বিলাই বান্দরের গল্প- সাঈদ কামালের গল্প
১৯৮৮ সালের পড়ন্ত বিকেল। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর থেকে দুশো কিলো দূরে রোন নদীর পাড়ে মজনুর সঙ্গে বন্ধুরা দাঁড়িয়েছিল। রোন নদীর সৌন্দর্য তাদের বিমোহিত করছিল। কোথাও সাপের মতো আকাঁবাকা, কোথাও প্রশস্থ,সবুজ জল, পাড়ে সুন্দর বৃক্ষদের মিতালী মজনুদের আনন্দের নক্ষত্রে নিয়ে যাচ্ছিল। বেগুন গাছের মতো ছোট একটি গাছে হলুদ রঙের ছোট পাখি দেখে মজনু এগিয়ে যায়। গাছটির যতো কাছে যায় দুরত্ব ততো বেড়ে যায়।বন্ধুরা ডাকে,-’মজনু কই যাস রে,কই যাস?’ মজনু দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,-’পাখি ধরতে, পাখি ধরতে।’
বন্ধুরা নদীর জলে সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে বলে,-’যাসনে আর,ওঠা অনেক দূর, সন্ধ্যাও হয়ে আসছে, ফিরতে হবে তো।’
কোন কথা না বলে মজনু দৌড়াতে থাকে। যেন সে শুনতে পায় না কিছু। মৃদু অন্ধকারের স্পর্শে সচকিত হয় এবং দেখে যে আশেপাশে কেউ নাই। সে তৎক্ষণাৎ উঁচু গলায় বন্ধুদের ডাকে -’তোরা কই গ্যালি রে, কই গ্যালি?’ নিজেের গলা ছাড়া কিছু শুনতে পারে না সে। ভয় হয় তার। একবার ডানপাশে দৌড়ায় আরেকবার বাম পাশে দৌড়ায়। তাতে কেন প্রাপ্তি হয় না। কারো দেখা বা কোন আওয়াজ শুনতে পায় না।
সুইজারল্যান্ডের আকাশে তখন চাঁদ ওঠেছে। ফকফকা আলোর মধ্যে খানিক লাল আভা। মজনু ছটফট করে, নিঃসঙ্গ, হতাশ বোধ করে। কোনদিকে পরিচিত স্থান কিংবা বন্ধুরা কোথায় আছে ভেবে ঠিক করতে পারে না। ভীষণ রকম ভীষণ্ন বোধ করে মনে মনে হায় হায় বলে দৌড়াতে থাকে। নিজেকে হারিয়ে যাওয়া ঘোড়ার মতো মনে হয়।রাতে কোথাও আশ্রয় নেওয়ার নিমিত্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে ছুটতে থাকে। কতোক্ষণ দৌড়ায় নির্ণয় করতে পারে না। একসময় বুঝতে পারে সবুজ ঘেরা লতাপাতার ঝোপের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ভালো করে লক্ষ্য করে সে। চাঁদের ঈষৎ শাদা লাল আলোয় চারপাশকে রহস্যময় লাগে। দৃষ্টি সমান উঁচু সোনালি গাছ, হিজল ফুলের মতো কোন কোন ফুল। মাটির রঙও অদ্ভুত রকম হলুদ, কোথাও চুনের মতো শাদা। মানুষের হেঁটে গেলে পথ যেমন তৈরী হয় সে ক্ষীণ আশা নিয়ে এমন পথ দিয়ে হেঁটে যায়। কতোক্ষণ হাঁটার পর সবুজ রঙের দালানের দিকে দৃষ্টি যায়। সাগরে জাহাজ ডুবে গেলে হঠাৎ দ্বীপের দেখা পেলে বিপন্ন মানুষ যেমন আনন্দবোধ করে মজনুও তেমন আনন্দ বোধ করে দ্রুত হাঁটে। সবুজ দালানটির পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎই দেখে যে এক তরুণী সবুজ রঙের শাড়ী পরে তার দিকে আসে। তরুণীর ঠোঁটে চমৎকার হাসি। বহুদিন পর হৃদয়ের মানুষ কাছে এলে আনন্দিত হয়ে মানুষ যেমন হাসে। মজনু ভয় পায়।বুকের সঙ্গে মিলিয়ে পা কাঁপে। হরিণ বাঘকে দেখে ভয়ে পালাতে যেমন চেষ্টা করে মজনুও তাই করে। কিন্তু ততক্ষণে তরুণী পাশে দাঁড়ায়। হাতের উজ্জ্বল সোনালি চুড়ি শব্দ করায়। মজনু তাকে দেখে। বাঙালি মেয়ের মতো শাড়ী,কপালে ছোট সবুজ রঙের টিপ, চুল বেণি করা। মেয়েটি মাথায় শাড়ীর আচল দিয়ে হেসে হেসে ইতালীয় ভাষায় বললো,-‘আমি জানি,তুমি আসবে।’
মজনুর আরবি ফার্সি উর্দু হিন্দী ভাষার সতো ইতালীয় ও ফরাসি ভাষায় জ্ঞান থাকায় বুঝতে সমস্যা হয়নি। বিষণ্ন গলায় ইতালীয় ভাষায় বলে,’-আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।বন্ধুরা আমাকে ফেলে চলে গেছে।’
মেয়েটি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হেসে বললো,’-এমনই তো হয়,প্রতি বছরে একজন ভুল করে বা পথ হারিয়ে এখানে আসে এবং আমাদের মধ্যে বিয়ের একটা লটারী হয়, লটারীতে নাম যার আসে তার সঙ্গে বিয়ে হয়।আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি?আমি সুন্দর না?’
মজনু খানিকক্ষণ কথা বলতে পারে না। বোবার মতো মেয়েটির দিকে তাকাতে তাকাতে তার কোন এক গল্পের কথা মনে পড়ে। মেয়েটি মজনুর হাত ধরে বলে,’-ভয় পাওয়ার তো কিছু নাই।তুমি আমাদেরই মানুষ। তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে আমার। চলো,সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।’
মজনু হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ম্লান গলায় বলে, ‘স্বপ্নের মতো লাগছে,আমি স্বপ্নে নেই তো?”
মেয়েটি কপালের টিপ ছুঁয়ে মজনুর হাতে স্পর্শ করিয়ে বলে,-’ তোমার হাতে রঙ লাগিয়ে দিলাম,এখন তো বিশ্বাস হয়েছে?
মজনু মাথা নাড়ে। যার অর্থ স্বচ্ছ হয় না। মেয়েটি আবার বলে,-’সব কিছু বিশ্বাস হবে তোমার, একটু সময় লাগবে। আসো তো।’
বোক, অসহায়, নিঃসঙ্গ মানুষের মতো মেয়েটির পাশাপাশি মজনু হাঁটতে থাকে।
দুজন সবুজ রঙের ঘরের সামনে দাঁড়ালে মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা ঘর থেকে বের হয়ে মজনুর দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে স্থির গলায় ইতালীয় ভাষায় বলে,-‘সোনালি,তর বর খুব চমৎকার।’
মেয়েটি লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে,শাড়ীর আচলে মুখ ঢাকতে চেষ্টা করে বলে,-’মা,তুমিও যে কী!’
সোনালির অবনত মুখের দিকে মজনু তাকায়। সে যে হারিয়ে গেছে,বন্ধুরা যে পাশে নেই মনে হয় না তার। এক অদ্ভুত সোনালি স্বপ্নের মতো লাগে। মেয়েটি মাথা তুলে মজনুকে দেখলে দুজনের চোখ অল্প সময়ের জন্য একত্রিত হয়। লজ্জায় মজনু কুঁচকে যায়, মাথা নত করে রাখে। আলতো স্পর্শে মজনুর হাত ধরে সোনালি বলে,-‘লজ্জাকে খুব যত্ন করে ধুয়ে দেবো। চিন্তে করো না।’ খানিক থেমে বলে,-’ইনি আমার মা,স্বর্ণিবালা, সালাম করো।’
মজনু স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
কাঁপা গলায় বলে,-’আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আমার আসার কথা ছিল না। আপনারা ভুল করছেন।’
স্বর্ণিবালা বলেন,-’আমাদের নিয়তিই এমন। বহুদিন আগে তোমাদের বাবাও এমন করে এসেছিলেন, তোমার মতো লাজুক, ভীত, হারানো গলায় কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোন সমস্যা হয়নি। বড়ো মাধুর্যতায় সময় কেটে যায়। কোন একদিন হারিয়েছিলেন এ কথা আজ আর বিশ্বাসও করেন না।’
স্বর্ণিবালা এক পা সামনে এগিয়ে বলেন,-’বাবা,অতীত নিয়ে ভেবো না। তোমার কোন অতীতই নাই। ধরো, এইমাত্র জন্মালে তুমি।’
সামনে পিছনে ও বামে সবুজ রঙের সারি সারি ঘর এবং ডান পাশে প্রবেশ করার পথ, প্রতিটি ঘরের সামনে ছোট বড় বা মাঝারি বৃক্ষ, কোন কোন গাছে হিজল ফুলের মতো ফুল কোনটায় ডিমের মতো শাদা ফল, মজনু গভীর দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে নিজেকে প্রশ্ন করে, এই মাত্র, এই দীর্ঘ বয়সে, এই সবুজ জগতে আমি জন্ম নিলাম? আমার পাশে এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে, যার নাম সোনালি, তার সাথে আমার বিয়ে হবে, জন্মের পর পরই কী এমন কোথাও হয়?হতে পারে? কাঁধের স্পর্শে মজনু সম্বিত ফিরে পায়। সোনালি হেসে বলে,-’ঘরে যাবে তো, চলো।’
সময় কিংবা কথার ব্যায় না করে মজনু ঘরে প্রবেশ করে খুব অবাক হয়। ঘর যেন নয়, ফুল বাগান। সুন্দরের নক্ষত্রের মতো চারপাশ। হাস্নাহেনা, লিলি, কাঁঠালিচাঁপা ফুলের মতো বেশ কয়েক জাতের ফুল। কয়েক রকম ফলের গাছও আছে। কোন ফল ডিমের মতো শাদা, কোনটা ডাবের মতো সবুজ আবার কোনটা গাঢ় লাল রঙের মাংসের টুকরোর মতো।
ঘাসের মতো নরম, সবুজ, বিছানা। পুরো ঘর যেন সবুজ সুগন্ধময় ফুলেল বিছানা। কোথাও উষ্ণতা কিংবা ঠান্ডা হাওয়াও নাই। যেখানে প্রবেশের সাথে সাথে দৌড়ানো কিংবা হারিয়ে যাওয়ার ক্লান্তি এক নিমিষে শেষ হয়ে যায়।মজনুরও ব্যতিক্রম হয় না। ফ্যান নাই,এসি নাই কিংবা শীতের জন্যে কোন পোশাকের ব্যবস্থা নাই। পুরো ঘরই যেন এসি বা শীতের পোশাক। স্বর্ণিবালা পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,-’বাবা,আমাদের এখান থেকে না বের হলেও হয় কিন্তু কখনো বেরুতে বাধ্য থাকতে হয়, সে তোমাকে পরে বলব।’
থেমে আবার বলেন,-’আমরা এইসব ফল খেয়ে খুব নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারি, তোমারও এভাবেই থাকতে হবে।যাই হোক, আজ রাতে তোমাদের বিয়ে, ওই যে, ও পাশের রুম ওঠা বিয়ের রুম। ওখানে বিয়ে গাছকে সাক্ষী রেখে,সে গাছের পাতা তোমাদের শরীরে স্পর্শ করিয়ে বিয়ে করানো হবে, এখানে এই নিয়ম।’
বিয়ের অদ্ভুত নিয়মে মজনুর আপত্তি না হলেও সময় নিয়ে হয়।সে বলে,-‘এক দুদিন যাক না, একটু আধুটু পরিচিত হই। আপনাদের রহস্য জানি, তারপর না হয় বিয়ে হবে। আমি তো আছি, যাচ্ছি না তো কোথাও।’
স্বর্ণিবালা এক পলক সোনালিকে দেখে মজনুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেন,-’বাবা,ওইসব তো নিয়মে নাই, এখানে আসার প্রথম রাতেই বিয়ে হওয়ার নিয়ম। বিয়ে হয়ে গেলে তুমি যা খুশি করো, আপত্তি করবো না।’
সোনালি দু পা হাঁটে, মজনুর মুখোমুখি হয়। চোখে চোখ রাখে। মধ্যমা আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলে,-’আমি তো পাশে আছি তোমার, ভয় করো না। সব ভয় আমি তোমাকে জয় করে দেবো।’
নাড়াতে থাকা মধ্যমা আঙুলে মজনু ধরে রেখে খানিক হেসে বলে, -ঠিক আছে,সোনালি, আমার আপত্তি নাই।’
২.
বিয়ে হয়ে গেল গভীর রাতে। বিয়ে গাছকে সাক্ষী করে ও পাতা স্পর্শ করার মাধ্যমে। সবাই যখন দুজনকে রেখে চলে গেল তখনি ঘটে এক ব্যতিক্রম ঘটনা। এক শ্রেণির প্রাণীরা আসে। এদের উপস্থিতিতে সোনালি অবাক হয়। কপালে তাহলে দুঃখ আছে-আফসোস করে সোনালি। মজনু জিগ্যেষ করে -’তুমি হতাশ হচ্ছো মনে হয়?’
সোনালি বলল -`হ্যাঁ, এরাই আমাদের দীর্ঘদিনের শত্রু।’
মজনু জানতে চায়-’ আমাকে বুঝিয়ে বলো।’
সোনালি বলতে শুরু করে-’এক শ্রেণির প্রাণী ছিল তারা বান্দর কিংবা বিলাই বা কুকরের মতো ছিলো, তারা মানুষের ভাষা বুঝতে পারতো এবং মানুষের মতো কথা বলতে পারতো। কিন্তু তারা একটু হিংস্র ছিলো, এই যেমন মানুষকে খামচে ধরতো, কখনো চুরি করতো কিংবা চিক্কোর চ্যাঁচামেচি করতো, কখনো চলার পথে ময়লা বা কাঁটা ফেলে রাখতো, কখনো মানুষের সম্পদ লুট করতো, হত্যা করতো। এদের অত্যাচারে মানুষেরা খুব ভয়ে থাকতো । কথা বলতো না। চুপচাপ সহ্য করে যেতো।
এতে মানুষ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতো, এই যেমন ঘুমের সময় চ্যাঁচামেচি বা কাজের সময়ে চিক্কুর শুনে তাদের কাজে বা ঘুমে ব্যাঘাত হতো অথবা রাস্তায় কাঁটা বা ময়লা সরিয়ে যেতে তাদের অনেক বিলম্ব হতো।তারপর, অল্প সংখ্যক কিংবা অধিক মানুষ মিলে বান্দর বিলাই কুকুরের কাছে যায়,তারা হয়তো তখন দুষ্টুমিতে কিংবা ঘুমে ছিলো ;মানুষের শব্দ পেয়ে তারা অবাক কিংবা ভয় না পেয়ে কি বলে শুনার জন্য এক হয়। তখন মানুষেরা বলে যে,- ‘তোমরা এমন করো কেনো,আমরা তো কোন ক্ষতি করি না তোমাদের,কেনো করো এমন? ‘তখন বান্দর লেজ নাড়াতে নাড়াতে বলে, -’আমরাও তো আপনাদের ক্ষতি করি না, আমরা মাঝে মাঝে আমোদ করি, তাই হয়তো চিক্কুর করি, অথবা ডাল ভেঙে রাস্তায় ফেলি।’ তখন কুকুর কিংবা বিলাই বলে যে,-’আপনাদের যদি সমস্যায় হয় তবে আর এমন করব না, কথা দিলাম।’
তারপর মানুষ ফিরে আসে, এবং বেশ কিছুদিন পর বুঝতে পারে বান্দর বিলাই কুকুর আবার উৎপাত শুরু করেছে,তখন তারা আবার যায়। অতএব সব প্রাণীরা একসাথে ওয়াদা করে বলে যে, ভুল হয়েছে,আর কোনদিনও এমন হবে না। কথা দিলাম,কথা দিলাম। তারপর মানুষেরা ফিরে আসে এবং দীর্ঘদিন যায় কিন্তু বান্দর বিলায়ের স্বভাব পাল্টে না। তারা আবার উৎপাত করে । মানুষেরা তখন ক্লান্তি বোধ করে, প্রাণীদের মন বলে কিছু নাই, এরা মানুষের সুখ দুঃখ কোনদিনও বুঝবে না, এইসব ভেবে মানুষেরা শান্ত থাকে।
তারপর আরও দীর্ঘদিন পর তারা দেখে যে,তাদের পথে কাঁটা,পথে গর্ত,কিংবা তারা আরোও দেখে মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করে, মারামারি করে, কাটাকাটি করে,খুন করে, রাস্তায় কিংবা ডোবায় লাশ ফেলে রাখে। তখন তারা কেউ আর ওদের কাছে গিয়ে বলে না, এমন করো না, তাতে আমাদের ক্ষতি হয়,লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না,তোমরা শান্ত হও।তারা তখন প্রাণীদের হিংসে, রক্তের খেলা, নাটকের মতো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হতে থাকে।
একটা সময়ে মানুষের হৃদয়ে থেকে ভিসুভিয়াসের মত আগ্নেয়গিরি বের হয়,তারা বান্দর বিলায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে। মিছিল করে, আন্দোলন করে।ছত্রিশ দিন মানুষ আর বান্দর বিলাইয়ে যুদ্ধ হয়। অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়,নিহত হয়। কিছু ইন্দুর বিলায় বান্দরও মারা যায়। তারপরে বান্দর বিলায়েরা হার মানে। পালিয়ে যায়।
তখন মানুষে মানুষে একটা বিশুদ্ধ দেশের জন্ম হয়। মানুষের পথে আর কেউ কাঁটা ফেলে না,চিক্কুর করে না,লুট হত্যা ছিনতাই করে না।মানুষেরা শান্তিতে কথা বলতে পারে।শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারে।মানুষেরা বলাবলি করে -ষোল বছর পর বান্দর বিলাই মুক্ত একটা দেশ পায়ছি।
কিন্তু গর্তে লুকিয়ে কিছু ইন্দুর বা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বান্দর অথবা ঘরের কোণে থাকা কিছু বিলায় মাঝেমধ্যে চিৎকার করে। পুরানো স্বভাবের মত পথে গর্ত করে, কাঁটা ফেলে রাখে, এবং বলে যে,-মানুষে কী হইছে?মানুষ এত খারাপ কেন? মানুষের এই সুন্দর স্বাধীনতায় তারা হিংসা করে, এবং বলে যে-’সুন্দর দেশটারে এরা শেষ কইরা ফালাইতাছে। আগেই তো ভালো ছিল।’
দেশটা থেকে বান্দর বিলাই চলে যাওয়ার পর কিংবা কিছু বান্দর বিলাই লুকিয়ে থাকার পরেও আরেকটা দলের আর্বিভাব হয়। তারা নিজেদের একটু উন্নত প্রজাতির মানুষ হিসেবে দাবী করে। তারা বলে যে -’এই দেশে আমাদের মত অভাবহীন মানুষ কেউ নাই। কোন কালে ছিলও না।’ অথচ লোক মুখে শোনা যায় যে, তাদের আদিপিতা ছিল ভদ্র সুবিখ্যাত জুয়ারি। জীবন ছিল দ্বিধাগ্রস্থ। টেনে টুনে কোনরকম খাবার জুটত।
দেশ থেকে ইন্দুর বিলাই চলে যাওয়ার পর তাদের ওই জাহাজি জীবনের রহস্য বের করতে চেষ্টা করে মনসুর উদ্দীন।
মনসুর উদ্দীন বলে যে -’ইন্দুর বিলাই হয়তবা জাহাজি জীবনের সন্ধান দিয়েছে। নয়তবা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদিপের সন্ধান পেয়েছে।’
কিন্তু মনসুর উদ্দীনের কথায় মানুষেরা খুব একটা আশস্থ হতে না পারলেও অবিশ্বাস করতে পারে না।’
মজনু জানতে চায়-’মনসুর উদ্দীন কে ছিলেন?’
সোনালি বলল-‘তিনি গণমানুষের নিবেদিত প্রাণ। মানুষ দরদী প্রাণ। শেষতক মানুষের জন্য নিজেকে উৎস্বর্গ করেছিলেন। সেই ইতিহাসে এখন যেতে চাচ্ছি না। আজকে আমাদের বিয়ের রাতে এই রকম ঘটনায় আশাহত হচ্ছি।’
মজনু বলল-’ভেঙে পড়ো না।সব ঠিক হয়ে যাবে। আমিও বাঙালি। আমাদের দেশেও এমন হয়। এসব নিয়ম কানুন আমিও জানি।’
সোনালি নক্ষত্রের মত হাসে। সে হাসিতে আকাশ আলোময় হয়ে ওঠে।-’এখন তাহলে কি করতে হবে?’
মজনু ধীর স্থির কণ্ঠে বলল-’খু্ব শান্ত। ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে যেতে হবে। ভয় পেলে একদম চলবে না।’
সোনালি বলল-’সবাইকে কি আমি জানিয়ে আসব?’
সোনালির মাথায় হাত রেখে মজনু বলল-’এতো অস্থির হলে চলবে না। এরা একটা বিলুপ্ত প্রজাতি। এদের সংখ্যাও খুব কম। এদের সঙ্গে একটু রাজনীতি করতে হবে।দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে । ‘
সোনালি বলল- ঠিক আছে। তুমি দেখি মনসুর উদ্দীনের মত রাজনীতিও বুঝো।’
“আমরা বাঙালি। আমাদের প্রতি ঘরে ঘরে এক ডজন করে রাজনীতিবিদের বাস।”-হাসতে হাসতে মজনু বলে।
-“তাহলে দেখা যাবে তোমার কারিশমা।”
-”ঠিক আছে, যতো ইচ্ছে হয়,দেখো।”
অনেক্ষণ পর উভয়ে বুঝতে পারে সে প্রাণীগুলো আর আশেপাশে নাই। সোনালি স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে এবং গলা ছেড়ে গান ধরে।
৩.
ভোরবেলার আকাশ এতো হতে সুন্দর হতে পারে মজনু কল্পনা করেনি। সবুজের ঘর সবুজের ছায়ার উপর এক সূর্য পৃথিবীকে যেন সাজিয়ে রেখেছে। সোনালি পাশে এসে বসে। জিগ্যেষ করে, -’কেমন লাগছে?’
মজনু বলল-’এত সুন্দর এর আগে দেখিনি। ‘
সোনালি হাসে। হাসতে হাসতে বলে-’গত রাতে কী হয়েছিল,জানো?’
সোনালির কাঁধে হাত রেখে মজনু বলে-’তুমি বলো নি তো।’
সোনালি বলল-’গত রাতে যে প্রাণীগুলো দেখেছিলাম, এগুলো আসলে মানুষ ছিল। প্রাণীদের পোশাক পড়ে মানুষেরা এসেছিল। এরা গুজব ছড়ায়।’
মজনু বলল- ‘হ্যাঁ,এসব গুজব বাহিনি আমাদের দেশেও আছে।এদের প্রতিহত করতে হলে আমাদের সবার এক হতে হবে’।
‘সে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমরা আজীবন এক হয়ে বাঁচার প্রতিজ্ঞা করেছি।’
‘তাহলে জয় আমাদের হবেই’। মজনু হেসে হেসে বলল।
সুইজারল্যান্ডে সেসব প্রাণীরা আর আসেনি।মজনুও হারিয়ে যায় এক মানুষের ভুবনে। অতীতকে সে একবার মনে করতে পারে নি।
আরও পড়ুন- ফারহিনা তোফফার রহস্যগল্প