কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

পুরস্কার- পলাশ মজুমদার- গল্প

লেখালেখির প্রথম পর্যায়ে সুফিয়ার আফসোস ছিল নাম নিয়ে; বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ‘সুফিয়া খাতুন’ নামটি লেখকের সঙ্গে ঠিক যায় না। লেখকের নাম হবে আধুনিক। সুন্দর। নামের মধ্যে থাকতে হবে অভিনবত্ব, যা পাঠককে সহজে আকৃষ্ট করবে; নাম দেখে নতুন পাঠক আগ্রহী হবে লেখা পড়তে। এসব বিষয় চিন্তা করে অনেকবার নাম পরিবর্তনের কথা সুফিয়া ভেবেছিল।

ওর এমন ভাবনাকে উসকে দিয়েছিল একজন লেখক বন্ধু। ওই সময় নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে সুফিয়া আলাপ করেছিল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গেও। বেশির ভাগই ওকে উৎসাহ দেয়; অনেকটা ওর যুক্তির প্রতি সমর্থন হিসেবে। সুফিয়া খেয়াল করেছিল, লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেয়ে ওকে খুশি করতে সবাই উৎসাহী। তবে শেষ পর্যন্ত ভাবনাটা উড়িয়ে দিয়েছিল সুফিয়া। ও ভেবে দেখেছে, মা-বাবার দেওয়া নাম পরিবর্তন করা মানে নিজের জন্মকে অস্বীকার করা! এটাও তো একধরনের হঠকারিতা।

তখন থেকে সুফিয়ার প্রায় মনে হয়, নাম নয়, কাজই আসল। কাজ করে যেতে হবে মনের আনন্দে; পরিণতির কথা না ভেবে। একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করলে একদিন ঠিকই মানুষ লক্ষ্য খুঁজে পায়। নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে পরিচিত করে তোলে। কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের মতো বিরল প্রতিভাশালীদের কথা ওর প্রায় সময় মনে ভাসে। রবিঠাকুর আপন খেয়ালে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে গেছেন বলে অমরতা পেয়েছেন; বাঙালিকে উপহার দিয়ে যেতে পেরেছেন বিশাল সৃষ্টিভান্ডার।

 

দুই.

সুফিয়া একটু আগে জানতে পেরেছে ও একটি উচ্চমানের তরুণ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে। খবরটি ভেসে এসেছে শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে। পুরস্কারের অর্থমূল্য এক লাখ টাকা। টাকা মুখ্য নয়, স্বীকৃতিটাই বড় কথা। এত দিন যারা ওকে লেখক বলে মূল্যায়ন করেননি, এবার নিশ্চিত তারা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। সুফিয়া ভাবছে, আর ওকে পড়তে হবে না অপরিচয়ের জটিলতায়। এক নামে ওকে সবাই চিনবে। এই কথা ভাবতেই মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে, যেন সফল হতে চলেছে এত দিনের নিরলস সাধনা।

এমন সুসময় জীবনে আসবে, সুফিয়া কয়েক দিন আগেও ভাবতে পারেনি। খবরটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে চোখে জল এসে গেছে আনন্দে। কোনোভাবে ও অশ্রু সংবরণ করতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে, আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন, সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। মায়ের কথা মনে করে ও কোনোভাবেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

ছোটবেলা থেকে মা সব সময় ওর ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সুফিয়ার কোনো কাজে মা কখনো বাধা দেননি। বাবা বাধা দিলে মা প্রতিবাদ করেছেন। বাবা মাঝেমধ্যে মাকে বকা দিয়ে বলতেন, মেয়েকে যে এত লাই দিচ্ছ, একদিন পস্তাতে হবে। ওকে শাসন করো। না, পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করলেও সুফিয়া পথভ্রষ্ট হয়নি। ও মনে করে, ওর সাফল্যের সব কৃতিত্ব মায়ের।

মা ওর মনের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। মা নিজেও বই পড়তেন; ঘরের সব কাজ সেরে রাত জেগে। মায়ের অভ্যাসটি ওর মধ্যে কি উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে! হয়তো তা-ই। মায়ের দেখাদেখি ও পড়তে শুরু করেছিল। পড়তে পড়তেই ওর মধ্যে চেপে বসেছিল লেখার ভূত। লুকিয়ে লুকিয়ে ও গল্প লিখত। লেখক হওয়ার বাসনা প্রকাশ করতেই মা খুশি হয়ে বলেছিলেন, তুই লিখলে আমার মতো খুশি আর কেউ হবে না; আমার বিশ্বাস, তুই একসময় অনেক নাম কুড়াবি; মানুষ এক নামে তোকে চিনবে।

মায়ের কথাগুলো ওর প্রাণে স্পন্দন তুলত।

মা ছাড়া আরও একজনের অবদান সুফিয়া কখনো অস্বীকার করতে পারবে না। অর্পণ। অর্পণ ওকে সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছে। অর্পণ পাশে না থাকলে সুফিয়া হয়তো এত দূর আসতে পারত না। তবে এটা সত্য, অর্পণকে ও ভালোবেসেছে কেবল কবিতার জন্য। অর্পণ ভালো কবিতা লেখে। সাহিত্যামোদী। একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। তা ছাড়া অর্পণের আর কোনো যোগ্যতা নেই। লম্বা লম্বা চুল। সব সময় ঝুটি করা। চলাফেরায় পুরো বেহিসাবি। সামাজিকতার বালাই নেই। কারও কোনো সমালোচনা পাত্তা দেয় না। এ জন্য সুফিয়া অনেকের কাছে নানা কটুকথা শুনেছে। কিন্তু সেসব ও গায়ে মাখেনি কখনো।

সুফিয়াই অর্পণকে প্রস্তাব দিয়েছিল; অর্পণ ওর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। বিয়ে করেছে; কিন্তু ওরা গোপন রেখেছে বিষয়টা। ওর ধারণা, বিয়ের কথা জানাজানি হলে ওর প্রতি সেলিব্রিটি লেখকদের আগ্রহ কমে যাবে। এখনো কোনো নারী লেখককে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সিনিয়র লেখকদের সঙ্গে আপস করতে হয়। প্রাধান্য দিতে হয় তাদের ভালোলাগাকে। ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে।

পুরস্কারের খবরটি শুনে খুশি হয়েছে অর্পণ। ফুলের তোড়া নিয়ে এসে ওকে উইশ করে গেছে। সুফিয়া জানে, অনেকেই ওর লেখালেখির বিষয়টা পছন্দ করে না; বরং আড়ালে ইয়ার্কি করে, টিপ্পনী কাটে। তারা যে কানাঘুঁষা করছে তা-ও সুফিয়া আন্দাজ করতে পারে। তবু ও আনন্দটাকে ভাগাভাগি করে নিতে চাচ্ছে। কাছের মানুষদের জানাচ্ছে ফোন করে। পোস্ট দিয়েছে ফেসবুকে। লাইক আর কমেন্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে সেখানে। কিছুক্ষণ পরপর ফেসবুকে ঢুকে লাইক কমেন্ট গুনছে। দেখছে কে লাইক দিল, কে কমেন্ট করল। ও সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টের উত্তর দিচ্ছে। সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। জানাচ্ছে ভালোবাসা।

এই শহরে ও একদিন পা রেখেছিল লেখক হওয়ার বাসনা নিয়ে। বেশ কয়েকজন নামীদামি লেখকের সঙ্গে দেখা করেছে উপযাজক হয়ে। নিজের লেখা দেখিয়ে তাদের মতামত চেয়েছে। লেখা নয়, ওর রূপের প্রশংসা করেছে সবাই। চায়নিজ রেস্তোরাঁয় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিভৃতে ওর সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। কয়েকজন রাতে থাকারও ইঙ্গিত করে। দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণও করেছিল কেউ কেউ। তবে ও কারও পাতানো ফাঁদে পা দেয়নি। সতর্ক থেকেছে সব সময়; বজায় রেখেছে আত্মসম্মান।

সুফিয়ার এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে সবাই অবাক। ওর নামটি যে বেশির ভাগ পাঠক শোনেনি কখনো। পড়েনি এই নামের লেখকের কোনো লেখা। কেবল ফেসবুকের বন্ধুরা ছাড়া। ওর গল্প স্বনামধন্য কোনো পত্রিকায় বা লিটল ম্যাগাজিনে কখনো প্রকাশিত হয়নি। ও যে গল্প পাঠাত না, তা নয়। পাঠাত। কিন্তু কোনো সম্পাদক ওর লেখা প্রকাশ করেনি। কয়েকটা ছোটখাটো লিটল ম্যাগাজিনে অবশ্য ওর কিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গল্পগুলোর সংকলন নিয়ে অখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানকে কিছু টাকা দিয়ে গল্পগ্রন্থটি বের করে দিয়েছিল অর্পণ।

সুফিয়ার ধারণা ছিল, একটি সাহিত্য পুরস্কার ওকে খ্যাতির মধ্যগগনে নিয়ে যাবে। সবাই ওকে মাথায় তুলে নাচবে। ওর নামে ধন্য ধন্য করবে; কিন্তু না, তেমন কিছুই হচ্ছে না। কেউ ওকে নিয়ে ফেসবুকে ন্যূনতম একটি পোস্ট পর্যন্ত দেয়নি। অথচ ও যে পোস্ট দিয়েছে, সেখানে লাইক পড়েছে হাজারের ওপর। সঙ্গে অসংখ্য কমেন্ট।

 

তিন.

মাস তিনেক আগের কথা এই মুহূর্তে সুফিয়ার মনে পড়ছে। রেজাউল সিদ্দিকী শরীফ ওকে মেসেঞ্জারে নক করেছিল। মধ্যরাতে। সবুজ বাতি জ্বলছিল তখন; সুফিয়া চ্যাট করছিল অর্পণের সঙ্গে। ও কিছুটা অবাক হয়েছিল এমন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি ওকে নক করেছে বলে।

সুফিয়া জানত, ষাটোর্ধ্ব শরীফ এখন বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের রথী-মহারথীদের অন্যতম; তরুণদের কাছে আদর্শও বটে। কলকাতার পাঠকরাও তার লেখা পছন্দ করেন। শরীফ কেবল বাংলা একাডেমি পদক নয়, পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার। সুফিয়া কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে, ওকে শরীফের মতো কোনো সেলিব্রিটি সাহিত্যিক নক করতে পারে।

হাই বলতেই ও একটু ভেবে রিপ্লাই দেয়। তারপর আলাপ শুরু। চ্যাটিং চলতে থাকে। কথায় কথায় ওকে শরীফ প্রশ্ন করেন, আপনি কি সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা চান?

ওর ইতিবাচক উত্তরের পর শরীফ বললেন, তাহলে আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। আপনি রাজি হলে আমাকে জানাবেন।

কী করতে হবে? সুফিয়া জানতে চায়।

সব কথা তো এখানে বলা যাবে না। যদি আপত্তি না থাকে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। সামনাসামনি বলব।

কোথায় আসতে হবে? সুফিয়া জানতে চায়।

ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। শরীফ উত্তরে জানান।

আচ্ছা আসব। কখন আসতে হবে বলুন।

আগামীকাল বিকেল চারটা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে আসুন। আর আসার সময় আপনার প্রকাশিত গল্পের বইটির পাঁচ কপি নিয়ে আসবেন।

ঠিক আছে। নিয়ে আসব।

সেদিনের মতো শুভরাত্রি বলে চ্যাট শেষ করে সুফিয়া।

 

পরদিন ঠিকানানুযায়ী যথাসময়ে সুফিয়া পৌঁছে যায়; বাসা খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। শরীফ সাদরে ওকে বরণ করে নেন।

ড্রয়িং রুমে জমে ওঠে তাদের আড্ডা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের লেখকদের নিয়ে চলে আলোচনা। শরীফের জ্ঞানের বহর দেখে সুফিয়ার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এত জানে কীভাবে লোকটা! এই সময়ে কারা কারা ভালো লিখছেন, তাদের নাম বলতে গিয়ে সুফিয়ার নামও তিনি উল্লেখ করেন। নিজের নাম শরীফের মুখে শুনে ওর মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়।

কথা প্রসঙ্গে সুফিয়ার একটি গল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন শরীফ। দিন কয়েক আগে গল্পটি সুফিয়া ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। ফ্রয়েডের তত্ত্ব এনে এমনভাবে ওর গল্পটাকে তিনি বিশ্লেষণ করলেন, খুশিতে সুফিয়ার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। এভাবে ও ভাবেনি কখনো; কারণ ফ্রয়েড ওর পড়া ছিল না। ওর পড়াশোনা নিয়েও শরীফ উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। এসব কথা শুনে সুফিয়া লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে; তবে ও বিশ্বাস করে শরীফ একেবারে মন থেকে কথাগুলো বলেছিলেন। সেখানে কোনো ছলচাতুরী ছিল না; কিংবা থাকলেও সুফিয়া তা অনুধাবন করতে অক্ষম ছিল।

গল্পে-আড্ডায় মশগুল থাকার কারণে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে, সুফিয়া বুঝতেই পারেনি। এতক্ষণ যে বিষয়টি ওর নজরে আসেনি তা হঠাৎ ওকে শঙ্কিত করে। কাউকে দেখছি না যে; বাসায় কি আর কেউ নেই? ওর প্রশ্ন শুনে শরীফ বললেন, সবাই বেড়াতে গেছে। তিন দিন পর ফিরবে। আপনার কোনো অসুবিধে বা আপত্তি না থাকলে আমার বাসায় রাতে থাকতে পারেন। আপনার লেখালেখি ও গল্প নিয়ে আরও গল্প করা যাবে।

লোকটা বেশ গল্পপ্রিয়। গল্প করতে সুফিয়ারও বেশ ভালো লাগছিল। দিকপাশ না ভেবে ও থাকার ব্যাপারে রাজি হয়ে যায়। শত হোক শরীফ ওর বাবার বয়সী।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে দুজন আরও কিছুক্ষণ গল্প করেন। তারপর ওকে গেস্টরুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে শরীফ চলে যান নিজের বেডরুমে। ও ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়। বলা তো যায় না, পুরুষ মানুষ বলে কথা।

মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে সুফিয়া টের পায়, ওর খাটে কোনো পুরুষ; সরিয়ে দিলেও বারবার ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর ও সব শক্তি হারিয়ে ফেলল। হরিণ কি পারে নিজেকে বাঘের থাবা থেকে রক্ষা করতে! একপর্যায়ে ও নিজেকে আর রক্ষা করতে পারেনি। আত্মসমর্পণ করে। এক বুভুক্ষু শকুন যেন সারা রাত খুবলে খুবলে খেয়েছিল ওকে।

 

চার.

ওই ঘটনার কথা সুফিয়া কাউকে কখনো বলেনি। একবার ভেবেছিল সবার সামনে শরীফের মুখোশ উন্মোচন করে দেবে। পরক্ষণে আত্মসম্মানের কথা ভেবে কাউকে কিছু বলেনি। ও জানত, এই কথা প্রকাশ করলে সবাই ওকে দোষারোপ করবে। আঙুল তুলে বলবে, তুমি একটা মেয়ে হয়ে তার বাসায় রাতে থাকতে গেলে কেন। দোষ তো তোমার।

এ রকম সাতপাঁচ ভেবে অর্পণকে পর্যন্ত ও কিছু বলেনি। অর্পণ জানতে পারলে নির্ঘাত কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। রেগে গেলে অর্পণের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এসব বিবেচনায় মনে ব্যথা নিয়েই দিন পার করছিল সুফিয়া।

আজ পুরস্কার পাওয়ার পর অকস্মাৎ সুফিয়ার মনে পড়ে শরীফের কথা। সে কথা কেউ কোনো দিন জানতে পারবে না। জানতে দেওয়া ঠিক হবে না। মনের মধ্যে চেপে রাখতে হবে সারা জীবন। সুফিয়া ভাবে, এই পুরস্কারের সঙ্গে সেই রাতের কি কোনো যোগসূত্র আছে!

 

পাঁচ.

পুরস্কারদাতা সংগঠনটি সুফিয়ার সঙ্গে তারপর থেকে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করে। যথাসময়ে যাতে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির থাকে, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়। ও নিজের মতো করে সব বুঝে নেয়।

অনুষ্ঠান চলাকালীন মধ্যস্থতাকারীকে কল দিয়ে সুফিয়া বলল, আমি এই পুরস্কার গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে জন্য আসছি না আপনাদের প্রোগ্রামে। কথাটি যেন অনুষ্ঠানের মঞ্চে ঘোষণা করা হয়। পুরস্কার গ্রহণ না করার কারণ জানতে চাইলে সুফিয়া বলল, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।

সুফিয়া খাতুনের পুরস্কার বর্জনের কথা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে উপবিষ্ট সভাপতি রেজাউল সিদ্দিকী শরীফের মুখটা বিমর্ষতায় ছেয়ে যায়।

 

ছয়.

ওই সপ্তাহের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার শুক্রবারের সাহিত্যপাতায় সুফিয়া খাতুনের বইটি নিয়ে একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়। লিখেছেন সম্পাদক স্বয়ং। সেখানে তিনি প্রশংসাসূচক এই মন্তব্য করেন, তরুণদের ভেতর এত ভালো গল্প লিখছেন কেউ, তা তার ধারণার মধ্যে ছিল না।

লেখাটি পড়ে সুফিয়া নড়েচড়ে বসে। ফেসবুকে অনেকে পত্রিকার লেখাটি শেয়ার করে; কেউ কেউ ব্যক্ত করে বইটি কেনার ও পড়ার আগ্রহ।

অর্পণ সেদিন ওকে কথা প্রসঙ্গে জানায়, তোমাকে বলতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম, কিছুদিন আগে তোমার বইটি নিয়ে চমৎকার একটি রিভিউ সৌরভ অভিরূপ নামের একজন তরুণ লেখক পত্রিকায় লিখেছিল। ফেসবুকে ওই রিভিউটি এক বন্ধু শেয়ার দেওয়ায় আমার চোখে পড়ে। আমার ধারণা, এই পুরস্কারের নেপথ্যে সেই রিভিউয়ের ভূমিকা আছে।

‘সৌরভ অভিরূপ’ নামটি শুনে সুফিয়া চমকে ওঠে; মনে পড়ে পূর্বপরিচিত এক লেখক-বন্ধুর কথা, ওর প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানোর কারণে যাকে ও একসময় ফেসবুকে ব্লক করেছিল।

মাস ছয়েকের মধ্যে আরও কিছু নামীদামি তরুণ লেখক পুরস্কার ঘোষিত হয়। তার মধ্যে সুফিয়া খাতুনের বইটি জিতে নেয় তিনটি।

আর কিছুদিন পর শোনা যায়, বইটি অনূদিত হতে চলেছে ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষায়।

 

আরও পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প- শূন্যতার গোলকধাঁধাঁ