদিন এরকম সংসারের আওতায় বড় হয়নি। এ সংসারকে ধিক্কার দিয়ে যে সে চলে গিয়েছে তার সাহসের ধন্যবাদ দিই আমি। একটা অনর্থক দুঃস্বপ্নে নিজের জীবন বিড়ম্বিত করে কি লাভ? শেষপর্যন্ত আমাদের সকলের জীবন আমাদের নিজেদের রুচি শ্রদ্ধা নিয়ে কারু ওপর কারু অধিকার নেই।’
শচীন চুপ করিয়াছিল।
—“জীবনে তোমাদের কোনোদিক দিয়েই কোনো মহত্ত নেই, সান্ত্বনা নেই, সৌন্দর্যও নেই। সৌন্দর্য নেই তোমাদের জীবনে। টাকা আছে কি না—আছে জানি না আমি, কিন্তু সৌন্দর্য নেই। একটা মাছরাঙাকে গাছের ডালে বসে থাকতে দেখলে, তার গর্ত খোঁজে যারা তোমরা সেই জাতীয় জীব। গর্তের অন্ধকারেই তোমাদের জীবন, আকাশের রৌদ্র ও নীলিমা তোমাদের শরীরে রস সঞ্চার করে, তোমাদের শরীরে মাত্র, কিন্তু অন্যকোনো উন্মুখতা জানায় না। তোমরা এইরকম লোক আমি দেখছি তা। তোমরা শরীরের জীব। এরকম জীব বড় জঘন্য হতে পারে, তা তোমরাই হয়েছে। তোমাদের কোনো আত্মা নেই। ঘরের ভিতর ঢুকে তোমাদের দরিদ্র মলিন অকার সংসারের ভিতর ঢোকো যখন সৌন্দর্যের যেটুকুও প্রতিবিম্ব পড়েছিল তোমাদের চোখেও তাও মুছে যায়। বিড়ালের মতো হাড় তোমাদের সংসারের মেয়েদের, হ্যাঁ বিড়ালের মতো হাড় তাদের। হাঁড়ির কালি মাখা বিড়ালের মতো চেহারা। তাদের জন্যও কোনো আত্মা রাখোনি তোমরা। তোমাদের সংসারে মেয়েদেরও কোনো আত্মা নেই।’ প্রসন্নবাবু—’হ্যাঁ, জীবন চালাতে গিয়ে এই মূলমন্ত্রটা সবচেয়ে আগে বুঝে নিতে হবে, তা না হলে সারা জীবন আত্মপ্রতারিত হয়ে ফিরতে হবে। পৃথিবীর দুঃখের মাত্রাও বাড়ানো হবে।’ প্রসন্নবাবু চুরুটে একটান দিয়া—’তোমাদের বাড়ির লোকের দস্তুর হচ্ছে বাইরের জগতে তোমরা জুজুবুড়ীর মতো হাঁটো, তোমাদের মতো সর্বত্যাগী জীব বৈষ্ণবরুচির আর দুটি নেই। কিন্তু নিজেদের দরিদ্র মলিন অন্তঃসারশূন্য সংসারের ভিতরে ঢুকে তোমরা একজনকে প্রবল ও নৃশংস যে মনে হয় বিধাতার জগতে যত আকাঙ্ক্ষা ঈষা ও হিংসা আছে তা তোমাদের পক্ষে ঢের কম। চুরুটটা নিভিয়া গিয়াছিল। আর্ম-চেয়ারের হাতলের উপর রাখিয়া দিয়া প্রসন্নবাবু – দড়ির মতো চেহারা তোমাদের, মুখ চোখেও না আছে লাবণ্য, না আছে দীপ্তি অথচ পদে পদে কান মলে চোখ রাঙিয়ে সংসারের কাছ থেকে কানাকড়ি আদায় করে নেয়াই তোমাদের ধর্ম— তোমাদের সংসারের শিশু, নারী ও চাকর-বাকরের কাছে তোমরা যে কত অবাঞ্ছিত কদর্য ভিখিরি তা তোমরা বোঝো।
জীবনানন্দ দাশের গল্প
এক-আধ মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া প্রসন্নবাবু—“তোমাদের মন এমন পক্ষাঘাতে মুষড়ে গেছে যে সে সব উপলব্ধি করবার শক্তিও তোমাদের নেই। চুরুটটা হাতে তুলিয়া লইয়া প্রসন্নবাবু—‘তোমাদের নারীরাও পদে পদে তোমাদের সহায়তা করে, একটা শ্রীহীন আনন্দহীন জীবনত সংসার বানিয়ে তুলতে স্বেচ্ছায় তারাও রক্ত ঢেলেছে কম নয়। নারীত্বকে ভাঙিয়ে খেতে গিয়ে তোমাদের পৌরুষ কত ফোটে। চুরুটটা জ্বালাইয়া লইয়া বলিলেন—’জেঠা, খুড়া তোমার আটটি।’ একটু চুপ থাকিয়া বলিলেন——তোমার ঠাকুরদাদা যদি বুঝতেন যে সন্তানেরা তার নিজের মনুষ্যত্ব কেউই পাবে না, সকলেই অল্পবিস্তর খবিশ হয়ে জন্মাবে তাহলে সন্তানের জন্ম দিতে যেতেন না তিনি নিশ্চয়ই।’ আবার একটু নিস্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন—’পিসিমাও তো তোমার চার-পাঁচটি।’
-‘চারজন।’
—’শুনলাম তোমার বড়জেঠামশাই নাকি মারা গেছেন?’
-“হ্যাঁ, মাস তিনেক হল গিয়েছেন।
—’কীসে গেলেন?’
-‘যক্ষ্মায়।’
প্রসন্নবাবু একটু চুপ থাকিয়া—‘তিনি না তিন সংসার করেছিলেন?’ – ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
—’মৃত্যুর বছরখানেক আগেও একবার বিয়ে করলেন।
শচীন মাথা নাড়িয়া বলিল।
—হ্যাঁ তাহাই করিয়াছিলেন।
প্রসন্নবাবু খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া-‘তোমার জেঠামশাইকে আমার খুব মনে পড়ে। দিনরাত রুক্ষ-বিরস গলায় শিবস্তোত্র আওড়াতেন। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সে অভ্যাস ছিল বোধকরি। ছিল? হ্যাঁ থাকবেই তো। মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এল ভালো লক্ষণ বেশ বেশ। চুরুটে একটান দিয়া— ‘জীবনের অভিজ্ঞতাও তার বিচিত্র, গভীরও কম নয়। অনেক পড়াশুনোও করেছিলেন। অথচ অমানুষ নারীর জীবন নিয়ে এই রহস্য করে গেলেন। শচীনের দিকে তাকাইয়া প্রসন্নবাবু—’তোমাদের প্রথম জেঠিমার কথা মনে
—হ্যাঁ, তখন আমরা ইস্কুলে পড়তাম।’ -তারপর, তিনি মারা গেলেন কবে?’ -‘আমরা ইস্কুলে থাকতে-থাকতেই।’
—’তোমরা দ্বিতীয়—জেঠিমা যখন প্রথম ঘরে এলেন স্মরণ আছে হয়তো?’; -“আজ্ঞে হ্যাঁ।
-“কত বয়স ছিল তাঁর?’
-‘পার্বতীর সমান।’
-‘আমারও বেশ মনে আছে, তোমার ঠাকুরদার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই বিয়ে করা হয়েছিল। বউ যখন ঘরে এল দেখলাম এমন ছেলেমানুষ! জীবনের কি ভয়াবহ অন্ধকার আড়ম্বরের ভিতর পড়ে গেছে সে সম্বন্ধে একটুও জ্ঞান নেই তার, এমনই নির্বোধ মেয়েটি! মন তার নিরপরাধ প্রসন্নতায়, বিহ্বল, চারদিককার অমানুষিক পৈশাচিকতাকে উপলব্ধি করবারও শক্তি নেই, এমনই শিশু।
জীবনানন্দ দাশের গল্প
নির্বাপিত চুরুটটার দিকে তাকাইয়া প্রসন্নবাবু—যাক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুনলাম বেচারী শিশুপ্রসব করে মারা গিয়াছে—মনে হল অনেকদিন পর্যন্ত এরকম সুখবর আমি পাইনি।’ চুরুটটা জ্বালাইয়া লইয়া প্রসন্নবাবু—‘জীবনের প্রতারণা ও কদর্যতার থেকে দুটি প্রাণী কি গভীর সুন্দরভাবে রক্ষা পেল।’ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া—‘কিন্তু বেদনার দেবতার মাত্রাবোধকে ফাঁকি দেয়া বড় কঠিন। যে দুঃখ আমি এড়ালাম, সেদুঃখ শূন্যে শূন্যে ঝুলে বেড়াবে না তাই বলে, আর একজনের জীবনকে জর্জর না করে ছাড়বে না। সৃষ্টির স্রোতের ভিতর এমনই ক্ষমাহীন নিয়মের সাজসজ্জা।’ চুরুটে এক টান দিতে গিয়া দেখিলেন চুরুটটা নিভিয়া গিয়াছে আবার। পোড়া চুরুটটা আর্ম চেয়ারের হাতলের উপর আস্তে আস্তে রাখিয়া দিয়া বলিলেন—‘এই তৃতীয় পক্ষের মেয়েটি এল তাই। সেই মৃতবৎসা মৃতা ক্ষীরোদার জায়গায় একে আসতে হল। কোনো নড়চড় নেই, রেহাই নেই, তোমার জেঠামশায়ের জীবনটাকে অবলম্বন করে পৃথিবীতে যে দুঃখের পরিমাণ পূর্ণ হবার কথা ছিল,তা হবেই। বেদনা বহন করবার লোক বদলায় শুধু বেদনা বদলায় না। একজন মরে শান্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু আর একজনকে সমস্ত দাম চুকিয়ে দিতে হচ্ছে তাই। দেখো, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার এ জেঠিমার দুঃখ কত মর্মভেদী হবে,অথচ তোমাদের ধর্মকে স্পর্শও করবে না। জীবনের ব্যবস্থা এমনই ভয়াবহ।’ বলিলেন—‘কি নাম এই মেয়েটির?’
——জেঠিমার? শ্রীযুক্তা শৈলবালা দেবী ।’
—‘পার্বতীর চেয়ে ছোট। মা-বাপ নেই?
—’আছে।’
—’বাপের বাড়িতে যায় না?’
—“না। সেখানকার অবস্থা বড় খারাপ।
—“এখানকার চেয়েও।’
—’হ্যাঁ।’
একটু চুপ থাকিয়া—শৈল দেখতে কেমন?’
—সুন্দরীই বলতে হবে।’ ‘পার্বতীর চেয়েও?’
শচীন একটু ইতস্তত করিয়া মাথা নাড়িয়া—’হ্যাঁ, তা হবে বইকী।’ ‘তাহলে তো দস্তুর মতো সুন্দরী, পরমাসুন্দরী বলো।’
শচীন ঘাড় নাড়িয়া——তাই।’
প্রসন্নবাবু একটু বিচলিত হইয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর বলিলেন—’যাক। অনন্ত রূপের ভাণ্ডার তো বিধাতার হাতেই। তাই দুঃখ করি না আমি আর। রূপ নিয়ে এরকম নির্বিকারভাবে খেলা করবার অধিকার তার খুবই আছে।
শচীন চুপ করিয়াছিল।
প্রসন্নবাবু—‘বুদ্ধিসুদ্ধি কেমন এ মেয়েটির?”
শচীন একটু হাসিয়া—‘আমাদের চেয়ে একটু কম নয়। —’খুব বিমর্ষ?’
না। বেদনা বা অ’নন্দ নিয়ে আত্মবিহ্বলতা নেই এর।’
—“নারীর কর্তব্য বলতে তোমাদের অমানুষ সংসার যা মনে করে তা নিয়মিত পালন করে।’
শচীন—‘একে আমাদের সংসারের সকলেই খানিকটা ক্ষমা করে চলে।’
—“পিশাচ তোমরা! তোমরা আবার ক্ষমা করো মানুষকে! কেন এসব মিথ্যা কথা বলো আমার কাছে!’
শচীন একটু হাসিয়া—‘পৃথিবীতে এমন এক-একজন সেই ভাগ্যবতী জন্মদুঃখিনী থাকে যাকে ক্ষমা করতে গিয়ে লোক দেখাবার সাধ জাগে না, দাদাবাবু কর্তব্যের পীড়াও থাকে না, হৃদয় নিজের থেকেই বিমুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে পড়ে।’
প্রসন্নবাবু চুরুট জ্বালাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। চুরুট জ্বলিয়া জ্বলিয়া নিভিয়া গেল। ছাইয়ের দিকে তাকাইয়া তিনি বলিলেন——তার রূপের জন্যই তো এই। কিন্তু তোমাদের সংসারের অসচ্ছলতা ও সংগ্রামের ভিতর রূপ তো তার পুরস্কার পাচ্ছে আজ। তোমাদের হৃদয়ের বিমুগ্ধতাও কোনো নতুন বিষয়বস্তু খুঁজবে হয়তো তখন। কিন্তু এ মেয়েটিকে নিয়মিত থান কাপড় কিনে দিও—কুকুর বেড়ালের চেয়ে খানিকটা সম্মান ও আশ্রয় দিতে ভুলো না। প্রসন্নবাবু বললেন—‘সেই ভজহরি
আজকাল কোথায়?’
——ভজুকাকা? বাসায়ই আছেন।’
—“কি করে আজকাল?’
——কতকগুলো এজেন্সি নিয়ে বসেছে।’
—“টাকাকড়ি পায়?’
শচীন মাথা নাড়িয়া—’না, এজেন্সিগুলো বিদেশি কিনা।’
—“তবে যে নিতে গেল!’
—ভেবেছিলেন লাভ হলে খুব হবে, বেশ চড়া কমিশন।’
–তোমার এই কাকাটি বরাবরই এইরকম। শরীর কেমন আছে?’
–‘ভজুকাকার? সুবিধার না।’
– কেন?’
——পেটের গোলমাল।’
——হ্যাঁ, তা আমি ভজহরির ছোটবেলার থেকেই দেখছি দাঁত মাজে না, খাবার লোভেই খেত শুধু, ডিসপেপসিয়ার জন্য ইস্কুলে, মানুষের বাড়িতে, সভ্য মজলিশে কোথাও বেচারী দু-দণ্ড নিরাপদে বসতে পারত না—নিজেকে কষ্ট দিত, মানুষকেও বিব্রত করে তুলত। বাপের বাক্সের থেকে পয়সা চুরি করে ফিরিওয়ালার পচা মিঠাই খাবার শখ একদিনের জন্যও ছাড়তে পারল না ভজু। এরকম কদাকার কৈশোর ও যৌবন মানুষের কোনোদিন দেখিনি আমি।’ চুরুটে একটা টান দিয়া—দাঁত কটা আছে ভজুর?’
–‘একটাও না।’
——একটাও না! এই চল্লিশ বছরেই সব গেল। একটু চুপ করিয়া—‘দেখবার মতো মানুষ তোমার ঠাকুরদা—তার এমন অপ্রীতিকর সন্তান?’ ধি দ্বার দিয়া বলিলেন—‘গাঁজা ছেড়েছে?”
– হ্যাঁ।’
–‘সেইসব বদ অভ্যাস এখন আছে আর?’
শচীন মুখ তুলিয়া প্রসন্নবাবুর দিকে তাকাইল।
প্রসন্নবাবু’ […] করে কি এখন ও?’
–“কই, তা তো জানি না।’
প্রসন্নবাবু কথাটি চাপিয়া গিয়া—’শুনেছি এখন ধার্মিক হয়েছে ভজহরি। বলিলেন—‘এই তো বছর তিনেক আগের কথা, পার্বতী তখন এইখানেই ছিল, পুজার ছুটিতে তোমার ছোটশালী এসেছিল তোমাদের এখানে কয়েকদিন বেড়াতে। ভজহরি বললে সংসারে পুরুষ মানুষ গিজগিজ করছে, এর মধ্যে এরকম অবিবাহিতা অরক্ষণীয়া মেয়ে আসবে কেন? কোনো একটা কলঙ্ক হয়ে গেলে দায়ধারা কে দেবে। এইসব উচ্চাঙ্গের কথা বলে সে আজকাল।’ প্রসন্নবাবু ঠোঁট উলটাইয়া হাসিয়া বলিলেন—“কিন্তু তোমার সেই ছোটশালীকেই একদিন একা ঘরে অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে ভজহরি তাকে বলেছিল, বেশ একটা সুন্দর বই আপনাকে দেব (রবিবাবুর) ‘চোখের বালি’ পড়বেন? আজ সমস্তটা দুপুর পড়তে পড়তে অবাক হয়ে গেছি!’ বলিয়া প্রসন্নবাবু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন—’এসব কি জাতীয় মানুষ শচীন?
শচীন নিস্তব্ধভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল— ‘জানি না।’
—“যাক, এরকম অনেক বিচিত্র জীব তোমাদের তো সংসারের পথে—বিপথে, তার জন্যও ততটা নয়, তোমাদের অসচ্ছলতায়ও চলে যেত, কিন্তু আসল কথা পার্বতী তোমাকে ভালোবাসে না।’ প্রসন্নবাবু একটু চুপ থাকিয়া—’কিন্তু তবুও আমরা তাকে তোমার কাছেই আসতে বলেছিলাম—কিন্তু কিছুতেই পারা গেল না, মানুষের জীবন তো তার শরীর নিয়েই না শুধু—হৃদয়ই যত বিচিত্র গোলমাল বাধায়। পড়ন্ত সূর্যের সোনালি রৌদ্রের ভিতর একজন কুৎসিত মানুষের মুখের ভিতরও কেমন একটা আভা দেখা যায়। সেই আভা নিয়েই জীবন, শরীর নিয়ে নয়। শরীর দিয়ে না, মোটেই নয়— মানুষের জীবন এই আভা নিয়ে, আত্মা নিয়ে।
একটু চুপ থাকিয়া—’এই তো দেখো তোমার জেঠামশায়ের তৃতীয় পক্ষের বধূ প্রতি মুহূর্তেই মৃত স্বামীর নাম করে দিন কাটায়, অথচ তুমি সুস্থ সচ্চরিত্র মানুষ, পার্বতী তোমাকে দেখতে পারে না।’ বলিতে বলিতে প্রসন্নবাবু ঘাড় গুঁজিয়া ঝিমাইতে লাগিলেন। ঝিমাইতে ঝিমাইতে হঠাৎ চেয়ারের হাতলের উপর কপাল ঠুকিয়া গেল, ধড়মড় করিয়া জাগিয়া উঠিয়া প্রসন্নবাবু নিজেকে সামলাইয়া লইয়া দু-এক মুহূর্ত চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। একটা হাই তুলিয়া তুড়ি দিয়া——তুমি এখনো বসে আছ?’ শচীন মাথা নাড়িয়া একটু হাসিল।
প্রসন্নবাবু—’কি বলছিলাম, পার্বতী—তা পার্বতী এখন কি করে জান শচীন? ‘ শচীন চোখ তুলিয়া তাকাইল।
প্রসন্নবাবু—‘রোজ সকালে ঘুমের থেকে উঠে রোদে পিঠ করে বসে মস্তবড় কচুপাতায় তেল মাখিয়ে বড়ি দেয়।’
– কেন?’
-“অমূল্য বলে একটা ছোকরা আছে, পুলিশে কাজ করে, বড়ি দিয়ে তরকারি খেতে খুব ভালোবাসে—তাকেই দু-বেলা গরম গরম রেঁধে খাওয়ায়।’
প্রসন্নবাবু আবার ঘুমাইয়া পড়িলেন।
আরও পড়ুন- বিলাই বান্দরের গল্প