প্রচ্ছদমুক্তগদ্য

বুকের ভেতর লুক্কায়িত ঈদ- আশরাফ চঞ্চল- মুক্তগদ্য

আমি ছোট্টকালে মামার বাড়িতে থাকতাম। আমার একটাই মামা। তিনি এলাকায় নামকরা ব্যক্তি। শিক্ষা দীক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবেও বেশ সচ্ছল। চরকাটিহারী গ্রামে তখন দশ হাজার লোকের বাস। এতবড় গ্রামে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সরকারি কলেজের প্রফেসর! আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন জেলা শহর ছাড়া কোন সরকারি কলেজ ছিলনা। তাই এলাকায় তাঁর আলাদা একটা সম্মান ও দাপট ছিল। সামাজিক কাজকর্মে তিনি অগ্রণী ভুমিকা রাখতেন। দানশীলতায় তাঁর জুড়ি ছিলনা। মোটকথা, তিনি ছিলেন গ্রামের লোকজনের মধ্যমনি।বিপদে আপদে তিনি সবার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন।

 

আমার আম্মা ছিলেন মামার সবচেয়ে আদরের ছোটবোন। শুনেছি, আম্মা শাখচূঁড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ক্লাসে পড়াকালীন সময়ে আমার আব্বার সাথে পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে প্রেম! প্রেম থেকে বিয়ে! তখন আব্বার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভাল পর্যায়ে ছিলনা। বলতে গেলে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এমন একটা লেজেগোবরে অবস্থা! মামা তো বিয়ে দিতে রাজিই ছিল না! সেই আশি দশকের মাঝামাঝি সময়ে মা আল্টিমেটাম দিয়ে বসলেন, পছন্দের মানুষের কাছে বিয়ে না দিলে তিনি আত্মহত্যা করবেন! অবস্থা বেগতিক দেখে মামা রাজি হতে বাধ্য হলেন!

আব্বা আম্মার বিয়ের এক দশকের ভিতরে আমরা এলাম পাঁচ ভাইবোন। সংসারের আর্থিক দুরাবস্থা আরও বেড়ে গেল। একবার খেলে তো আরেকবার আর কপালে ভাত জুটে না! আমাদের পরনের প্যান্ট থাকলে তো জামা থাকে না। তেলের অভাবে বোন তিনটির মাথার চুল বাতাসে আউলা ঝাউলা উড়ে!

সংসারের এমন এক ক্রান্তিলগ্নে আম্মা বুদ্ধি করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন মামার বাড়িতে।কারণ মামার তো আর টাকা পয়সার অভাব নেই! তাঁদের রান্না করা খাবারের যা আঁশটাজুটা পড়ে থাকে তা আমরা তিনবেলাও খেতে পাই না!

নতুন জায়গায় গিয়ে আমার প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও মামির আন্তরিক ব্যবহারে আমার সেই খারাপ লাগা খুব দ্রুতই কেটে গেল! মামা মামি মামাত ভাইবোন এবং বাড়ির আশেপাশের লোকজনের স্নেহ আদর ভালবাসায় সহজেই সকলের আপনজন হয়ে উঠলাম।

মামাদের অনেক বড় বাড়ি। গোষ্ঠী বাড়িতে প্রায় আটশো নয়শো লোকের বাস। বাড়ির সামনেই প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, খেলারমাঠ, ঈদগাহ, দোকানপাট। বাড়ির অধিকাংশ লোকই শিক্ষিত, সরকারি চাকরিজীবী, শহরের বাসিন্দা। কথায় বলেনা, মোড়ল বাড়ির বিড়ালও নাকি মোড়লের মর্যাদা পায়! আমার বেলাতেও তাই ঘটল! আমি বাড়ির সামনের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রফেসরের ভাগ্নে বলে শিক্ষকরা আমার প্রতি একটু বেশিই আলাদা গুরুত্ব দিল। ক্রমে আমি স্কুলের সেরা ছাত্র হয়ে উঠলাম!

তো প্রথম যখন মামার বাড়িতে ঈদ করলাম, সেই অমলিন স্মৃতি কাহিনি আজ আপনাদের মাঝে শেয়ার করছি-

আমাদের অভাবের সংসারে ঈদ যে আদতে কী জিনিস তা তো কোনদিন বুঝিইনি! কারণ আমাদের গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষই খুব অভাবী।একবার খেতে পেলে আরেকবার খেতে পায় না।নতুন কাপড়চোপড় কেনার সামর্থ্য নেই।কমদামে  শহরের বাজার থেকে পুরান কাপড়চোপড় কিনে আনে।আমার আব্বাও আমাদের জন্য পুরান জামা কাপড় কিনে এনে পরিয়েছেন,নতুন কিছু কিনে দিতে পারেননি! আমরা তো পুরান জামা কাপড় পেয়েই  আনন্দে আকাশের দিকে লাফ দিতাম!

মামার বাড়িতে প্রথম ঈদের দিন আমরা সম বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে দলবেঁধে নদীতে গেলাম গোসল করতে। অনেকের হাতেই নতুন জামা,প্যান্ট, শার্ট। আমার পুরান একটা খয়েরি রঙের শার্ট ছিল।মামি সেটা ধুয়ে রেখে ছিলেন। আমি গোসল সেরে সেই জামাটাই পড়লাম। সহপাঠী গোলাপ সাদার ভেতর ছোপ ছোপ গ্রিন রঙের নতুন একটা জামা পরে যেই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে চঞ্চল, তোর নতুন জামা নেই?!’ এই প্রথম গোলাপের মুখ থেকে এই বাক্যটা শুনে আমার চোখে মুখে লজ্জার একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল! জীবনের প্রথম অনুভব করলাম, ঈদ এলে নতুন জামা পরে ঈদগাহে যেতে হয়।

আমার ফ্যাকাসে মুখ দেখে মামি আমাকে মায়ের মত বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মন খারাপ কইরেন না, আমাদের ভুল হয়ে গেছে, কালই সবুজকে বলব আপনার জন্য নতুন একটা জামা কিনে আনতে!

মামি আমাকে নিয়ে গেলেন খাবারের টেবিলে। আহা! টেবিল ভর্তি খাবার আর খাবার সেমাই, পায়েশ, সাগুদানার ক্ষীর চাউলের রুটি, নুডলস, মুচমুচে কারুকাজময় পিঠা ভাজা, পোলাও মাংস আর কত কী! পায়েশ আর ক্ষীর খেয়েই পেট যে আমার ঢোল! এমন মুখরোচক খাবার যে আর জীবনেও খাইনি! আমাকে এভাবে খেতে দেখে মামি কেবল মুখ টিপে হাসলেন! পিটে মমতামাখা হাত বুলিয়ে বললেন, ক্ষিদে পেলেই এসে পোলাও মাংস খেয়ে যায়েন। এখানে বলে রাখি, আমাদের এলাকায় মামি সম্পর্কীয় মহিলারা ভাগ্নেদের আপনি করেই ডাকে।এটাই আমাদের সামাজিক রীতি।কিন্তু আমার মামি ছিল আমার কাছে দ্বিতীয় মা! আমার আসল মা কাছে না থাকায় মামি আমাকে মায়ের স্নেহে বড় করেছেন।তিনি মায়ের শূন্যতা আমাকে কখনোই বুঝতে দেননি। দুর্ভাগা যে আমার দুটি মা-ই পৃথিবী ছেড়ে অদৃশ্যে চলে গেছেন।

এখনও ঈদ আসে। আমার ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা কিনে আনি।কত কী রান্না হয়! ছেলেমেয়েদের আনন্দ উল্লাস দেখে খুব ভাল লাগে। শুধু আমাদের কালের ঈদের কথা মনে হলে চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। মায়ের জন্য মামির জন্য ভেতরে ভেতরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদি। যদিও সেই কান্না কেউ দেখতে পায় না!

*আশরাফ চঞ্চল: কবি ও উন্নয়নকর্মী। 

 

আরও পড়ুন- এনামূল হক পলাশের সুফি কবিতা

ফলো করুন- পরমপাঠ সাহিত্য পত্রিকা