পদাবলিপ্রচ্ছদ

পবিত্র শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে একগুচ্ছ কবিতা- সৌপর্ণ মাছুম

এক

প্রথমাসমানের সিংহদারেতে থামিল বোরাক এসে
জিব্রাঈলের ডাকে সে দুয়ার খোলে পাক নির্দেশে ।
মারহাবা হে মাক্কি নবি, এ মিরাজ-অভিযানে
খোলা হবে সব অভ্র-দুয়ার তোমার সম্মানে ।
আদি পিতা নবি শফিউল্লাহ বরণ করিল তোমায়
শত পুষ্পে অম্বর সাজে মুখর ময়ূখ শোভায় ।
আদমের ডানে একদল লোক, অন্যরা আছে বামে
দেখিয়া তাদের হাসেন-কাঁদেন এই হাল নাহি থামে !
ডানে আছে যারা সন্তান তাঁর, তাঁরা জান্নাতবাসী
তাঁদের পানেই চাহিয়া তিনি দেন পুষ্পের হাসি ।
যত সন্তান নরকবাসী, তাঁর বামে আছে তারা
সেই বিরহ-শোকাগ্নিতে, কাঁদিছেন দিশেহারা !
দেবদূত বলে “ইনিই আপনার আদি পিতাজি আদম
পরিচয়ে পেয়ে পিতাজিকে হেসে সালাম দিলে যে প্রথম ।
সালাম নিয়ে বলিলেন তিনি,“হে নেক নবি ও তনয়
খোশ আমদেদ, তোমার প্রতি ঝরুক আশিস-প্ৰণয়।”

প্রথমাসমানের ফেরেশতা আর নবিরা ধরিল কোরাস
“মারহাবা হে খোদার হাবিব, খোদার পেয়ারা খাস।”

দুই
নীলাসমানের দোসরা দুয়ারও জিব্রাঈলের ডাকে
মারহাবা রবে খুলিয়া বরিল দেবদূত মোবারকে ।
‘ঈসা ইবনে মরিয়ম ইনি’ বাণী জিব্রাঈলের
‘যাকারিয়া উনি’, শুনিয়া তুমি জানালে সালাম তাঁদের ।
শক্তিশালী হয়েছেন ঈসা পূত আত্মার বানে
‘রুহুল্লাহ’ যেন কেবলি সতেজ হয়েছে পুণ্যস্নানে ।
লাবন্যময় দেহযষ্টি অঙ্গ লোহিত বরণ
বাবরি দোলানো কুঞ্চিত কেশ, মাঝারি গায়ের গড়ন।
ইব্রাহিমের বংশানুক্রমে মসীহের চেহারায়
সবচেয়ে বেশি সদৃশ তুমি মোহন রূপকায়ায় ।

অদম্য কৌতূহলে
‘ছুতার নবি যাকারিয়া’ তুমি  তাঁর কাছে পুছিলে-
“আপাদমস্তক দ্বিখন্ডিত হ’ল যবে করপত্রে
হৃদয়ানুভব কেমন ছিল তখন নীরব সত্রে ?
“পরওয়ার দেগার করুণাধারার, ডাকিলেন নাম ধরে
‘’আমি তো তোমার সাথেই আছি” বলিলেন প্রীতস্বরে !
এই শুনিয়াই  ভুলে গেছি জ্বালা মরণ-যন্ত্রণার;
দিলে সাধুবাদ প্রফুল্লতায় শুনে সে জবাব তাঁর ।

‘ইয়াহইয়া নবি ইনি’’ বলে জিব্রীল-আমিন তোমায়
বন্ধ্যা মাতাজির গর্ভে এলেন পিতার প্রার্থনায়।
চিরকুমার সেই শহিদ নবিকে বিনয়ে করিলে সালাম
তাঁর পূর্বে কোনো নবিরই ছিল না এ পূত নাম।
বলিলেন তাঁরা “মারহাবা তোমায় হে পুণ্যবান ভ্রাতা
তুমি নেক নবি বন্টনকারী; মহান আল্লাহ দাতা ।

তিন
এরপর তুমি পৌঁছালে গিয়ে তেসরা নভঃস্তল
খুলিল দুয়ার, তুমি যে খোদার জাতনূর ঝলমল ।
‘নবি ইউসুফ ইনিই’ তোমায় কহিল জিব্রীল-আমিন
রাহীল দুলাল, ইয়াকুব কুমার, যিনি রূপবান কুলীন।
যাঁহার মোহন রূপে দেওয়ানা মিশর-শর্বরী
হাত কেটে তারা করে একাকার রূপতৃষ্ণায় মরি !
সবচেয়ে বেশি করিতেন ভয় এক আল্লাকে যিনি
মানুষের কাছে চির পরিচিত সম্মানী নবি তিনি ।
মু’আব্বের নবি ছিলেন তিনি স্বপ্নতত্ত্বজ্ঞানী
সালাম জানালে তাঁকে তুমি, যিনি মহাসংযমী ধ্যানী ।
সালামের জবাব দিয়ে বলিলেন “হে নেক নবি ও ভাই
শত মারহাবা তোমার প্রতি প্রশংসা-গীত গাই।”

চার
জিব্রাঈলের সাথে এলে তুমি চৌঠা অন্তরীক্ষ
প্রভাময় হলো তোমার নূরে মলিন কৃষ্ণপক্ষ।
পৃত জিব্রাঈল বলিল তোমায় ‘ইনি ইদ্রিস নবি’
কাব্যে প্রকাশ করিলেন সব, মর্তের আদিকবি
‘তিনিই প্রথম কলমে লেখেন’ তত্ত্বজ্ঞানী ও গুণী
জ্যোতির্বিদ্যার নকশার জ্ঞানে যিনি ছিল অগ্রণী |
কাপড় বুনন ও পোশাক সিলাইয়ে অজ্ঞ ছিল যে জাতি
নিজ জ্ঞানে তিনি প্রথম তাদের বানালো দক্ষ তাঁতি।
দার্শনিকের পূত নবি যিনি স্বর্গভ্রমণকারী
বিনয়ে সালাম দিলে তুমি তাঁকে উর্ধ্বগমনকারী
সালামের জবাব দিয়ে বলিলেন, “হে নবি পুণ্যবান
মারহাবা হে নেককার ভাই শ্রেষ্ঠ তোমার শান ।

পাঁচ
মহাগৌরবে ছুটিল বোরাক কাঁধে পয়গাম্বর
খুলিল সমুখ বদ্ধ দুয়ার পেয়ে সে খোশ-খবর ।
জিব্রাঈলের সাথে এলে তুমি গহন পঞ্চনভে
জপিল দরুদ ফেরেশতারা বলিল তোমায় স্তবে।
বলে জিব্রাঈল তোমায় ‘ইনি হারুন পয়গাম্বর’
সালাম দিলে সে বাগ্মী নবিকে যে মুসার সহোদর।
বলিলেন তিনি, “নেককার ভ্রাতা হে নবি মোহাম্মদ
মারহাবা ইয়া রাসুলুল্লাহ আহাদের আহমদ ।

ছয়
জিব্রাঈলের হাঁকে খুলিল ষড়তম নভঃবাব
আঠারো হাজার মাখলুকাতের চির কাঙ্ক্ষিত খাব !
‘কালিমুল্লাহ মুসা নবি ইনি’ বলে জিব্রীল-আমিন
পূততুরে যাঁকে দর্শন দেন রাব্বুল আলামিন।
সালাম জানালে মুসা নবিকে; মধুর সম্ভাষণে
জবাবে তোমায় বলিলেন তিনি বিস্ময় বদনে।
“পুণ্যবান হে প্রাণপ্রিয় ভাই, হে পুণ্যবান নবি
মোবারক হো প্রশংসিত, নিখিল ধ্যানের ছবি।
বলেন এরপর : কেন বলেছিলে “উম্মতের উলামা
বনী ইসরাঈলের নবি তুল্য” কর তার তরজমা।
তোমার আজ্ঞায় সেই হাসিদের নিগুঢ় ব্যাখ্যা দিতে
‘আলমে আরওয়াহ’ থেকে আসিলেন গাজ্জালি ইঙ্গিতে।
সাক্ষাতে তাঁরা বিনিময় করে প্রথমে সালাম কালাম
মহাবিস্ময়ে কালিমুল্লাহ জিজ্ঞাসে তাঁর নাম।
‘নূর নবিজির উম্মত আমি নাম গাজ্জালি মোর’
বিনয়ে তিনি পিতাজির নাম বলিলেন তারপর।
দাদা-পরদাদা এমনি তাঁহার বংশ পরম্পরায়
ছয় পুরুষের নাম শুনে রোষে বলিলেন মুসা তায়
“আমি তো কেবল আপনার নাম করিয়াছি জিজ্ঞেস
বৃথা কেন তবে ছয় পুরুষের নাম করলেন পেশ?
আদবের সাথে বলিলেন তিনি মুসা নবীর উদ্দেশ্যে
প্লুত তাওরাত কিতাব আনিতে স্রষ্টার নির্দেশে
গেলেন যখন তুর পর্বতে, বলে প্রভু আপনাকে
“ডান হাতে কী তোমার মুসা’ বল আমি আল্লাহকে!
জবাবে রবকে বলেছিলে তুমি ‘হস্তে আমার যষ্টি
এতেই আমি ঠেস দিয়ে দাঁড়াই, এ আমার প্রিয় কষ্টি।
অন্য কাজও করি আমি ওতে প্রভুজীকে বলিলেন;”
ছোট প্রশ্নের দীর্ঘ এ জবাব বলুন কেন তা দিলেন?
জবাবে মুসা বলিলেন তাঁকে প্রভুর সঙ্গোপনে
আলাপচারিতার পেয়েছি সুযোগ তাই ভাবিলাম মনে
“মাহেন্দ্ৰ সে ক্ষণ দীর্ঘায়িত হোক” তাই বুদ্ধির বলে
ছোট প্রশ্নের দীর্ঘ জবাব দিয়েছি সুকৌশলে!
শুনে সে কথা বলে গাজ্জালী” সেই কারণেই আমি
ছয় পুরুষের নাম বলেছি অতি ধীরে থামি থামি!
আপনার মতো মশহুর নবী দুনিয়াতে নাই আর
কালিমুল্লাহ নবী আপনার সঙ্গ পাওয়া যে ভার!

বলিতে যে কথা আপনার সাথে পেয়েছি যখন সুযোগ
মনে প্রাণে আমি চাহিলাম এক্ষণ আরো বিস্তৃত হোক।
বুঝিলেন মুসা সুফী এ ইমাম কাশফ তত্ত্ব জ্ঞানী
জলন্ত প্রমাণ পেয়ে মানিলেন তোমার সে নিগুঢ় বাণী ।
চোখে এল জল কালিমুল্লার, তোমার বিদায়কালে
প্রসন্নতায় বলিলেন তিনি মহাবিস্ময় হালে।
“যুবক এ নবি শেষকালে এসেও আমার পূর্বে হায়
মহা সমাদরে যাবে জান্নাতে সুমহান মর্যাদায়। ।
তাঁর উম্মত ও মহা সম্মানে মোর উম্মতের আগে
নির্ভয়ে তারা খোদার কপায় যাবে ফেরদৌস বাগে।”

সাত
তুমি সবশেষে পৌঁছালে এসে জিব্রাঈলের সাথে
শেষ আসমানের রুদ্ধ দুয়ারও খুলিল মহাজ্ঞাতে ।
কুরসিতে বসে ‘বায়তুল মামুর’ মসজিদের গায় কে
হেলানে বিশ্রাম করিছেন’ তা জানতে চাইলে যে ।
মহাপিতা তিনি পূত ইব্রাহিম মুসলিম দুনিয়ায়-
খলিলুল্লাহ নবি ইনি’ বলে, জিব্রীল-আমিন তোমায় ।
“প্রতিদান প্রভু দিলেন তাঁকে মহাকাবা নির্মাণের
খুশী হয়ে তাই মোতাওয়াল্লী করলেন মামুরের ।
পিতাজিকে তুমি করলে সালাম মধুর আলিঙ্গনে
জবাব দিয়ে বলিলেন তিনি তোমায় বরণক্ষণে-
“সারা বিশ্বের রহমত তুমি হে নবি পুণ্যবান
মারহাবা ইয়া খোদার হাবিব প্রাণপ্রিয় সন্তান।”

সত্তর হাজার ফেরেশতা নিতি এই মামুরেতে এসে
জিয়ারত করে ফিরে যায় তারা, সালাত আদায় শেষে ।
সেথা দিনরাত দরুদ-সালাত জপিছে ফেরেশতারা
চলে যায় যারা পুণ্যস্নানে -ফেরে নাকো আর তারা !
তোমার নূরের ধারক ও বাহক একদল উম্মত
পড়িল নামাজ শুভ্র বসনে সিররুল বেলায়ত !
সালাত পড়িল গাউসুল আজমও থেকে সে দলের মাঝে
‘মারহাবা ইয়া খোদার হাবিব’, এ ধ্বনি কোরাসে বাজে !
সবার উষ্ণ অভ্যর্থনায় হৃদয়ে জাগিল পুলক
মারহাবা রবে মুখরিত হ’ল অসীম শূন্যলোক…!

আরো পড়ুন- টিটো মোস্তাফিজের কবিতা