প্রচ্ছদবই আলোচনা

ন্যায়বিচারের অন্বেষণে- বই রিভিউ

গ্রন্থের নাম: ন্যায়বিচারের অন্বেষণে

গ্রন্থের ধরন: আইন বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন

লেখক: মোঃ সাইফুল ইসলাম

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: লেক্সিলেন্স,  সাহারা সেন্টার, ঢাকা- ১০০০।

প্রচ্ছদ: মীর আনোয়ার হোসেন

প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি,  ২০২৪

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬৪

প্রচ্ছদ মূল্য: ৪০০/- টাকা

ISBN:  ৯৭৮-৯৮৪-৩৫-৫০৬৮-২

 

ভূমিকা:

প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর যুগে বিচার ব্যবস্থা কিরূপ ছিল তা বলা মুশকিল। কালের বিবর্তনে কৃষি যুগে মানুষের সমাজবদ্ধ বসবাসের সূচনা হয়। সেই সময়গুলোতে অপরাধের প্রবণতা এবং ধরন স্বভাবতই কম ছিল।  অপরাধীদের বিচার হতো অনানুষ্ঠানিকভাবে কেননা আইন বা প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার তখনো উদ্ভব হয়নি। সমাজের কর্তা ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞান,  প্রজ্ঞা, সুবিবেচনা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। কালের পরিক্রমা এবং সময়ের প্রয়োজনে  ক্রমান্বয়ে অপরাধের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাওয়ায়  রাষ্ট্রকে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিশাল পরিসরে বিচারিক প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতি তৈরি করতে হয়েছে। বিশ্ব সময়ের প্রয়োজনে তৈরি করছে নতুন নতুন আইন ও পদ্ধতি যাতে অপরাধীরা অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে নিরুৎসাহিত হয় এবং অপরাধের সংখ্যাও কমে যায়। অদ্যবধি বিচার ব্যবস্থা পদ্ধতি  এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলমান আছে, লেখা হচ্ছে অজস্র গ্রন্থ।  তেমন একটি আইন বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন মো: সাইফুল ইসলামের  “ন্যায়বিচারের অন্বেষণে”

 

লেখক পরিচিতি:

বাংলাদেশের বিদ্যমান বিচার পদ্ধতি নিয়ে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, সেবার সহজীকরণ নিয়ে ভাবনা,  সেবা প্রত্যাশীদের হয়রানি বন্ধসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যাঁরা  নিয়মিত গবেষণা করে যাচ্ছেন  তাঁদের অন্যতম  একজন রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: সাইফুল ইসলাম।  কাছের মানুষদের কাছে  “পলাশ” নামে যিনি অধিক পরিচিত।  তাঁর জন্ম দিনাজপুর জেলায় হলেও পিতার চাকরির সূত্রে শৈশবের অনেকটা কেটেছে ঠাকুরগাঁও জেলায়।  পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১০ সালে চতুর্থ বিজেএস পরীক্ষার মাধ্যমে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পঞ্চগড় জেলায় চাকরিজীবন শুরু করেন।  পরবর্তী সময়ে জুডিসিয়াল সার্ভিসের বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায়।  ইতোঃমধ্যে তিনি অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত বিশেষ করে প্রবেশন এন্ড আফটার কেয়ার বিষয়ে   লেখালেখির মাধ্যমে দেশব্যাপি খ্যাতি অর্জন করেছেন।  এ পর্যন্ত তাঁর দুইটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

 

“ন্যায়বিচারের অন্বেষণে” গ্রন্থটির বিষয়বস্তু:

মজবুত মলাটে বাঁধা  দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদই বলে দেয় যে বইটির বিষয়বস্তু কি হতে পারে।  উন্নত মানের কাগজ আর ভরাট কালির অক্ষরে ছাপা বইটি, দুইটি বিশেষ অধ্যায়ে বিভক্ত।

প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে প্রবন্ধ সংকলন আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে আদালত পাড়ার গল্প৷

 

বইটিতে ৩৩ টি শিরোনামে ৩৩ টি স্বতন্ত্র  প্রবন্ধ রয়েছে যদিও প্রতিটি প্রবন্ধের উপজীব্য  একই বিষয় ঘিরে আবর্তিত আর তা হল “আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং আদালত প্রাঙ্গণের অব্যক্ত গল্প “।  আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে আদালত প্রাঙ্গণের  আবছা কাঠগড়া থেকে সাধারণ জনগণের সামনে উন্মুক্তভাবে উপস্থাপন করার যে প্রয়াস লেখক নিয়েছেন তার নিরেট ফসল এই “ন্যায় বিচারের অন্বেষণে: আইন বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন “।  মূলত এটি তাঁর প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ।  প্রথম গ্রন্থটি “প্রবেশন ও প্যারোল আইন: তত্ত্ব ও প্রয়োগ পদ্ধতি”  পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত  হয়েছে।  ইতোঃমধ্যে গ্রন্থটির তৃতীয় মুদ্রণ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।  প্রথম গ্রন্থটির ন্যায় এই গ্রন্থটিও  পাঠক মহলে বেশ সারা ফেলেছে বিশেষ করে আইন এবং প্রবেশন নিয়ে যাদের আগ্রহ তারা বইটিকে সাদরে গ্রহণ করছে।  উল্লেখ না করলেই নয়, বাংলাদেশে দিনদিন প্রবেশন পদ্ধতি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে পূর্বের তুলনায় প্রবেশনে মুক্তির হার বেড়েছে প্রায় ২৭ গুণ। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ হাজার প্রবেশনার প্রবেশন কর্মকর্তাদের তত্বাবধানে আছেন যা সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য সুখবরও বটে।

 

ন্যায়বিচারের অন্বেষণে  বইটি অপরাধীদের প্রতি  যেকোনো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। এখানে লেখক তাঁর  দীর্ঘদিনের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ পূর্বক  অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়গুলো সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। পাঠকের মনোযোগ বাড়াতে সহায়তা নিয়েছেন বিভিন্ন কেস স্টাডির৷

 

পুরো গ্রন্থ জুড়ে লেখক বিচার কার্যের তিনটি ধাপ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেছেন।  যেমন-

০১. বিচার পূর্ব ধাপ- মামলা দায়ের, তদন্ত ইত্যাদি।

০২. বিচার চলাকালীন ধাপ- সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামীদের হাজিরা ইত্যাদি।

০৩. বিচার পরবর্তী ধাপ- শাস্তি প্রদান, ফলো আপ ইত্যাদি।

 

লেখকের  মতে,  “মামলার ফরিয়াদি পক্ষ যেমন ন্যায় বিচার চায় তেমনি আসামি পক্ষও চায়। তাই বিচার বলতে শুধু আসামিকে শাস্তি প্রদানকেই বোঝায় না খালাস পাওয়াও ন্যায় বিচার। …অপরাধীদেরও কিছু অধিকার আছে যা দেশের আইন ও আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত।”

 

 

প্রকৃতপক্ষে, ন্যায়বিচারের অন্বেষণে বইটি দারুন তথ্যবহুল এবং তথ্যসমৃদ্ধ৷ বইয়ের প্রতিটি পাতায় লেখকের পাণ্ডিত্য এবং মুন্সীয়ানার পরিচয়  ফুটে উঠেছে।  লেখক মোঃ  সাইফুল ইসলাম যে একজন জ্ঞানপিপাসু, ভাবুক,  গবেষক এবং পড়াশোনায় আগ্রহী ব্যক্তিত্ব তাঁর সাক্ষী  প্রতিটি প্রবন্ধ। অপরাধীকে নিছক একজন অপরাধী হিসেবে গণ্য না করে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার নিরন্তর প্রচেষ্টা তাঁর সুপারিশগুলোতে পরিলক্ষিত হয়। তাই বেশিরভাগ প্রবন্ধে তিনি অপরাধীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থেকেছেন ।  বিশেষ করে প্রবেশন এন্ড আফটার কেয়ার, অপরাধীদের গ্রেফতার পূর্বে  পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব, মেডিকেল সার্টিফিকেট, বন্দিদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের নিমিত্তে হেল্প ডেস্ক স্থাপন, ক্ষুদ্র লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, বিচার সম্পর্কিত বিভিন্ন অংশীজনদের সাথে সমাবেশ,  সভা,  মতবিনিময়, প্রবেশন নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভূমিকা ও আরও কার্যকর  ভূমিকা পালনের জন্য সুপারিশসমূহ,  ভিকটিমের অধিকার সুরক্ষায় আইন ও বিচারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত ও গবেষণালব্ধ মতামত তুলে ধরেছেন। কলমের রেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন আদালত পাড়ায় ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা, চিহ্নিত করেছেন সমস্যাসমূহ এবং তা উত্তরণের উপায়সমূহ,  সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন  সুচিন্তিত মতামতও। যৌক্তিকভাবে উদাহরণ টেনেছেন উন্নত বিশ্বের বিচার পদ্ধতির, রেফারেন্স দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আদালত কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন রায়ের। যেমন—

 

“…তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস করতে পারেন।  কে প্যারোলের জন্য আবেদন করতে পারেন সে বিষয়েও প্যারোল নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই।  তবে ভারতে,  S. Sant Singh@ Pilli Singh Ajit Singh Kalyani Vs Secretary,  Home  Department,  Govt. Of Maharashtra & others ; 2006 ALL MR (Cri) 625 মামলায় বোম্বে হাইকোর্ট অভিমত দেন যে,  একজন কয়েদির নিজের বা তার আত্মীয়-স্বজন বা তার বন্ধু অথবা তার আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে প্যারোল মনজুর করা যেতে পারে। ”

( পৃষ্ঠা-৬২)

 

২য় অধ্যায়ে  “কৃতজ্ঞতা” শিরোনামে আদালত পাড়ার এক গল্প পাঠকের হৃদয়কে আবেগে বিগলিত করবে।  চোখের কোণে জল এনে দেবে ১০২ পাতায় বর্ণিত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের গল্প। বইটির বৈচিত্র্য বাড়িয়েছে ১১৭ পৃষ্ঠার জাপানি ব্যক্তির গল্পটি। এমন বহু গল্প পাওয়া যাবে আদালত পাড়ার গল্প অধ্যায়ে যা লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভূত ।

 

রুশিয়া জামান রত্না

শেষ কথাঃ

ন্যায়বিচারের অন্বেষণে; আইন বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলনকে কেবলমাত্র একটি সংকলন গ্রন্থ বললে ভুল হবে। বরং এটি একটা কার্যকর গবেষণা গ্রন্থের নির্যাস মাত্র।  লেখক তাঁর হৃদয়  তাড়না থেকে অথবা অজান্তে বইটিতে গবেষণা করার বহু উপাদান বুনন করে গেছেন যা ভবিষ্যতে বিচার পদ্ধতির পরিবর্তন,  পরিমার্জন বা পরিবর্ধনেও সহায়তা করবে।  সাবলীল প্রাঞ্জল ভাষা, সহজ সরল শব্দ চয়ন আর নিখুঁত বর্ণনা বইটিকে সব শ্রেণি পেশার মানুষদের কাছে সহজবোধ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।  আইন কানুনের মতো জটিল বিষয় একজন মানবিক মানুষের দৃষ্টি কোণ থেকে বিশ্লেষণ করে পাঠকের মনেও চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন। বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শুরু বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি এবং আদালত প্রাঙ্গণে হেল্প ডেস্ক, প্রবেশন এবং পুলিশ কার্যালয় সবখানে এ বইটি সংগ্রহ রাখা বিশেষ জরুরি বলেই মনে করছি। গ্রন্থটি রচনার মাধ্যমে  লেখক মোঃ সাইফুল ইসলাম তার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানকে বিকশিত করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়।

রিভিউ লেখক: রুশিয়া জামান রত্না- সমাজসেবা অফিসার।  

 

আরও পড়ুন- মুক্তিযুদ্ধের স্মুতিকথা বইরিভিউ