মুক্তগদ্যলোকসাহিত্য

তের থেকে ঊনিশ কথা- এ. কে. এম. ফিরোজ- গল্প

আমার ঘরে দেয়াল ঘড়ির পেণ্ডুলাম দুলছে। ঘড়িটা চলছিল। আমি দু’চোখ বন্ধ করে কল্পনার পঙ্খীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়লাম। ঘড়ির কাঁটা পিছনের দিকে চলতে শুরু করল। গত ৩৫ বছর আগে তার কাঁটাগুলো যেখানে ছিল, ঠিক সেখানটাতেই এসে থামল। আমি ডুবে গেলাম এক হিমশীতল অতীতে।

হারানো দিনগুলো দৃশ্যমান হতে লাগল। বাতাসে হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো টেপ- রেকর্ডারের মতো কানে বাজতে লাগল।

১৯৭১। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল। রাজধানী থেকে মরু এলে সে আমার বন্ধু হল। যতোই দিন গড়াচ্ছে, বন্ধুত্ব ততই গাঢ় হচ্ছে। মরু আমাকে পছন্দ করতো। হয়তো বা ভালোবাসত। প্রজাপতির রঙিন ডানা আমার দু’চোখে রঙিন স্বপ্ন এঁকে যেত। ছোট ছোট ঘাসফুলেরা মরুর হয়ে আমার সাথে গল্প করত। পাখির গানে আমি ওর কণ্ঠ শুনতে পেতাম। কখনো কখনো বিছানায় শুয়ে হাতের চেটোতে মাথা রেখে কল্পনায় তার সঙ্গে গল্প করতাম।

এক শীতের রাত। মরু লেপ গায়ে শুয়ে আছে। মাথার কাছে চেয়ারটাতে আমি বসলাম। তার হাতের ছোঁয়া অনুভব করছি। স্বাধীন বাংলা বেতারে দেশাত্মবোধক গান বাজছে- “সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি …।” গানটি মনে বসে গেল। সবকিছুর মধ্যে হৃদয়ের ছোঁয়া পেতে লাগলাম।

মরু আমাকে কিছু না বলে একদিন রাজধানীতে চলে গেল। একাকিত্ব আমাকে দারুণভাবে কষ্ট দিতে শুরু করল। আমি বন্ধুর ফিরে আশার পথে চেয়ে রইলাম। দিনের পর দিন কেটে যায়। মরু ফিরে আসে না। রাতের আকাশের তারা আর জোনাকিরা আমার বন্ধু হয়ে গেল। ওরা সবার অগোচরে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

এক জোনাক জ্বলা সন্ধ্যায় মরু ফিরে এল। আমি দারুণ খুশি। আনন্দেই দিন কাটছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর আমাকে ভুল বুঝতে শুরু করল। মরু আমাকে এড়িয়ে চলল। আমার সাথে কথা বলে না। পারিবারিক বিবাদ আমাদের বিচ্ছেদকে আরও ত্বরান্বিত করল। আমার আকাশ আরও দূরে চলে গেল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশ স্বাধীন হল। দু’দিন পরে মরু আমাকে বলল ২৮ তারিখে রাজধানীতে ফিরে যাবে। ওটাই ছিল আমার সঙ্গে তার শেষ কথা। ওরা চলে গেল। গুদের চোখে এবার নতুন সূর্যের রং। আর আমার আকাশ জুড়ে বিষাদের ছায়া। আজ স্বাধীনতার তিন যুগ পেরিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে সেই প্রিয় গানটি রেডিওতে বেজে ওঠে সোনা… সোনা… সোনা…। আমি দু’চোখ বন্ধ করে কান পেতে সেই গান শুনি। হারিয়ে যাই আমার ফেলে আসা অতীতে। একসময় সে মোহ ভেঙে যায়। সম্বিত ফিরে পাই।

তের থেকে উনিশ বছর বয়স হচ্ছে মারাত্মক সময়। ইংরেজিতে যাকে বলে টিনএজ। আমি তখন কৈশোরের চৌকাঠ পেরিয়ে তের বছরে প্রবেশ করছিলাম। পৃথিবীর সময় কারও জন্য বসে থাকে না। আমার জন্যও নয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ঝরে গেল একজোড়া কিশোর-কিশোরীর সোনালি স্বপ্ন। যা কেউ টেরও পেল না। আমি আজও জানি না কোন অভিমানে মরু আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রেখেছিল। তাহলে টিনএজ কী সত্যিই অভিশপ্ত?

আরও পড়ুন- দেহাতীত গল্প