“এখানে কিছু টাকা পাওয়া গেছে”- ফারহিনা তোফফা- রহস্যগল্প
কংক্রিটের আবহাওয়া পেরিয়ে আরও অনেকটা ভেতরে, এক শীতল শব্দশূন্য কাঁদামাখা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে লোকটা।
বেঁটেবুটে শরীরে নীল রং-এর শার্ট, না জানি কতবার ধোয়ার পদক্ষেপে আকাশি হয়ে গেছে… খয়েরি বর্ণের প্যান্ট নোংরা লাগার ভয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই করে গোঁজা দেওয়া। মুখে তার স্বভাবজাত দুশ্চিন্তা, কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ছোট চোখ আরও ছোট দেখায়। পোস্ট অফিসের ডাক হরকরার মত কটকট ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটতে থাকে। কোথাও যেন তাড়া আছে। হয়ত কোর্টের তারিখ ধরবে নয়ত লাইসেন্স বিহীন গাড়ি ধরা পরায় তা ছাড়ানোর জন্য তদবীর করবে। হঠাৎ যেন চোখ গেল একটা বাড়ির দিকে। ঠিক কি হঠাৎ? নাকি খুঁজতে খুঁজতেই কে জানে।
গেইটে একটা সাদা কাগজে টানা হাতে লেখা “এখানে কিছু টাকা পাওয়া গেছে”। নিচে আরও লেখা- সন্তোষজনক প্রমাণ সহিত মালিক তা সংগ্রহ করুন।
আগন্তুক কি দু’দন্ড কিছু ভাবলো?
নাকি দুশ্চিন্তা এবং নিশ্চিন্তের সংমিশ্রণে একটি দীর্ঘশ্বাস নিল। ঠিক বোঝা গেল না।
ভেতরে ঢুকতেই লম্বা শুকনা করে একলোক এগিয়ে এলো আগন্তুকের দিকে। হয়ত দারোয়ান হবে। তার চোখের প্রশ্নভাব দেখেই আগন্তুক বলে- আমার টাকা হারিয়েছে কিছু। বাইরে লেখা দেখলাম তাই…
দারোয়ান তার চামড়ায় মোড়ানো শীর্ণ হাতে আগন্তুকের পিঠ চাপড়ায়, বলে অত টাকা কেউ হারায় নাকি। এ তো মিষ্টি কেনার টাকা না। এ দিয়ে গোটা প্রাসাদ কেনা যায়।
এখন কিন্তু আগন্তুক লোকটাকে ঠিক দারোয়ান ভাবতে পারছে না। কত অফিসে সে যুগযুগ ধরে কাজ করেছে। কই, কোনো দারোয়ানকে তো এত শুদ্ধ করে কথা বলতে দেখে নাই।
লোকটা তার মাথা আগন্তুকের কাছে নেয় আর ফিসফিস করে বলে- ভাই ডাকাতি করেছিলেন কী? ব্যাগখানার রং শ্যাওলা নয় তো? মহাজন কিন্তু জিজ্ঞাস করবে, বলেই দুপাটি দাঁত বের করে বিদঘুটে হাসি হাসলো। সাথে দুর্গন্ধের এক ঝাপটা ছাড়লো আগন্তুকের নাকে।

গেইট থেকে আরও একশ গজ ভেতরে দো’তলা বাড়িটা । হাঁটার রাস্তার দু’পাশে ঘাসের উচ্চতা তাদের বৃদ্ধির মাত্রা অতিক্রম করেছে। সদর দরজার সামনে দাঁড়ালে মিটার পাঁচেক ডানে অনেকগুলো শিউলি গাছ দেখা যাচ্ছে। ফুল ফোটার সময়ে সে জায়গা না জানি কত সুন্দর দেখায়। রোগা লম্বা লোকটা বাড়ির ভেতর গেল,-মিনিট দু’একের মাঝেই বেড়িয়ে এল। এবার হল ঘরে নিয়ে আগন্তুককে বসালো। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে মস্ত বড়ো হাতলের চেয়ার, তার দুই পাশে তিন থেকে চার যুগের পুরোনো ডিজাইন করা সোফা আর মাঝে নামে মাত্র ছোট্ট একটা টী টেবিল। হাতের ডানে কোনো আসবাবপত্র সেরকম নেই। একটা চার পায়া কাঠের টেবিল, তারই সাথে মস্ত বড় মাপের একটা বাক্স। সেদিকে তাকাতেই রোগা লোকটা অপ্রয়োজনীয় হাসি হেসে বলল- ‘বড়-লোকের বিশাল কারবার-গত সপ্তাহেই ফ্রীজ কেনা হয়েছে, একটা আস্ত হাতি হেঁটে যাবে এর ভেতর।”
আগন্তুকও হাসতে চাইল সম্মতিসূচক। কিন্তু হাসি কী আর আসে। টাকার দখলদার না ছাড়ানো অব্দি হাসির ময়দান ধূসর থাকবে। ঘরের বাঁ পাশের দেয়ালে কাঠের তক্তা লাগানো। সেখানে সারি সারি বই সাজানো-” টু কিল আ মকিংবার্ড, সন্দেশ, পথের দাবী’, দ্য গ্রেট গ্যাটসবি, ১৯৮৪, মোবি-ডিক, পদ্মপুরান, এত এত ভালো বই সে কখনো একসাথে দেখে নাই আগে।
হঠাৎ হাঁটার ক্ষীণ শব্দ শুনে আগন্তুক নেড়েচেড়ে বসে। তার সামনে রোগা লোকটা মদের বোতল থেকে থেমে থেমে ঢোক গেলে। মস্ত চেয়ার জুড়ে বসে মহাজন। কী দানবের মত শরীর তার।
এ বাড়িতে কী আদৌ ফ্রীজের প্রয়োজন আছে? মহাজনের চেহারা কেমন তা বোঝা দায়। সমস্ত মুখ গোঁফ দাঁড়ি আর চুলের দখলে। শুধু চোখ গুলো দেখা যাচ্ছে। কুরবানীরত গরুর চোখ যেমন ছিটকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয় ঠিক সেরকম। আচ্ছা, মহাজনদের চেহারা কী এরমই হয়? কে জানে? কে ভাববেই বা এখন এসব? আগন্তুকের মাথা জুড়ে তো কেবলই তার শ্যাঁওলা রঙের ব্যাগ। একটা শক্ত কণ্ঠে মহাজন ধমকায়-“রাখ তোর বোতল ঢালা। দিন দুপুরে মানায় না এসব মাতলামি।
এবার রোগা লোকটা কিন্তু দারোয়ানের মতই আচরণ করে। প্রভুর আদেশে তৎক্ষণাৎ বোতল নামে হাত থেকে। একটু আগেও যে কথায় কথায় দুর্গন্ধযুক্ত হাসি হাসছিল, তা এখন আর নেই।
এবার মহাজন আগন্তুকের দিকে মুখ করে বলেন- “গোলাম হলেও বহু দিনের কেনা তো, আত্মায় মিশে গেছে। তাই মদের খরচা দিয়েও ধরে রেখেছি। তা, আপনার নাকি টাকা হারিয়েছে? কত হারিয়েছে, আর কোথায়ই বা হারালেন?
এত প্রস্তুতির মাঝেও আগন্তুক অপ্রস্তুত হয়ে পরে। শ্যাঁওলা রঙের ব্যাগে ছিল কিছু টাকা।
মহাজন চোখ মুখ দৃঢ় করে। কিন্তু কিছু বলে না।
আগন্তুক আবার বলেন, এখানে ভুলে ফেলে গেছিলাম।
এখন কিন্তু মহাজন হো হো করে হাসে। আর লম্বা লোকটা বলে, এত টাকা কেউ ভুলে ফেলে যায় বুঝি?
সাথে সাথে মহাজনের মুখ শক্ত হয়ে যায়। মনে হয়, এটা চাকরের প্রতি থেমে যাওয়ার তীব্র সংকেত। চাকর থামে।
মহাজন বলেন, তা কোনো কালে থিয়েটারে কাজ করা হয়েছে বুঝি আপনার? মানে আমি খুব থিয়েটার দেখতাম, আপনার চেহারাও কেমন জানি চেনা চেনা ঠেকছে। এযাবৎ কালে যত মানুষকে আমার পরিচিত লাগে, সবার নাড়ীসূত্র গিয়ে মেলে থিয়েটারের সাথেই।
এখন আগন্তুক স্বাভাবিক হয়। সে রকম কিছুর সাথে তো আমি জড়িত নেই। তবে গান আর লাইব্রেরির সংস্পর্শে ছিলাম সবসময়। কিন্তু স্বাভাবিক হয়েই কি লাভ, খেলা তো উল্টো চলে, যখন সে একটু সহজ হয় মহাজন হয়ে উঠে বনের সিংহের মত গম্ভীর।
টাকার প্রসঙ্গে আসুন, এখানে ত আড্ডা জমালে হয় না। কার হক কে জানে। আমার কাছে আমানত। এবার বলুন সমস্ত ঘটনা বলুন।
লম্বা লোক সাথে সাথে বলে- হ্যাঁ বলুন বলুন ব্যাগ ভর্তি টাকা কেউ হারায় কীভাবে বলুন।
মহাজন সিংহের মত গর্জন করে, মাতলামি থামা তুই, এখান থেকে যা এক্ষুণি।
মাতাল কিন্তু যায় না, সে সোফার কোণ ঘেঁষে বসে পরে। মহাজনের দৃষ্টি যায় আগন্তুকের দিকে, চোখে থাকে একটা হুমকিসূচক জিজ্ঞাসাভাব।
আমার জমি বেচার টাকা ছিল সাহেব। অনেক কষ্টে জমিটা বেচেছি।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু হারিয়ে যায় কীভাবে এত টাকা, এটা তো একখানা বান্ডেল না যে হারিয়ে যাবে কোনো ফাঁকে। কারো থেকে চুরি করে পালাচ্ছিলেন নাকি? যে ভয়ে মাঝ রাস্তায় ফেলে গেলেন? সত্যি করে বলবেন। যদি আপনার একটা শব্দও মিথ্যা মনে হয়, থানা অব্দি কথা গড়াতে বেশি সময় নিব না।
মিথ্যে আমি বলছি না। এটা আমার একমাত্র শেষ সম্বল। জমিটাও বেচার ইচ্ছে ছিল না। নেহাত ঝামেলায় পরেই করলাম।
আপনার সে হিস্টুরি আমি শুনব না, হারানোর গল্পটুকু বলেন, পরে গল্পে কি সংযোজন বিয়োজন করবেন তা আমিই বলে দিব। এত টাকা কীভাবে ফেলে গেলেন?
আগন্তুক যেন ভরসা পায়, তাকে বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তার ভয় সময়ে সময়ে বাড়ে। এত টাকা কি কারো হাতে গেলে তা আর উদ্ধার হয়? এ জায়গায় লোক আরও পোস্টার টাঙিয়েছে। তাই ভরসা তো করাই লাগে। হিংস্র হলেও নিতান্ত ভদ্রলোক। আমার ছেলে জুয়ার নেশায় পরেছে। বাইরের কিছু ছেলেপুলের সাথে ঝামেলা পাকিয়েছে, জুয়ার দেনা যাকে বলে। এদিকে ঘরে আমার উপযুক্ত মেয়ে। জমিটা ভয়েই বিক্রি করে দিয়েছি। ইচ্ছে ছিল চুপিসারে শহর ছাড়ব। তা আর হলো কই? ব্যাংক এর একাউন্টও যে ছেলের। দৃষ্টি এড়াতে গোপনে জায়গা বেছে টাকাটা নিলাম, মেয়েকে আগে পাঠালাম মামার বাড়ি, যেদিন আমি যাব আমার পেছনের জুয়া আড্ডার লোক। জমি বেচার কথা কি গোপন থাকে বলেন?
এই রাস্তা ধরেই যাচ্ছিলাম আমি, টের পেয়ে এখানেই ঝোঁপের ভেতর ব্যাগ খানা রেখে যাই। পরে যখন এসে খুঁজি তা আর পেলাম কই। আজই দেখলাম আপনার বাড়ির গেইটে লেখাটা। যদিও বিশ্বাস ছিল না এত টাকা হাতে পেয়ে কেউ তা ফেরত দিতে ব্যবস্থা নেই। আপনি নিতান্তই নীতিবান লোক।।
তা বুঝলাম, টাকাটা হারালেন কবে বলেন?
আজ্ঞে, হারিয়েছি ৪/৫ দিন হয়েই গেছে।
থানা পুলিশে জানাননি কিছু, এত গুলো টাকার ব্যপার।
সে ভরসা পাইনি সাহেব, আমার এ কথায় কেই বা বিশ্বাস করবে। আমি ধারণা করেছিলাম জুয়ার বদমাশ গুলোই এ জিনিস নিয়েছে।
মহাজন চুপ থাকে, যেনো কি কি ভাবছে আর হিসেব মেলাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর মুখের দৃঢ় ভাব সরিয়ে অত্যন্ত সরল ভঙ্গিতে বলে আমরা দশ টাকার লোভও কি ছাড়তে পারি? না পারি না। লোভ হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যপার। খিদে লাগলে যেমন আমরা খাবার খুঁজি, সুযোগ পেলে আমরা তেমন লোভ করি। তবে মানুষ আর পশুর তফাৎ জানেন কি মশাই? নিয়ন্ত্রণে, উপলব্ধিতে আর অপসারণে। আপনি যা বললেন, তা বিশ্বাসযোগ্য, আবার বিশ্বাসযোগ্যও নয়, তাই আমি আপনাকে বলছি, রিজিক বড় শক্ত জিনিস, আল্লাহ নিজের হাতে যে দলিল করে দিয়েছে সেখানে কাটাছেঁড়া করা কিন্তু সহজ কথা নয়। এটা যদি আপনার না হয়, অন্যের হক হয়, আপনি এখনো স্বীকার করে চলে যেতে পারেন। আমি এটাকে অতিস্বাভাবিক ভুল ভেবে তুচ্ছ জ্ঞান করব।
আরও পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প- রয়্যালিটি
আপনি যা বললেন আমি সবটাই বুঝলাম, এবং আমি সত্যি বলছি এ টাকা আমার। যদিও এটা আমার কামাই করা নয়, তবে বাপ দাদার সম্পদ অনেক কষ্টে ধরে রেখেছিলাম। কঠিন অভাবেও তা বেচে দিই না। ভাগ্য হয়ত অন্য শহরে আমার কবরের জায়গা করে রেখেছে। আপনি একটা কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন, যে স্থানের মাটিতে আমাদের সৃষ্টি, মৃত্যু সে মাটিতেই আমাদের টানবে।
আপনি ভালো মানুষ তাতে সন্দেহ নেই, নয়ত এতগুলো টাকা পেয়েও কেউ হাতছাড়া করে না।
যেকোনো যুক্তিতে তা নিজের কাছে রেখে দেয়। আল্লাহর দান বা খাজানার শ্রেণিতে ঢুকিয়ে দেয়।
আপনার সন্দেহও যৌক্তিক। আপনি খবর নিয়ে দেখেন, আমার একটা কথাও যদি ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, এই টাকার উপর আমি বিন্দু দাবিও করব না।
খবর তো নিশ্চয়ই নিব মশাই। তবু শেষ সুযোগ, আপনি ভাবতে থাকুন, আমিও খোঁজ নিই, মিনিট পনেরোই লাগবে। এর মাঝে আপনি আমার কাছে স্বীকার করতে পারবেন, যদি ব্যপারটা মিথ্যে বলে থাকেন।।
আগন্তুক চুপ করে বসে আছে, ঘরের টেবিলটার উপর একটা এলার্ম ঘড়িতে চাপ দিলেন মহাজন।
আগন্তুক তার পকেট থেকে কটকটে টিয়া রঙের বাটন ফোনটা বের করল। কি এক অস্থিরতা, ১৫ মিনিট বাদে আসলেই কি মহাজন টাকা দিবে, যদি না দিতে চায়। তখন সে কি করবে। আবার ভাবনার বিপরীতে যুক্তি দাঁড় করায়, ধুর ছাঁই, তার যদি টাকা না-ই দেওয়ার হতো, সে নিজেই কি মালিকের খোঁজ করত?
এত আত্মসংলাপের মাঝেও পনেরো মিনিট যায় না… কত দীর্ঘ মনে হচ্ছে সেকেন্ডের হিসেব। সূর্য হয়ত ক্লান্ত হয়ে গেছে, এই প্রথম বাড়ের মত তার অক্ষে একটুখানি জিরিয়ে নিচ্ছে। সাত মিনিট…আট মিনিট… তের মিনিট…
খট খট খট…মহাজন যেনো কোথায় গেছিলেন, এবার আসলেন। তা মশাই, মিথ্যে বলেননি তো?
আমি শতভাগ সত্যি বলছি, যেহেতূ আর্থিক ব্যপার, নয়ত আপনাকে বলতাম আরও দু’দিন খবর নেন, সেই সুযোগ ত নেই। আপনি চাইলে সময় বাড়িয়ে খবর নিতে পারেন, আমি না হয় এখানেই…
আরে! না না….. আমি আপনার ব্যাগে সেরম ধরি নাই, আপনি আপনার সম্পদ বুঝে নেন। শুধু সুন্নত টা আদায় করেন, যদিও জানি তা কষ্টকর। তবে এই কষ্টতে আপনার আপত্তি থাকার কথা নয়, এলার্ম বাজতে শুরু করলো… লম্বা লোকটা ঘড়ি বন্ধ করল।
আপনার সমস্ত টাকা এখান থেকে গুণে পরে যাবেন, এতে যতটাই সময় লাগুক। আপনি অবশ্যই গুণে আমায় নিশ্চিত করুন এর পরিমাণ ঠিক আছে। তারপর এখান থেকে যাবেন। নয়ত আমার শান্তি হবে না।
আগন্তুকের মনে স্বস্তি ফিরে এলো। একটা কাঁদামাখা ব্যাগ এলো তার সামনে। কাঁদার শুকনো দাগ তার তার মনের শুষ্কতা দূর করছে। সে ব্যাগ খুলল, ঘরের ফ্যান বন্ধ হলো, এই ছোট্ট টী টেবিলে কি টাকা ধরে?
কাঠের চারপায়া টেবিলটা এলো টী টেবিলের জায়গায়। টাকা গুলো একপাশ হলো, একটা খাতার পাতা আর কলম নিয়ে এলো চাকড়টা।
মহাজন এই ভ্যাপসা গরমেও বসে আছে রাজার মতো ভাব করে। ওদিকে চাকরটা সোফায় বসলো পা তুলে। দুজনের চারটে চোখ আগন্তুকের আঙ্গুল বরাবর, আঙুল দ্রুত জিভ ছোঁয় পরে টাকা, একটা একটা বান্ডেল ভাগ হতে থাকে টাকার স্তূপ থেকে।
আগন্তুক ক্লান্ত হয় না, তবুও জিরিয়ে নেয়। টাকা গুনতে কে কবে ক্লান্ত হয়েছে? তবু দু‘একবার তার বলত ইচ্ছে করে “গুণার প্রয়োজন কী? “কিন্তু নিজেকে সংযম করেন।
ঘন্টা পেরুলে সে পানি চায়। পানি দেওয়া হয়, ঢকঢক করে গেলে সে পানি। ঠিক যেভাবে চাকর মাঝ রাতে মদ ঢালে গলায় সেভাবেই।
আরও চার পাঁচটা বান্ডেল গুনতে গুনতে আগন্তুকের খারাপ লাগে, মনে হয় নিঃশ্বাস যেনো ভারী হয়ে উঠেছে। টাকা গুনতে যেয়ে আঙুল পিছল খাচ্ছে। আস্তে আস্তে সে দুর্বল হতে থাকে, আবারও পানি খায়। খেয়ে টাকা গুনতে শুরু করে। তার দিকে বটবৃক্ষের মত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চাকর আর মহাজন। একটু খানি গা এলাতেই, মহাজন বলে, হাঁপালে চলবে? টাকা গুনুন। এই টাকাই আপনার মুক্তি।
আগন্তুক তার অর্ধবন্ধ ঝাপসা চোখেও টাকা গুনার চেষ্টা করে। এতক্ষণে তার চোখ রক্তবর্ণের হয়ে উঠেছে। শরীর জুড়ে ঘামের সহবাস। হাতের আঙুল একটা আরেকটার সাথে জটপাকাতে চায়। নিঃশ্বাস যেনো নাক ভেদ করে বেড়িয়ে যায়।
চাকর- মহাজন আগন্তুককে ঘিরে হাসতে থাকে, হো হো শব্দে রাবণের মত হাসে। আর টাকা ছুঁড়ে দেয় আগন্তুকের মুখে, তোর সম্বল গুনে নে। শুয়ে পরলে চলবে? হারামির জাত, সুন্নত আদায় কর।
আগন্তুকের কান বেয়ে রক্ত পড়ে, তার চোখ ছিটকে বেরুতে চায়। বেরুতে পারে না। চোখের পেশী বুঝি এত শক্ত, এমন যন্ত্রনাতেও চোখ ছিঁড়তে দেয় না। তার মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ ঘটে, একে একে মনে হয় সবকটা নিউরন জ্বলে যাচ্ছে। নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। কানের পর্দা ফেটে রক্ত বের হয়।
বাইরের ঝুম বৃষ্টির শব্দ, সাথে মহাজনের ফ্রেডি ক্রুগারের মতো হাসি আর আগন্তুকের গোঙানি… তার গলায় দম আটকে গেছে, কিছুক্ষণের ব্যবধানে সেই দম, রক্ত হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। চোখের কোণের পানি আরও ঘন হয়ে গেছে, যেনো শরীরের সমস্ত লবণ সেই পানিতে মিশে গেছে। শরীর হাড়গোড় মোচড়াতে থাকে, খিচুনি দিয়ে ক্ষনে ক্ষণে এক দেড় হাত উপড়ে উঠে যায় শরীর।
চাকর- মহাজন তারই সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে হাসে।
সে হাসি দুঃস্বপ্নের মতো। যেনো আজরাইলের জ্যান্ত রূপ।
মহাজন শক্ত হয় হাসি থামে। মৃত্যু তো তুমি লিখছো মশাই, সেই ১৫ মিনিটে। কতবার বললাম লোভ করা ঠিক আছে, কিন্তু তা থেকে ফিরে আসাই মানুষের ধর্ম। কিন্তু তুমি তো ধর্ম পালন করো না। কেবল ধর্মের সুন্নত পালন করো…
বাইরে বৃষ্টির শব্দ তীব্র হয়। বাজের শব্দ হচ্ছে ঘন ঘন, তারই ফাঁকে দুই থেকে তিনটে হিঁচকি তুলে আগন্তুকের মুক্তি হয়। আসলেই লোভ মানুষকে মুক্তি দেয়। তবে তার ধরণ কারণ ভিন্ন।
মহাজন আর চাকর আগন্তুকের লাশ গুছিয়ে ফেলে ফ্রীজে, একপ্রকার নিঃশব্দেই। যেভাবে আমরা খাওয়ার পরে হাত ধুই, ঠিক সে রকম সরলতায়।
ফ্রীজ লক করে, মহাজন চাকরের দিকে তাকায় আর ডেভিল হাসি দিয়ে বলে ” পোস্টার বোধ করি বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে, নতুন একটা বানিয়ে নাও লিখে দিও- “এখানে কিছু টাকা পাওয়া গেছে…”
ফলো করুন- পরমপাঠ সাহিত্য পত্রিকা