দেহাতীত- আবদুর রাজ্জাক খান- গল্প
মুয়াম্মার গাদ্দাফির সবুজ বিপ্লবের আওতায় একটা কৃষি প্রোজেক্টে কাজ করি। তুর্কি মেহমেতদেরেও আমাদের টিমের সদস্য। দেরের চোখে মুখে সর্বদা পরিচ্ছন্ন একটা দার্শনিক ভাব লক্ষণীয়। আমি কেন দেরের পছন্দের লোক তা জানি না। ছুটির দিনে চায়ের দাওয়াত থাকত ওর বাসায়। আমি কোনো কারণে যেতে না পারলে দেরে চলে আসত আমার ক্যারাভ্যানে। ইংরেজি, আরবি ও কিছু তুর্কিস মিলিয়ে আমাদের ভাব বিনিময় হতো। দেরে খোলামনের লোক।
এখানে এলাম সৎভাবে দুটো পয়সা কামাব বলে।
স্বর্গের ন্যায় সুন্দর দেশটা রেখে কোথায় এসেছ, তুমি কী তা জান?
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, না জানি না।
পৃথিবীর উষ্ণতম স্থানের অন্যতম আজিজিয়া জোনের অন্তর্গত আবুসেবা প্রজেক্ট। সারা বছরই প্রায় সমান তাপমাত্রা ৪০° থেকে ৫০° সেলসিয়াস। তার সাথে আছে উত্তপ্ত ঝড়ো হাওয়া, ধুলোবালি মেশানো নরকযন্ত্রণা।
দেরে ভয় পেল না। বলে, তুমি কাজ করতে পারলে তোমার সাথে আমিও পারব। প্রবাসে পরিবার পরিজন ছাড়া যারাই বাস করে কমবেশি সবাই হোমসিকনেসে ভোগে। দেরে যখন আমার ক্যারাভ্যানে আসত, মুখ দেখেই আমি বুঝে নিতাম ওর মনের অবস্থা।
চা খাও দেরে।
না, খাব না।
আমার ফেমিলি গ্রুপফটো দেখেবে?
হ্যাঁ, দেখব।
ছবিটা হাতে নিয়ে প্রথম চুমু খায়। পরে বুকে নিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেলে।
অবস্থা দেখে আমি হত বিহবল। ওকে জড়িয়ে ধরি বুকে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলি, দেরে, ছুটিতে বাড়ি যাও- স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের একবার দেখে এসো। ওর কান্না থামে না মোটেই।
তুমি কী সেদিন দেখেছ, মা হারা বিড়ালের অসহায় ছানাগুলো কুকুরটির দুধ খেয়ে কীভাবে বেঁচে আছে? কুকুরের বাচ্চাগুলো বড় হয়ে ওদের স্বভাব মতো মা-এর কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। এদিকে মা-এর বুকে বাচ্চাদের জন্য প্রচুর দুধ জমেছে। কুকুরটা যখন পানিট্যাঙ্কের নিচের ছায়ায় গা এলিয়ে ঘুমোয়, বিড়াল ছানাগুলো দৌড়ে এসে পান করে কুকুরনীর দুধ। চোখ মেলে একবার চেয়ে দেখে কারা। কোনো নিজেকে সার্থক মা হিসেবে বিড়াল ছানাগুলোকে নিজের সন্তান ভাবে। দুধপানের প্রকার ঘেউ ঘেউ না করেই আবার চোখ বোজে। এভাবেই মাতৃস্নেহের ফল্গুধারায় সময় বিড়াল ছানারা ভুলেও একবার ‘মিউ’ ডাকে না।
শেষ হয় না দেরের কথা। নতুন ভাবে বলতে থাকে নিজের কাহিনী। ওর কণ্ঠ
ক্রমান্বয় ভারী হয়ে আসে।
আমার মোস্তফা যখন একমাসের শিশু এই বিড়াল ছানাদের বয়সী, তখনই ওর মাকে হারায়। আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রতিবেশীদের মধ্যেও কেউ আসেনি মোস্তফাকে একটু বুকের দুধ খাওয়াতে।
ক্ষোভে ও ক্রোধের ছবি ভেসে ওঠে দেরের মুখমণ্ডলে। এক পর্যায় চোখের পানি থেমে যায়।
মানুষকে খোদা আশরাকুল মাখলুকাত করে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষকে তুলনা করতে চাই না ওই অস্পৃশ্য পশুর সাথে। মোস্তফাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য একদিনের মধ্যে বিয়ে করে নিয়ে এলাম একটা রাঙা কুমারী বৌ। বাড়ি এনেই আমার মোস্তফাকে ওর কোলে দিয়ে বললাম দুধ খাওয়াও। লজ্জায় রাঙা বৌ-এর মুখ আরো রাঙা হয়ে উঠল। কুমারী মেয়েদের বুকে দুধ আসে না। তবুও বৌ আমার রক্তিম চোখ দেখে আড়ালে গিয়ে তার দুধের বোঁটা মোস্তফার মুখে দিতেই কান্না থেমে গেলে।
মায়ের দুধের বোঁটায় দুধ না থাকলেও দুধের বোঁটা মুখে নিলে সৃষ্টিকর্তার থেকে শিশু জীবনী শক্তি ফিরে পায়।
বৌ-এর আদর-যত্নে ক্রমান্বয়ে মোস্তফা বেড়ে ওঠে। আমাদের ঘরে একটা মেয়েও এসেছে। ওর নাম দরিয়া। মোস্তফার বয়স দশ। ভাইবোনে খুব ভাব। মোস্তফা আজও জানেনা কোনদিন জানবেও না যে ওর মা নেই।
সেটাই তোমার রাঙা বৌ-এর কৃতিত্ব। শোন দেরে, তবে সব সময় তুমি এমনটা পাবে না।
আরও পড়ুন- শঙ্খ ভালোবাসা গল্প