পলাশ মজুমদারের গল্প- মহানগরী
কলকাতার অনির্বাণ মিত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। আমি তাঁর গল্পের ভক্ত। গল্প লিখি আমিও। দুই বাংলার গল্পবিষয়ক অনলাইন সাহিত্য পোর্টাল ‘গল্পপাঠ’-এ দেশভাগের ওপর আমার একটি গল্প পড়ে তিনি একদিন আমাকে জানান, আমি চাইলে তাঁর কাছে এমন একটি গল্পের প্লট পেতে পারি।
সেবার কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে তাঁদের মানিকতলার বাড়িতে উঠি। আর সেখানেই গড়ে ওঠে দুজনের ঘনিষ্ঠতা। অনির্বাণ বারবার ঢাকার গল্প শুনতে চান। জিজ্ঞেস করি, ঢাকার ব্যাপারে আপনার এত কৌতূহল কেন?
জানালেন, তিনি যে গল্পের প্লটটি দেবেন, তা ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর ঢাকায় যাওয়া হয় না।
তাঁকে জিজ্ঞেস করি—আপনি কার কথা বলছেন?
অনির্বাণ বললেন—সব বলব। ঘটনাটি আমার ঠাকুরমার। তাঁর নাম ছিল আঞ্জুমান মিত্র।
মিত্র? আঞ্জুমান তো হিন্দু মেয়েদের নাম হয় না। তিনি কি মুসলমান ছিলেন?
মিত্র আমার ঠাকুরদার পদবি। ঠাকুরমা ছিলেন বিখ্যাত ওস্তাদ সোহরাব হোসেনের একমাত্র মেয়ে। নিজেও ছিলেন প্রসিদ্ধ সেতারবাদক। পিয়ানোও বাজাতেন দুর্দান্ত। দেখতেও ছিলেন ভীষণ সুদর্শনা। রূপে-গুণে অতুলনীয়া।
আর আপনার ঠাকুরদা?
তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন; তবে সংগীতের সমঝদার। নাম ছিল সৌমেন মিত্র। শুধু এ নামের জন্যই সর্বগুণে গুণান্বিতা ওই নারী বিয়ে করেছিলেন আমার ঠাকুরদাকে।
ইন্টারেস্টিং তো। কেবল নামের জন্য বিয়ে! রহস্যটা কী?
সেই সময়ের কলকাতায় খবরটি সাড়া ফেলেছিল। লুফে নিয়েছিল পত্রিকাওয়ালারা। ১৯৪৬-এর সেই দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ সময়ে এক ধনী মুসলমান শিল্পী-ঘরের সুন্দরী মেয়ে এক গরিব হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করছে, বিষয়টি শহরে খুব আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে।
খুলে বলুন। ধৈর্য ধরে রাখতে পারছি না!
এরপর অনির্বাণ যা বললেন তা আমি কিছুতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সব শুনে নির্বাক ছিলাম অনেকক্ষণ। ঢাকা ফেরার পর লিখতে বসে গেলাম।
দুই.
কাল সারা রাত আঞ্জুমান ঘুমাতে পারেনি; আনোয়ারা আর খোরশেদের কথাই ভেবেছে শুধু। দুচোখের পাতা একবারের জন্যও জোড়া লাগেনি ওর। কেবল ভয়, এই বুঝি ওদের বাড়িও আক্রান্ত হলো—ওকে তুলে নিয়ে গেল গুন্ডারা; এই বুঝি চাড্ডিরা ওদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দিল। আঞ্জুমান তীব্র উত্তেজনায় বেশ কয়েকবার বিছানা ছেড়ে এ-ঘর ও-ঘর পায়চারি করেছে; আর অজানা আতঙ্কে-উৎকণ্ঠায় কেঁপেছে প্রতিটি মুহূর্তে।
আঞ্জুমানের জীবনে এমন কঠিন সময় আগে আসেনি। কিছুদিন হলো জীবনটাকে ওর বড্ড একঘেয়ে লাগছে; অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে চোখে-মুখে। পরিচিত কেউ ওকে দেখলেই আঁতকে উঠছে—এ কেমন চেহারা হয়েছে! কোথায় গেল সেই লাবণ্যে ভরা উজ্জ্বল মুখখানি। মা-বাবাকে ও নিজের দুর্ভাবনা আর যন্ত্রণার কথা কোনোভাবে বোঝাতে পারছে না; এটা ওর আরও বড় কষ্টের কারণ। মনোবল ভেঙে পড়লেও সন্ধ্যায় মা-বাবার সামনে দাঁড়ায়—আমাদের আর কলকাতায় থাকা ঠিক হবে না।
আঞ্জুমানের বাবা প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ সোহরাব হোসেন, মা নজরুলসংগীতের গুণী শিল্পী কল্যাণী ভট্টাচার্র্য। অষ্টাদশী একমাত্র সন্তানের কথায় তাঁরা স্তম্ভিত। সময়টা যে তাঁদের পীড়া দিচ্ছে না, তা নয়। তাঁরা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন, হয়তো অচিরে এই কালো মেঘ কেটে যাবে। নিজেদের উদ্বেগ লুকিয়ে তাঁরা জানতে চান—কেন?
আঞ্জুমান চুপ থাকে। ওর নীরবতা দেখে সোহরাব সাহেবও নিশ্চুপ। ধীরে ধীরে কাছে টেনে বুকে চেপে ধরেন মেয়ের মাথা—হাত বুলিয়ে আদর করেন। সব উপেক্ষা করে হঠাৎ ও হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাবার দিকে টলমলে চোখে তাকায় আঞ্জুমান—বাবু, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
কেন? কী হয়েছে মা? খুলে বল।
তোমরা জান না, পরশু রাতে হামলা হয়েছে আনুদের বাড়িতে। পাশের এক হিন্দুবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচেছে ওরা।
তুমি জানলে কীভাবে?
আনু আর খোরশেদদা কাল বিকেলে এসেছিল; তোমরা তখন ঘুমাচ্ছিলে। আনু অনেক কান্নাকাটি করেছে। ওদের কাছে আরও অনেক কিছু জেনেছি আমি।
আর কী বলেছে ওরা?
ওরা ঢাকায় চলে যাবে। ঢাকা নাকি মুসলমানদের জন্য নিরাপদ। ওদের সব আত্মীয়স্বজন পূর্ববঙ্গে চলে যাচ্ছে। চলো, কলকাতা ছেড়ে আমরাও চলে যাই।
সোহরাব হোসেন বুঝে গেলেন, মেয়ে চিরতরে কলকাতা ছেড়ে যেতে চায়। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে কি সম্ভব! এই মহানগরীর সঙ্গে যে তিনি প্রাণের বাঁধনে বাঁধা। ধ্যান-জ্ঞানে, শয়ন-স্বপনে, ঘুম-জাগরণে কলকাতার প্রতিটি অলিগলি তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এ বাঁধন যে ছেঁড়া যাবে না। কলকাতার অন্যরকম এক আকর্ষণ আছে তাঁর কাছে। আবেগ গোপন করে তিনি মেয়ের কাছে জানতে চান—আমরা কোথায় যাব মা? ঢাকায় না বর্ধমানে?
আঞ্জুমান আবার নিশ্চুপ।
সোহরাব সাহেব ভালো করে জানেন, তাঁদের বর্ধমানের বাড়িও নিরাপদ নয়। সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতকালের চেনাজানা প্রতিবেশী যেন হঠাৎ করে দেখা দিচ্ছে অচেনা রূপে; একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে সন্দেহের দৃষ্টিতে; মনে মনে শত্রুজ্ঞান করছে পরস্পরকে।
কল্যাণীকে ভালোবাসার সময়, এমনকি বিয়ের সময়ও সোহরাব সাহেবের মনে হয়নি, তিনি জীবনসঙ্গিনী করতে যাচ্ছেন এক হিন্দু মেয়েকে। অথচ তারপরই বাড়ির লোকজন তাঁকে ঠেলে দিল দূরে। ওই সময় থেকে বাড়ির সবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে বাধা এসেছে। সমাজের জন্য তখন তো মা-বাবা তাঁকে একরকম ত্যাজ্যপুত্রই করে দিলেন। যোগাযোগ রাখল না ভাইবোনেরাও। রাগে-অভিমানে তিনি আর কখনো বাড়িমুখো হননি।
মেয়ের অস্থিরতা দেখে মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বোঝানোর চেষ্টা করেন নানাভাবে। আঞ্জুমান মাকে বলে—মা, তুমি কী বলো! এখানে থাকা কি আমাদের জন্য নিরাপদ। আমরা কি বাঁচতে পারব ওদের হাত থেকে?
কল্যাণী মেয়ের কথায় তীব্র অসম্মতি জানান—আমরা গানের মানুষ, আমাদের গায়ে কে হাত ওঠাবে? কলকাতা শহরে কার এত সাহস। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।
আঞ্জুমান এবার বাবার দিকে তাকায়—কলকাতা শহরটি পচে গেছে; মানুষে-মানুষে মারামারি-হানাহানি চলছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে মৃত পচা-শরীরের দুর্গন্ধে। এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।
একটু ধৈর্য ধরো মা। শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে।
না বাবু। হবে না। হওয়ার কথা নয়।—আঞ্জুমানের কণ্ঠে ঝরে পড়ে চরম হতাশা।
সোহরাব হোসেন নিজেকে আর সংযত রাখতে পারেন না। ক্রুদ্ধ হন—এত যে ঢাকা ঢাকা করছ, ঢাকায় গিয়ে আমরা কী করব? আমাদের কাজ ও সম্পর্ক তো হিন্দুদের সঙ্গেই বেশি। আমার শিষ্য ও ভক্তদের বেশির ভাগই হিন্দু। ঢাকার মুসলমানরা কি আমাদের কদর বুঝবে? শুনেছি, ঢাকার সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা কলকাতার মুসলমানদের সঙ্গে বাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বদল করে চলে আসছে এদিকে। তাছাড়া মুসলমানদের মধ্যে সংগীতের সমঝদার কি তেমন আছে।
তবু যেতে হবে। আগে তো প্রাণ বাঁচানো। হিন্দু ও মুসলমান এক জাতি নয়; দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হতে যাচ্ছে তাদের আলাদা আলাদা দেশ। আঞ্জুমানের গলা ধরে আসে।
মেয়ের সঙ্গে কথা বাড়াতে চান না সোহরাব সাহেব। তবে প্রচণ্ড কষ্ট পান মনে; মানুষের অজ্ঞতা দেখে হাসিও পায় তাঁর। মনে আছে, মাসখানেক আগে তাঁর বন্ধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সুমিত গোস্বামী এসেছিলেন তাঁদের বাড়িতে। তখন কথা হচ্ছিল দেশ-জাতি-ধর্মসহ সমসাময়িক নানা ঘটনা নিয়ে। সুমিতের যুক্তি সোহরাব সাহেবের বেশ মনে ধরেছিল। সুমিতবাবু সেদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন—যদি হিন্দু-মুসলমানভেদে দেশ ভাগ হয়, তবে ভারতের সব প্রদেশের হিন্দুকে এক দেশে আর মুসলমানদের অন্য দেশে রাখা কি অনিবার্য নয়?
সোহরাব সাহেব তখন হেসেছিলেন—এটা কি সম্ভব! যত সব পাগলের প্রলাপ। কেবল ক্ষমতার লোভে আজ ধর্মের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে স্বাধীনতার নামে চলছে দেশভাগের পাঁয়তারা। তিনি টের পাচ্ছেন এমন সিদ্ধান্তের ভয়াবহ পরিণতি। নেতাদের এই ভণ্ডামি রুখে দিতে কিংবা প্রতিবাদ করতে পারছেন না বলে মনে মনে কেবল ফুঁসছেন; আর সাধারণ মানুষ কিছু না বুঝে ওই ভয়ংকর কূপে ঝাঁপ দিচ্ছে বলে আফসোসের অন্ত নেই তাঁর।
আঞ্জুমান অনেক কিছু জানে না। তবু যেটুকু জেনেছে, তা ওকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুচিন্তার দিকে। আতঙ্কগ্রস্ত মেয়ের কথা শুনে তাঁরা বুঝতে পারেন, আঞ্জুমানকে বাইরের কেউ প্ররোচিত করছে, নইলে এত কথা ও জানে কীভাবে। তাঁদের ধারণা, খোরশেদই ওকে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেছে। বান্ধবীর মাধ্যমে মেয়ে যে তার ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে, তা তাঁরা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এই ব্যাপারে কখনো কিছু বলেননি ওকে।
সোহরাব সাহেবের তরুণ শিষ্যদের অনেককেই তিনি দেখেছেন আঞ্জুমানের প্রতি আগ্রহী হতে। সুন্দরী এক অনূঢ়া তরুণীর জন্য যুবকদের প্রাণ আকুলি-বিকুলি করতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি খেয়াল করেছেন, সৌমেন মিত্র ওর প্রণয়াকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে অন্যতম। ছেলেটা ওকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে; সৌমেনের ব্যবহার ও আচার-আচরণ সোহরাব সাহেবের ভালো লাগলেও আঞ্জুমান কেন জানি তাকে সহ্য করতে পারে না। স্মার্ট ও মার্জিত স্বভাবের সৌমেনকে বাদ দিয়ে কেন খোরশেদের মতো এমন সংস্কৃতিবিমুখ ছেলেকে মেয়ে বেছে নিয়েছে, তা তিনি বুঝতে পারেননি কখনো।
আঞ্জুমান জানে, ওর জন্য সবকিছু করতে-পারার দলে সহপাঠী ছাড়াও ছেলের অভাব নেই চারপাশে। আর কেউ নয়, আনুর দাদা খোরশেদই প্রথম অজানা সুখ-পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছিল ওকে। বছর দুয়েক আগে। আনুর কাছে তখন ও প্রায়ই যেত। বেড়ানোর কথা বলে কখনো থাকত আনুদের বাড়িতে। ওর মা-বাবার এই ব্যাপারে নিষেধ ছিল না।
এই আসা-যাওয়ার মধ্যে কখন যে দুটি হৃদয় অভিন্ন সুতোয় গেঁথেছিল, তা ও টেরই পায়নি। দুটি পরিবারের সামাজিক অবস্থান ও জীবনযাত্রায় যে বিস্তর ফারাক, তা ও যখন বুঝতে পারে, তখন আর ফেরার উপায় ছিল না। অবশ্য ভিন্ন পারিবারিক মূল্যবোধের কারণে বিভিন্ন বিষয়ে দুজনের মধ্যে মতবিরোধ ছিল—দুই পরিবারের আদর্শ যে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। বিভিন্ন সময় তর্ক হলেও তা ওদের মিলনে বাধা ছিল না।
খোরশেদের যুক্তির কাছে আঞ্জুমান প্রায়ই ধরাশায়ী হতো—নিজের জ্ঞানের অগভীরতার জন্য। আবার মা-বাবার বিশ্বাসকেও উড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ওর ছিল না। উভয়সংকটে পড়ে ও যেন চিন্তা করার সামর্থ্য হারায়। একপর্যায়ে কেবল প্রাধান্য দিতে শুরু করে চোখের সামনের ঘটনাকে। আর এ-সময়ের ঘটনাপরম্পরা ওর জীবনকে যেন ছুঁড়ে ফেলে গভীর সংকটের আবর্তে। সিদ্ধান্তহীনতা ওকে আঁকড়ে ধরে অক্টোপাসের মতো। তবে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে প্রেমিকের পাল্লাই ভারী হয়ে ওঠে।
আঞ্জুমানের এমন অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন সোহরাব হোসেন। হয়তো মেয়ের চেহারায় দেখতে পান তিনি অমঙ্গলের কোনো চিহ্ন, সহজাত পিতৃহৃদয় দিয়ে। এমন পরিস্থিতি যে আরো কতবার কত জায়গায় হয়েছে, তা বিভিন্ন উদাহরণসহ তুলে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টাও করেন। সেসব কথা যেন ঢোকে না আঞ্জুমানের কানে।
মেয়ের এসব কথায় মনে মনে ক্ষেপে আছেন কল্যাণী। তিনি কোনোভাবে কলকাতা ছাড়তে রাজি নন। তাঁরা সাতপুরুষ ধরে কলকাতার বাসিন্দা। শিল্পীকে বাঁধে না ধর্ম—কবি নজরুলের কাছে পেয়েছেন তিনি এ শিক্ষা। তাই তো জাত-ধর্মের তোয়াক্কা না করে ভিন্নধর্মের মানুষকে বিয়ে করতে পেরেছেন। কবির মতো। তাঁর বাবা নির্মলেন্দু ভট্টাচার্য ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সুবাদে কল্যাণী পেয়েছেন কবির নিবিড় সান্নিধ্য ও ভালোবাসা। ছোটবেলায় কবি স্বয়ং তাঁকে শিখিয়েছেন স্বরচিত গান, সেই গান আজও গেয়ে চলছেন তিনি। কাজী কাকুর কাছে তিনি পেয়েছেন শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রথম পাঠ; পেয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতা ও পরমতসহিষ্ণুতার দীক্ষাও।
কল্যাণীর মতো সোহরাব হোসেনও ধর্ম পালন করেন না। মানুষ পরিচয়টিই তাঁর কাছে মুখ্য। যারা তাঁর স্নেহচ্ছায়া পেয়েছেন, তারা জানেন তিনি কত বড় মাপের মানুষ। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানুষের প্রতি তাঁর এই উদারতা আর ভালোবাসার জন্যই তিনি সব সময় পেয়ে আসছেন সবার প্রীতি আর শ্রদ্ধা।
বাড়ির ড্রয়িংরুমে পারিবারিক আলোচনার সময় তাঁরা তিনজন যখন সমঝোতায় পৌঁছাতে পারছেন না, তখন তাঁদের চাকর ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢোকে। সে খবর এনেছে, দশ-বারোজন হিন্দু গুন্ডা একজন মুসলমান ডিম-বিক্রেতাকে গলির মুখে তলোয়ার দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। ছেলেটির চোখেমুখে তীব্র আতঙ্ক আর ভয়।
এ-খবর শুনে মূর্ছা যায় আঞ্জুমান। কল্যাণী অনেক চেষ্টা-কসরত করে ওর জ্ঞান ফেরান। জ্ঞান ফিরলেও নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও। আঞ্জুমানের চেহারা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যান কল্যাণী। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর মুখ। কী করবেন কিছু ভেবে পান না। ধীরে ধীরে খাটে শুইয়ে দেন মেয়েকে। শরবত বানিয়ে খাওয়ান। চোখ বন্ধ করে রাখতে বলেন।
আঞ্জুমান মায়ের কথা শোনে না। জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে থাকে উদাস দৃষ্টিতে; কথা বলে না কারও সঙ্গে; যেন বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ও।
অনেকক্ষণ পর নির্বাক মেয়ের চোখে তাকিয়ে কল্যাণী বলেন—এ রকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা সব জায়গাতেই কমবেশি হয়, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে! বোঝার চেষ্টা করো। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে আমরা প্রয়োজনে আগ্রা বা লক্ষ্ণৌ চলে যাব। তবু ঢাকায় নয়। তুমি হয়তো জান না, ঢাকায়ও দাঙ্গা চলছে। ওদিকের পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে শুনেছি।
তবু আঞ্জুমান কিছু বলে না; কেবল অপলক চেয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। ওর এ চোখের ভাষা গর্ভধারিণী মা-ও বুঝতে অক্ষম। মেয়ের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী নিজের ভেতর অনুভব করেন একধরনের অস্বস্তি। চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেন।
সব সময় সোহরাব হোসেনের শিষ্যরা আসে সন্ধ্যার পরপর। তালিম নিতে। আজ তাদের পায়ের আওয়াজ শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে আঞ্জুমান। ওর ধারণা, এই হিন্দু ছেলেরা ওর ওপর হামলা করবে, ওকে খণ্ড-বিখণ্ড করবে। হয়তো হত্যা করার আগে ওকে সবাই মিলে ধর্ষণ করবে।
মেয়ের এমন অস্থিরতা দেখে সোহরাব সাহেবের কপালের ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর এ দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করতেই কল্যাণী হেসে ফেলেন; বরং কিছুদিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে দার্জিলিং বা সিমলার কোনো স্থানে ঘুরে আসতে স্বামীকে পরামর্শ দেন। কিন্তু সোহরাব সাহেব স্ত্রীর কথা আমলে নেন না। তিনি মেয়েকে সমর্থন করেন অনেকটা; মেয়ের মুখ চেয়ে কলকাতা থেকে চিরতরে প্রস্থান-প্রসঙ্গের ওপর জোর দেন। অথচ কলকাতায় থাকার ব্যাপারে কল্যাণী অনড়।
মা-মেয়ের এমন বিপরীতমুখী অবস্থান সোহরাব সাহেবকে ভীষণ বেকায়দায় ফেলে। তাঁর মনে হয়, জীবনে এমন পরিস্থিতিতে তিনি পড়েননি কখনো। একরোখা সোহরাব হোসেন সব সময় নিজে যা ভালো মনে করেছেন, তা করতে কখনো পিছপা হননি। এমনকি কল্যাণীকে বিয়ে করার ব্যাপারেও। এ জন্য অবশ্য ভুগেছেনও অনেক; তবু নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। অথচ আজ তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
অবশেষে কল্যাণী ইতি টানেন দ্বন্দ্বের। নিজের কক্ষে চলে যান নীরবে। সোহরাব সাহেবও শিষ্যদের তালিম দেওয়ার জন্য নেমে আসেন নিচতলায়। কিছুক্ষণ পর আঞ্জুমান আস্তে আস্তে মায়ের ঘরে প্রবেশ করে; বলে—মা, আমার মাথা যেন ঘুরছে; আমি দাঁড়াতে পারছি না; পা দুটো পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার বারবার মনে হচ্ছে, বড় কোনো বিপদ আশপাশে ওত পেতে আছে।
কল্যাণী এবার বেশ ঝাঁজালো স্বরে বলেন—আমাদের কোনো ভয় নেই। কিসের ভয়? আমি তো হিন্দুর মেয়ে। শাখা-সিঁদুর না পরলেও আমি তো সনাতন ধর্মের সব নিয়মকানুন জানি। আমাদের কোনো বিপদ এখানে হবে না। তা ছাড়া তোমার বাবার ভক্ত-শিষ্যদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু; তারা জীবন দিয়ে হলেও আমাদের রক্ষা করবে।
আঞ্জুমান এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলে—মা, ওই গরিব ডিম-বিক্রেতা বা আনুরা তাদের কারও কি কোনো ক্ষতি করেছিল? শুধু মুসলমান বলেই তাদের মেরেছে হিন্দু-গুন্ডারা। জানি, নিরীহ লোকেরা সব সময় এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়; প্রাণ যায় এদের।
তুমি আবোল-তাবোল বকছো। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
এ অবস্থায় কার মাথা ঠিক থাকে। মানুষ কি আর মানুষ আছে এখানে?
কল্যাণী আঞ্জুমানের চেহারা দেখে নিজেও ভয় পেয়ে যান—মেয়ে যদি আত্মহত্যা বা এ-জাতীয় কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসে এই আশঙ্কায়। চুপ হয়ে যান অকস্মাৎ। মায়ের নীরবতা দেখে ও বের হয়ে আসে; বারান্দায় দাঁড়ায়। বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ও তখন স্পষ্ট দেখতে পায় রাস্তায় গোটা দশেক লোক দাঁড়িয়ে।
লাফ দিয়ে ভেতরে এসে ও মাকে জড়িয়ে ধরে—মা, দেখতে এসো, রাস্তায় কারা। এরা এখনই আমাদের হত্যা করতে ছুটে আসবে, জ্বালিয়ে দেবে আমাদের বাড়ি। তখন কী করব?
খবরটা জানানোর জন্য কল্যাণী কাজের ছেলেটিকে দিয়ে সোহরাব সাহেবকে ডেকে পাঠান।
মেয়ের যে মানসিক সমস্যা চলছে, তা কল্যাণীর মতো বেশ বুঝতে পারেন সোহরাব হোসেনও। তবে এমন সংকটময় মুহূর্তে কী করতে হবে, তাঁর জানা নেই। এই দুঃসময়ে কেবল বন্ধু সঞ্জয় আচার্যের কথা মনে পড়ছে তাঁর; সঞ্জয়ের চেয়ে ভালো পরামর্শ তাঁকে আর কেউ দিতে পারবেন না। অথচ আজ সঞ্জয় পৃথিবীতে নেই। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডেতে পার্ক সার্কাস এলাকায় নির্মমভাবে খুন হন সঞ্জয়। মুসলমান-গুন্ডাদের হাতে। মানুষের প্রতি অবিচল বিশ^স্ত মার্কসবাদী সঞ্জয় মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লালন করেছিলেন সেই বিশ্বাস। ওই বিশ্বাস হয়েছিল তাঁর কাল। মানুষকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ রেখে গেলেন মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার। কিছু বিষয়ে মতের ভিন্নতা থাকলেও তাঁরা ছিলেন অভিন্ন আত্মার অধিকারী; প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বিক্রম ঘোষের শিষ্য ছিলেন দুজন। গুরুর কাছে একসঙ্গে সংগীত-শিক্ষা করেছেন প্রায় কুড়ি বছর। সঞ্জয়ের প্রয়োজন তিনি এখন টের পাচ্ছেন ভালোভাবে।
সোহরাব হোসেন কল্যাণীর কথা শোনার পর সত্যি সত্যি ভীত হয়ে পড়েন। কিছু না বলে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আবার নেমে আসেন নিচতলায়। তাঁর চোখ-মুখের এই অভিব্যক্তি আতঙ্কিত করে সতীর্থদের। ওস্তাদের মুখে হতাশার ছাপ দেখে এক শিষ্য পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা অরবিন্দ ঘোষাল তাঁকে আশ^স্ত করেন—ওস্তাদজি, আপনার বাড়ির কাছে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা সিভিল-পুলিশ। আমিই ওদের এখানে রেখেছি আপনার বাড়িটি পাহারা দেওয়ার জন্য। আপনাদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আপনি যত দিন না বলবেন, তত দিন এই সিকিউরিটি ফোর্স এখানে থাকবে।
পুনরায় ওপরে এসে স্ত্রী আর মেয়েকে এই কথাটা জানিয়ে যান সোহরাব হোসেন। কল্যাণী বেশ ভরসা পান এতে। মেয়েকে এই নিরাপত্তাবলয়ের কথা জানিয়ে শান্ত থাকতে বলেন।
তবু বিশ্বাস রাখতে পারে না আঞ্জুমান।
রাতে ও মা-বাবার সঙ্গে আর কোনো কথা বলে না।
পরদিন সকালে আনু ও খোরশেদ দেখা করতে এলে বেশ উৎফুল্ল মনে হয় আঞ্জুমানকে। হাসিখুশি দেখে ওর মা-বাবাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ওরা কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাওয়ার পর আবার আঞ্জুমানের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে রাজ্যের উৎকণ্ঠা।
তার পরদিন সকালে আঞ্জুমানকে আর খুঁজে পায় না কেউ।
আঞ্জুমানের খোঁজে দিক্ভ্রান্ত হয়ে সোহরাব সাহেব যখন থানায় ছুটছেন, তখন ও শিয়ালদহ স্টেশনে। ঢাকা মেইলের কামরায়। ওর পাশে বসে আছে খোরশেদ; কিছুটা দূরে আনুদের পরিবারের সবাই।
ট্রেন ছাড়তে অল্প সময় বাকি। এমন সময় ওই কামরায় উঠে আসে কয়েকজন মুসলমান-চাড্ডি; তারা জানতে চায় সবার ধর্ম-পরিচয়। খোরশেদ নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও আঞ্জুমানের পোশাক, কথাবার্তা ও চেহারা দেখে ওকে হিন্দু বলে শনাক্ত করে তারা। খোরশেদকে ভর্ৎসনাও করে আঞ্জুমানকে নিয়ে মিথ্যে বলার জন্য।
এমন সময় হুইসেল বেজে ওঠে। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে ট্রেন। তাড়াহুড়ো করে দুর্বৃত্তরা আঞ্জুমানকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামায়। চিৎকার করলেও খোরশেদ ওকে বাঁচানোর জন্য নেমে আসে না। অন্য যাত্রীরাও ভয়ে-আতঙ্কে নির্বাক। একপর্যায়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
আঞ্জুমানকে স্টেশনের বাইরে আনা হলে দৃশ্যটি দাঙ্গাবিরোধী কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের নজরে পড়ে। এই দলের একজন, ওর বাবার ছাত্র সৌমেন মিত্র, ওকে চিনতে পারে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সৌমেন। তৎক্ষণাৎ দাঙ্গাবাজরা সৌমেনের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে দৌড়ে পালায়। মুহূর্তে রাস্তা ভেসে যায় রক্তে।
মৃত্যুমুখেও সৌমেন সহযোদ্ধাদের মৃদু স্বরে অনুরোধ করেছিল—আঞ্জুমানকে নিরাপদে ওদের মানিকতলার বাড়িতে পৌঁছে দিতে। আরও বলে, ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
একজনের মুখে এমন কথা শুনে আঞ্জুমান কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর মৃত সৌমেনের মুখপানে কেবল নিষ্পলক চেয়ে থাকে।
তিন.
‘দেশ’ পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমি আর অনির্বাণের ফ্রেন্ডসলিস্টে নেই।
আরও পড়ুন- পুরষ্কার- পলাশ মজুমদারের গল্প