কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

প্রেমেনবাবুর গ্রামে- বৈদূর্য্য সরকার- গল্প

জানলার বাইরে ঘন অন্ধকার। অন্ধকারে দৃষ্টি না চললেও বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছে পলাশ। বোঝা যায় তার মধ্যে নড়ছে কিছু গাছগাছালি, আসাযাওয়া করছে দু’একটা ছোটোখাটো জন্তু। দেখতে পায় জোনাকি উড়ে বেড়ায়। নতুন অবস্থায় রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেতো পলাশের। এমন একটা দূরত্ব, বাড়ি থেকে যাতায়াত করা যায় না। নয়তো এই অগা ভগবানপুরে থাকার কোনও কারণ নেই।

এতদিন সপ্তাহের শেষে বাড়ি যাওয়া চলছিল, কিন্তু লকডাউন হয়ে যাওয়াতে পলাশ আটকে পড়েছে। এই মফস্বল অঞ্চলে ট্রেনটাই ছিল ভরসা। অতিমারির ধাক্কায় সে জিনিসটা অকেজো হয়ে পড়েছে বলে সকলের হয়েছে মহা মুশকিল। ট্রেন আর টোটোই এখানকার যোগাযোগের মূল মাধ্যম। ট্রেন না থাকলে বাস রুটে ব্রেক জার্নি করে যেতে প্রচুর সময় লেগে যায়। অবশ্য এখন তাও বন্ধ। আর নতুন ফ্লাইওভার হওয়ার চক্করে মেন রাস্তা ভেঙেচুরে যা ছিরি হয়েছে একেবারে গরুর গাড়িতে চড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।

পলাশ যেখানটায় থাকে তার থেকে একটু দূরে চৌমাথায় কিছু দোকানপাট। দরকারে ওখানেই টুকটাক কেনাকাটা করে। ওটা মুসলমান মহল্লা। সেখান থেকে আরেকটু এগোলে ক্রিস্টানদের পাড়া। পলাশ ঘুরতে ঘুরতে দেখে এসেছে, দু’টো ছোট চার্চও আছে। এই ক’দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছে, লোকে এখানে যে কোনও পালাপার্বনে আমোদ করে। তবে আমোদের উপকরণ খুব বেশি নেই ইদানীং। বাংলার একটা ঠেক আছে বটে, তবে এখন সেখানেও ঝাঁপ ফেলা।

প্রথম প্রথম এখানে আসার পর, চৌমাথায় একটা পুরনো চেহারার চায়ের দোকানে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে চা খাওয়ার সময় আশপাশের লোকজনের কৌতূহল নিবারণ করতে হতো ওকে। নতুন লোক এলে সহজেই চোখে পড়ে সবার।

প্রাচীন বটতলার পাশে যে সরকারি অফিস, সেখানে কাজ করতে আসা বাইরের লোকজনকে আগেও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে দেখেছে লোকে। সেজন্যে পলাশও কিছুদিনের মধ্যে মিশে গেছিল এখানকার লোকেদের সঙ্গে। অফিসে অধিকাংশ কাজ ওর জন্যেই অপেক্ষা করে থাকে।  বাকি কলিগদের অর্ধেকবয়স্ক পলাশ অন্যদের থেকে কাজকর্ম চটপট করতেও পারে। ফন্দিফিকির করে কাজ না করার কায়দা এখনও রপ্ত হয়নি তার।

ক’দিন ঘূর্ণিঝড়ের খবরে গোটা রাজ্যে একেবারে হইহই কাণ্ড। এমনিতেই লকডাউনের বিকেলে দোকান বাজার বন্ধ। আর ঝড়ের পূর্বাভাসে সকালের খাবারটা তাড়াতাড়ি দিয়ে হোম ডেলিভারি হাত তুলে দিল। রাতের খাওয়াটাই মুশকিলের। অগতির গতি ম্যাগি আছে অবশ্য। টুকটাক দু’একটা জিনিস পলাশ বানিয়ে নিতে পারে ইণ্ডাকসান ওভেনে। ভাগ্যিস ইলেক্ট্রিক আছে এখনও।

পলাশ ভেবে দেখেছে, এই মফস্বলে একা ঘরে চুপচাপ বসে না থেকে এসব নিয়ে খানিকটা সময় কাটে ইদানীং। নয়তো সেই ব্লু টুথ স্পিকারে গান শোনা অথবা মোবাইল ঘাঁটা। সিরিয়াস পড়াশোনার মতো ধৈর্য আজকাল নেই ওর।

ঘূর্ণিঝড় আর নিম্নচাপের ঠেলায় দুতিনদিন টানা বৃষ্টি চলছে। ঘর থেকে বেরোনোর উপায় নেই। আশপাশে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়াতে পুরনো লোকজনের মনে  বন্যার স্মৃতি ফিরে এসেছে। বেশি ঝামেলা না করে পলাশ দু’তিনদিন আলসেমি করল। এমনিতেই এখানে অফিসকাছারি প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। তার ওপর লকডাউনে যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল। লোকে আসবেই বা কী করে!

শুনেছে এই এলাকাটায় আগে লোকবসতি ছিল না। নগরায়নের ঠেলায় চাষের জমি ক্রমে বাস্তু জমিতে পরিণত হয়েছে। বাড়িওলার মুখে শুনেছে, ঘরের পেছনের জলা জায়গাটায় দশ বিশ বছর আগেও নাকি বর্ষার সময় লোকে মাছ ধরতে আসতো। ইদানীং অবশ্য জল শুকিয়ে গেছিল একেবারে।

পলাশ লক্ষ্য করল, বিকেল থেকে দরজার ফাঁকফোকড় থেকে দলে দলে ডেয়ো পিঁপড়ে এসে জমা হয়েছে ঘরের দেওয়ালে। সে নিশ্চেষ্ট বসে দেখতে থাকলো। বাসায় জল ঢোকাতে পিঁপড়েগুলো উদ্বাস্তু হয়েছে বোধহয়। কিছুক্ষণ বাদে খেয়াল করলো, দুটো টিকটিকি উপস্থিত হল সেখানে। তার মহানন্দে পিঁপড়েগুলোকে খেতে লাগলো। পলাশের মনে হল, সুযোগ পেলে সবাই সদ্ব্যবহার করে। কতলোক ঝড়জলে গৃহহারা হলে কিছু লোক যেমন তাদের ত্রাণের জিনিসে ভাগ বসায়। তবে সেসব নিয়ে ভেবে ওর লাভ নেই। অনেক লোক বলে, ওরাও তো কাজকর্ম না করে মাইনে নিচ্ছে। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে সবই অপরাধ।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বেল বাজার শব্দে চমকে উঠল পলাশ। এইসময়ে আবার কে ? দরজা খুলে খানিকটা অবাক হল সে। এই বর্ষার রাতে পাশের বাড়ির কাকিমা তার জন্যে খিচুড়ি এনেছে! কাঁসার থালা বাটিতে খাবার দেখে আরও আশ্চর্য হল পলাশ।

এই প্রতিকুল পরিস্থিতিতে লজ্জা করে লাভ নেই। তাছাড়া বর্ষার সঙ্গে খিচুড়ি জিনিসটার যেন মহাকাব্যিক সম্পর্ক। সুতরাং সে রাতটা পলাশের ম্যাগির বদলে খিচুড়ি সেবা বেশ ভালই হল।

টানা বৃষ্টিতে পাশের জলা জায়গাটা ভরে উঠেছে। ঘন অন্ধকারে আকাশ বাতাস জুড়ে চেপে বসেছে একটা থমথমে ভাব। ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক মিশে তৈরি হওয়া আশ্চর্য একটা শব্দের মধ্যে ভাল ঘুম আসছিল না পলাশের। রাতে নানা উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় ভর করছিল তার। নানা অ্যাপে পড়া বিচিত্র সব গল্পের ছবি মনে উড়ে আসছিল।

২.

পাশের বাড়ির ভদ্রলোকটি রোগাভোগা দেখতে হলেও কথাবার্তায় বেশ একটা পালিশ আছে, এখানে এসে লক্ষ্য করেছিল পলাশ। তবে ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রকৃত অর্থেই এমন মহিলা, যার সাথে দু’টো কথা বললেই মনটা ভাল হয়ে যায়। সবথেকে আশ্চর্য লেগেছিল, এইরকম একটা জায়গায় একটেরে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের অট্টালিকাটাকে দেখে। মনে আছে, প্রথম দিকে বাড়িওলা মুকুন্দবাবু ওদের সাথে আলাপ করানোর সময় বলেছিলেন – এরাই এখানকার সব জমির মালিক ছিল। তবে সেসব ভদ্রলোকের দাদুর আমলের ব্যাপার । ঘটি থেকে গড়িয়ে জল খেতে থাকলে যা হয়…। বাড়িটার ভাঙাচোরা চেহারা দেখে আঁচ করেছিল পলাশ। তবে ভদ্রলোকের নামের বাহার আছে বেশ – প্রেমেন্দ্রনারায়ণ সিংহ। শুনলে কেমন যেন সমীহ জাগে। লোকে অবশ্য নামটাকে কেটেছেঁটে নিয়েছে, প্রেমেনবাবু বলে।

অবশ্য পরে যাওয়া আসার পথে ভদ্রলোক নয়, তার স্ত্রীর সাথে টুকটাক কথাবার্তা হতো পলাশের। তাদের গাছের দারুণ মিষ্টি আমও খেয়েছিল পলাশ। তবে রান্না করা খাবার এই প্রথম। সকালে যখন হোম ডেলিভারির লোকেরা যখন এসেছিল, দরজায় দাঁড়িয়ে কাকিমা শুনেছিল তাদের কথা… রাতে খাবার বন্ধ।

কারণ যাই হোক, ব্যাপারটা বেশ ভালই লেগেছিল পলাশের। এমনিতে সে ছোট থেকে চেনা চৌহদ্দির বাইরে বিশেষ কথাবার্তা না বলতে পারলেও বাড়ির বাইরে এখানে কিছুদিন থাকার জন্যেই আশপাশের লোকেদের সাথে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

সেজন্যেই আশপাশের কিছু আঞ্চলিক মিথ জানতে পেরেছে, তেমন জেনেছে নানারকম কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কথা।

চায়ের দোকানে দু’চারদিন পরপর নতুন লোক দেখলে তাকে ঘিরে ধরে আড্ডার ঘুণ লোকেরা। সবাই  মিলে তাকে এখানকার ইতিহাস ভুগোল বুঝিয়ে দিতো। মন্দ লাগতো না পলাশের।

অবস্থা যখন স্বাভাবিক ছিল, আশপাশের অঞ্চলে টুকটাক ঘোরাঘুরি করেছে পলাশ। কখনও সঙ্গী মিলেছে, বেশিরভাগ সময়ে একা। ইতিহাসের আনকোরা চিহ্নগুলো একা খুঁজে পাওয়ার মজাই আলাদা। পলাশের মনে হতো, শিয়ালদা থেকে লালগোলা লাইনটাকে ফলো করতে পারলে বাংলার ইতিহাসের অনেকটা কভার হয়ে যায়। আর এদেশিরা তো মেনে চলে শান্তিপুর কৃষ্ণনগরের সংস্কৃতি।

তার অনেক বন্ধুবান্ধব অন্য রাজ্যে বা বিদেশে গেছে কাজের সূত্রে। সে এসে পড়েছে এই গণ্ডগ্রামে। তবে এসব নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে তার মনের গ্লানি যেন খানিকটা কমত। তার তোলা এইসব অনালোচিত জায়গার ছবি আর টুকরো কথাবার্তা ফেসবুকে লিখতে লাগল পলাশ। অনেকে বেশ উৎসাহ দেয় । কেউ কেউ বুদ্ধি দেয় বই করার। তবে পলাশ শুনেছে থ্রিলার বা হরর ছাড়া বই বিকোয় না।

পরের দিন সকালে বৃষ্টি ধরেছে একটু। সকালেই তার কাছে বাড়িওলা এসে উপস্থিত। লোকটা চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথাবার্তা বলে এড়িয়ে চলে পলাশ। ঘরে এসে বললে শোনা ছাড়া কোনও উপায় নেই অবশ্য।

আজ অবশ্য একটা আশ্চর্য কথা শুনল পলাশ।

বাড়িওলা গলার স্বর নামিয়ে বলে উঠল,  আগে কিছু বলিনি… প্রয়োজন হয়নি বলেই। তবে ও বাড়ির লোকেদের সাথে বেশি মেলামেশা না করাই ভাল।

অবাক হয়ে তাকাতে তিনি বলে চললেন, ওদের সম্বন্ধে লোকে নানা কথা বলে। কেউ বলে পুর্বপুরুষ ডাকাতি করে এই সম্পত্তি করেছিল। আবার অনেকে তন্ত্রমন্ত্রের কথাও বলে থাকে।

মোদ্দা ব্যাপার যেটা, ওনাদের নাকি লোকে এড়িয়ে চলে। সবাই বলাবলি করে ভগবান শাস্তিও দিয়েছে যথেষ্ট। নির্বংশ হতে বসেছে। পলাশ আগেই শুনেছিল, ওই ভদ্রলোকের একমাত্র মেয়ে জন্ম থেকেই ভুগছে।

ওদের বাড়িটাই সবথেকে পুরনো। তারপরে ক্রমে ক্রমে লোকবসতি তৈরি হয়েছে এখানে। পুরনো বাড়ি সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত কাহিনি না থাকলে যেন ঠিক জমে না।

পলাশ কল্পনা করে দেখল- পেছনে বিস্তৃত জলা জমি, সামনে বিরাট অট্টালিকা এবং আশপাশে ধুধু ফাঁকা জমি। বেশ গর্জাস একটা ছবি। এলাকা যখন ওদের অধিকারে ছিল, বাড়িতে লোকজন ঘোড়া বন্দুক অস্ত্রশস্ত্র ছিল নিশ্চয়। সুতরাং একটা নাচঘর বা গোপন খুনজখমের ইঙ্গিত থাকলে গল্প জমে যাবে একেবারে। কিন্তু কোন আমলে এরা জমিদারি ভোগ করতো? সেই ইতিহাসটা পাওয়া গেলে ষোলোকলা পূর্ণ হয়।

 

৩ .

বেলার দিকে পলাশ আগের দিনের বাসনগুলো ধুয়ে গুটিগুটি পায়ে ওদের বাড়ির দিকে রওনা হল। ফাঁকা পাত্র ফেরত দিতে নেই শুনেছে বটে। কী দেওয়া যায়? তবে ওর কাছে দেওয়ার মত কিছু নেই আপাতত।

সকালে বাড়িওলার কথাগুলো শুনে ওর আগ্রহ যেন খানিকটা বেড়ে গেছে। হতেও তো পারে কোনও রহস্যের ব্যাপার। বাড়িওলা অজান্তেই যেন একটা গল্পের সন্ধান দিয়ে গেল!

বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখলে যতোটা পুরনো মনে হয়, ভেতরে ঢুকে ততোটা লাগছে না। সদর পেরিয়ে যাওয়ার সময় পলাশ দেখলো পাশে একটা পুরনো ঠাকুরদালান। তার সামনে হাড়িকাঠ। নিশ্চিত তন্ত্রের ব্যাপার, কাকে বলি করা হতো কে জানে! খুঁজলে হয়তো দেবীর অলৌকিক কোনও খাঁড়া মিলতেও পারে। তবে সব জিনিসেই দীর্ঘ সময়ের ধুলো পড়ে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেছে। সে কারণেই হয়তো ভয়ের ভাবটা ঠিক জাগছে না, মনে হল পলাশের।

তার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে এগিয়ে এলেন ও বাড়ির ভদ্রলোকের স্ত্রী। এনাকে কাকিমা বলে ডাকা যায় খুব সহজে।  ঘরের দরজা দিয়ে এক পা ঢুকে বাসনগুলো রাখার সময় পলাশ দেখল, একটা মেয়ে ঘরে আছে। তার কৃশ চেহারা, পেছন থেকে দেখে কিশোরী বলে মনে হয়। কিন্তু মুখের দিকে নজর করে পলাশের মনে হল, তার মতোই বয়স হবে। সে ধারণা করল, লোকে যে রুগ্ন মেয়েটার কথা বলে – এ সেই।

উপোসি পলাশের অল্পবয়সী চোখে এই ভাঙাচোরা অট্টালিকায় একে দেখে ঘুমন্ত রাজকন্যে বলেই মনে হওয়ার কথা। সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে যাকে। তবে সেই কয়েক মুহূর্তে পলাশ আর বেশি ভাবার অবকাশ পেল না। আর এ অবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়ের হাত ধরার অধিকার শুধুমাত্র ডাক্তারদেরই  থাকে।

পলাশকে কাকিমা নিয়ে গিয়ে বেশ আন্তরিকভাবেই একটা পুরনো কাঠের চেয়ারে বসাল। তার অদূরেই ভদ্রলোকটি একটা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন।

ভদ্রলোক ঠিক রাশভারী নয়। আবার খুব সহজ হওয়াও যায় না তার সাথে। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন গভীর। তবে কথাবার্তা বা ব্যবহারে বেশ একটা রুচিশীলতার ছাপ আছে। অবস্থা পড়ে যাওয়ার কারণেই হয়তো খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছেন। টাকার জোগান না থাকলে লোককে যে সামাজিকভাবে কর্ণার করে দেওয়া হয়, সে কথা ভালই জানা আছে পলাশের।

পলাশ লক্ষ করে দেখল, প্রেমেনবাবুর গায়ের রঙ বেশ পরিস্কার।  চেহারার গড়নও বেশ ভাল বলা যায়। লোকে যাকে বলে কন্দর্পকান্তি। তুলনায় ওনার স্ত্রী বেশ সাধারণ। আগে তেমন কথাবার্তা না হলেও আজ ধীরগতিতে কথাবার্তা শুরু হল।

পলাশ মোটামুটি নিজের পরিচয় দিয়ে থামল। সে শহরের ছেলে এখানে থাকতে অসুবিধে হচ্ছে নিশ্চয়, সন্দেহ প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। তবে ধীর স্থিরভাবে একথাও অবশ্য বললেন, অবস্থার বিপাকে পড়লে মানুষকে অনেক অদ্ভুত কাজই করতে হয়। পলাশ ঘাড় নাড়ল।

কথায় কথায় সুযোগ পেয়ে পলাশ এখানকার পুরনো কথা তুলল। উনি হেসে বললেন, তোমার বাড়িওলা বলেছে বোধহয়। উত্তরে পলাশ একটা সলজ্জ হাসি ছাড়া কোনও উত্তর দিতে পারল না। ভদ্রলোক উত্তরে হেসে বললেন, আসল কথা হল একটু আলাদারকম কিছু দেখলেই লোকে নানারকম রটায়।

তবে এই অঞ্চলের জমি জায়গা তাদের অধিকারেই ছিল। জমিদারি ইত্যাদি ওঁর জন্মের আগেই গেছিল। জমিজমাও যা ছিল বাবার সময়েই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন এই বাড়িটাই শুধু আছে। এই বাড়ি মেনটেন করাই একটা সমস্যা। উনি প্রাইভেটে সাধারণ একটা চাকরি করতেন, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। এখন বাড়ি ঘর সংসার প্রতিপালন এবং মেয়ের চিকিৎসা চালানো নিয়ে মুশকিলে পড়েছেন খুব।

তবে তন্ত্রমন্ত্রের একটা ধারা ছিল হয়তো পরিবারে। ছোটবেলায় কালিপুজোয় বলি দেখেছেন। তবে সে পুজোপদ্ধতি সম্বন্ধে ওনার জ্ঞান বাকিদের মতোই ভাসাভাসা।

কোনও এককালে কলেরায় অঞ্চলের বহু লোকের সঙ্গে তাদের বাড়ির লোকেরাও মরাতে ভয় ব্যাপারটা সকলের মনে চেপে বসেছে। হয়তো দেবীর কোপ!

পলাশ বলল, আপনাদের পদবী সিংহ মানে তো রাজপুতদের বংশ। সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নন তিনি। কারণ সিং বহু জাতেই হয়। আর রাজপুত হলেও তার চিহ্নমাত্র নেই এখন। তারপর বাচ্চা ছেলেকে বোঝানোর মতো করে পলাশকে বললেন, শুনেছি বাঙালিদের উচ্চবর্ণের সবাই তো বাইরে থেকেই এসেছিল।  মুর্শিদাবাদের নবাবদের আশপাশের এসব অঞ্চলে কাজকর্মের সুযোগ সুবিধার জন্যে এককালে বাইরে থেকে অনেক লোক এসে থাকবে নিশ্চয়।

তবে একটা কথা উনি একবারে এক্সক্লুসিভ বললেন, সেটা পেছনের জলাটা সম্বন্ধে… এখন হেজে মজে গেলেও ওটা নাকি ছিল যমুনা নদীর ধারা ছিল। শুনে বেশ চমকে উঠল পলাশ।

পলাশের কল্পনাপ্রবন মনে ক’শো বছর আগের ছবি ফুটে উঠল। সেই সপ্তগ্রাম বন্দর হয়ে যমুনা নদী বেয়ে এখানে এসে পড়েছে কত দূরের দেশ থেকে আসা মানুষ। রুক্ষ শুকনো দেশ থেকে একদল লোক এসে পৌঁছোল জলকাদার এ দেশে। হয়তো মাটির তলা থেকে কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের জাহাজের মাস্তুল।

মানুষের সভ্যতায় মাইগ্রেশান যে মূল ব্যাপার সেটা কে না জানে! জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ওকেও ঠাইনাড়া হতে হয়েছে যেমন।

সেদিন রাতে খেয়েদেয়ে উঠে জলার দিকটায় একটা অস্পষ্ট আলো জ্বলতে দেখে চমকে উঠল পলাশ। এটা কি আলেয়া! আগে কোনওদিন দেখেনি তো। কিছুক্ষণ পর অনভ্যস্ত চোখে তার মনে হল, মাছ ধরতে এসেছে কেউ? কিন্তু এই দু’তিনদিনের জমা জলে কী এমন মাছ আছে! কোনও লোক এই সামান্য আলো নিয়ে ওই পাঁকের রাজত্বে নেমে করবেই বা কি! তবে কি সে খুঁজছে কিছু ? গুপ্তধন গোছের কিছু নাকি!

রাত গভীর হতে ওর চিন্তাভাবনাও পালটে গেল খানিক। বাড়িওলার মুখে শোনা ভুতুড়ে ব্যাপারগুলো যেন বেশি করে মনে পড়তে লাগল। সত্যিই কি তন্ত্রমন্ত্র ভূতপ্রেতের কোনও ব্যাপার আছে! শরীরটা যেন কেমন শিরশির  করে উঠল পলাশের। এই জলার ধারে কি পেত্নির বাস!

ফেসবুকে নানারকম গ্রুপে বহু বইপত্রের বিজ্ঞাপন দেখেছে পলাশ। অর্ডার দিয়ে আনিয়ে পড়েও দেখেছে। এমনিতে ভূত প্রেত নিয়ে লোকজনের আগ্রহ তো বরাবরই ছিল। তার সাথে ইদানীং যোগ হয়েছে নানারকম সাইকোলজির ভোজবাজি আর তন্ত্রের বাড়াবাড়ি। পলাশের মতো সব লোকেরই থ্রিলার আর হরর পড়ে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে।

 

৪.

দু’চার দিন বিরূপ আবহাওয়া ও অনুপস্থিতির কারণে হেড অফিসের সাথে সেভাবে যোগাযোগ হচ্ছিল না। তাই খবরটা দেরিতে পৌঁছলেও তা পলাশের প্রাণে বেশ একটা হিল্লোল উঠল। বছর তিনেকের এই নির্বাসন কাটানোর পর শহরে তার বদলি হওয়ার সংবাদ এসেছে। তবে শরীরটা যেন ঠিক জুতে নেই ওর। ওয়েদারের জন্যেও হতে পারে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্যে কিছু বেশি টাকা দিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলল পলাশ। এবার বিদায়ের পালা।

অন্য সবার মতো আগের দিন ও বাড়ির কাকিমাকেও সে কথা বলা গেল। ওঁরা যেন ক’দিনে পলাশের ওপর খানিকটা ভরসা করে ফেলেছেন।  তাই ওর সাথে গাড়িটা করে কিছুদূর যাওয়ার আবদার করে ফেললেন। মেয়ের ডাক্তার দেখানোর ডেট পড়েছে। এমনিতে এখানে গাড়ি সহজে মেলে না। পলাশের আপত্তির কিছু নেই। ফেরার ব্যবস্থা ওনারা যাহোক করে নেবেন।

গাড়িতে পলাশের ঘণ্টা চারেকের পথ। তবু কিছুটা সময় ওদের সাথে কথাবার্তা বলেও কাটলো। নামার সময় বেশ একটা মনকেমনের পরিস্থিতি হল। সেই রুগ্ন মেয়েটার ক্লান্ত চোখের শান্ত ভাবটা পলাশের মনে থেকে গেল অনেকক্ষণ। কোথা থেকে কানে কানে কে  যেন বলে উঠল, আবার দেখা হবে!

তিনবছর বাদে পাকাপাকি বাড়ি ফেরার পর মহা বিপদে পড়ল পলাশ। আমোদ উল্লাসের বদলে শয্যাশায়ী হল পলাশ। অতিমারির জীবাণু তাকে অধিকার করে বসেছে। অবস্থা খুব বাড়াবাড়ি না হলেও সতেরো দিন ঘরে আটকা পড়ে থাকলো পলাশ। তারপরেও শরীরে যেন জোর নেই। তবু অফিসে জয়েন করল পলাশ।

প্রথম দিকে বহু লোক তাকে গত তিনবছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করতো। সাধ্যমতো জবাব দিতো পলাশ। তবে বলতে গেলে কম বেশি হয়েই থাকে। লোকে ওই ভদ্রলোক আর তার মেয়ের সম্বন্ধে কিছু কল্পনা করার অবকাশ পেতো নিশ্চয়।

সেসব প্রথম প্রথম বেশ উপভোগ্য মনে হতো পলাশের। ক্রমে সব ফিকে হয়ে এল। সপ্তাহ মাস বছর ঘুরে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে গেল। বাস মেট্রো পাড়া বন্ধুবান্ধব পরিচিত কোলাহলের জীবনে একা থাকার সেই সময়গুলো ক্রমে ভুলে যেতে লাগল পলাশ। অবসরে পড়া ভুতুড়ে বইপত্রের কাহিনিগুলোর মতো প্রেমেনবাবুর মেয়েটি ও তার শান্ত চোখদুটোকে ক্রমে অলীক বলে মনে হতে লাগলো পলাশের।

* বৈদূর্য্য সরকার: কলকাতা, ভারত।

আরও পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প