প্রচ্ছদবই আলোচনা

বৈদেহী: এক স্বকীয় চলন- পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়

বই: বৈদেহী
কবি: রহিত ঘোষাল
প্রকাশক: বইওয়ালা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: গীতশ্রী চ্যাটার্জী
দাম:১২৫ টাকা
কবি রহিত ঘোষাল বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগতের ক্রমশ একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠছেন। তার সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘পীড়িত অববাহিকা’ এবং ‘জাদু ছত্রাক’ কবিতা মনস্ক পাঠকের কাছে এক অন্যতম আকর্ষণের স্থান অধিকার করেছে। কবির নিরীক্ষাধর্মী কাব্যসৃজন এক ভিন্ন পরিভাষা এনে দিয়েছে কবিতাগুচ্ছের মৌলিক প্রকরণে। আবহমান বাংলা কবিতার পদ-লালিত্য-ঝংকারের প্রথাগত দিকটিকে তিনি অনুসরণ করেননি। বাক্য গঠন ও শব্দ ব্যবহারের একটি স্বকীয় এবং পৃথক ব্যঞ্জনা তিনি নতুন পাঠকদের কাছে স্বাক্ষর হিসেবে নিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন আঞ্চলিক শব্দ এবং বিভিন্ন ভাষার নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দাবলী অত্যন্ত সচেতনভাবেই তিনি ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়।
আমাদের প্রাত্যহিক গেরস্থালি ভাবনার সঙ্গে অতি সহজেই মিশিয়ে দিয়েছেন জাদু বাস্তবতার আকর শিল্পকে। অপ্রচলিত বহু শব্দ তাঁর আক্ষরিক নির্মাণে নতুন বিস্তার পেয়েছে। আমাদের যাবতীয় সুখ দুঃখ ব্যথা বিপর্যয় আনন্দ বিষাদ বিহ্বলতা সমস্ত, সমস্তটাই স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায় এক ভিন্ন পরিভাষা নিয়ে। মানুষের আশ্চর্য জীবন পরিক্রমা তাঁর কাব্যিক দৃশ্যপটে বড়ই শান্ত ও অনুচ্চকিত স্বর। বেজে উঠেছে বহুবিধ অনুভবের তন্ত্রীতে। এই নিরীক্ষা আমাদের পীড়া দেয় না, অন্বেষণে একান্ত করে তোলে।
কবির নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘বৈদেহী’ পাঠকমহলে বিশেষ আলোড়নের বস্তু হয়ে উঠেছে। রহিত ঘোষাল অসংখ্য ছোট বড় পত্রিকায় লিখেছেন, তাঁর সেই লেখা মনোজ্ঞ পাঠকের দৃষ্টি ও প্রশংসা দুটিই লাভ করেছে। যার ফলে কিছু নতুন লেখার সঙ্গে সেই সমস্ত প্রকাশিত লেখা সংযুক্ত হয়ে এই কাব্যগ্রন্থের সূচনা। একটি শব্দের মধ্যে যে কী বিপুল ব্যঞ্জনা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা কবির ‘বৈদেহী’ নামকরণের মধ্যে অনেকটাই ব্যাপ্তিময়। বৈদেহী অর্থাৎ প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণের সীতা দেবী। লাঙল চালনা  করার সময় কর্ষিত ভূমিতে যাঁকে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর প্রস্থানও সেই বসুমতি মাতার অতল গর্ভে। দেখা যাচ্ছে জন্ম থেকে অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত মাটির সঙ্গে সীতার চিরকালীন যোগসূত্র। যাকে হরধনু ভঙ্গ করে বিবাহ করেছিলেন রাজপুত্র রামচন্দ্র। বনবাসের অরণ্যে সোনার হরিণ পাওয়ার অনন্ত আকাঙ্খায় যিনি উদ্বেল। সীতার প্রতীক্ষাকালীন সাধুর বেশ ধরে লঙ্কাপতি রাবণ যখন আসেন, এবং ছলনায় সীতাকে তুলে নিয়ে যান, সীতার সমস্ত স্বর্ণালঙ্কার মাটিতে ছড়াতে ছড়াতে ব্যথাতুর মন নিয়ে অশোক উদ্যানে বন্দী হন। চেড়ি পরিবৃত জনকদুহিতা উদ্ধারের আশায় যখন কাতর। সেই সময় পবনসুত হনুমান তাঁকে রামের আংটি দেখিয়ে নিজের পরিচয় দেন। সীতা আশ্বস্ত হন। পরবর্তীকালে লঙ্কাযুদ্ধে রাবণ নিহত হলে সীতা অযোধ্যায় আসেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নারীর পক্ষে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা দেওয়া মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার সমতুল্য। সীতা তা মানতে পারেন না। তিনি ধরিত্রীকে দ্বিধা করে পাতালে প্রবেশ করেন। সীতার বিহনে প্রভু শ্রীরাম স্বর্ণসীতা তৈরি করে সিংহাসনে বসান ও গভীরভাবে অনুতপ্ত হন।
যে কাহিনীটি কিছুটা স্পর্শ করে গেলাম, তা পাঠক জানেন।  কিছু স্থান পুনরায় উদ্ধৃত করে সময়কে প্রলম্বিত করলাম মাত্র। তবে একটু গভীরভাবে দেখুন, বাংলার কাব্য সম্পদ এই মাটিতে সোনা ফলিয়েছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে তা এই মাটিতেই। আমরা সোনা দিয়ে মুড়ে দেহ পিঞ্জরটিকে ধরতে পেরেছি। কিন্তু পৌঁছতে পারিনি সেই বিলীয়মান আত্মাটির কাছে। রাজমর্যাদা যার সয় না। বনবাসই যার নির্বাসিত পথ। সেই ক্লিষ্ট জীবনের মধ্যেই কোথাও ঝলক দিয়ে ওঠে সোনার হরিণ। তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের ভুলিয়ে দেয় লক্ষণরেখার গণ্ডি। সুবর্ণ অলংকার তখন আমাদের নিষ্কৃতির পথ। যা আমাদের সুখস্মৃতি, অনুভূতির অর্জিত সম্পদ। সেই দিকচিহ্ন ধরেই এক প্রবল সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার জয়। কিন্তু যে পরীক্ষার মধ্যে মানুষ নিখাদ হয়ে ওঠে, আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পায়, সেই পথ তো আমাদের আত্ম উপলব্ধির মধ্যে সঞ্জিত। সেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা-অনুশাসন মানুষের স্বাভাবিক সত্তাকে বিঘ্নিত করে। কবি রহিত ঘোষাল বাংলা কবিতার এই বিরুদ্ধ টানাপোড়েনকে তাঁর নতুন কাব্যগ্রন্থে অনেকটাই ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে কোনওরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি রাখেননি, অতি সাধারণ দৃশ্যপটে রেখেছেন এক বিন্যস্ত চলাচল। যা তার স্বকীয় সৃজনশীলতাকে আরও মর্মগ্রাহী করে তুলেছে। প্রত্যেকটি কবিতার ছত্রে ছত্রে বিভিন্নভাবে এসেছে মানুষ এবং তাদের জীবনপ্রেক্ষিত। নক্ষত্র থেকে দুর্বাঘাস, রামধনু থেকে ভাঁড়ার ঘরের অন্ধকার কুলুঙ্গি — সবকিছুর মধ্যেই এক জীবনপ্রবাহকে অন্বেষণ করার চেষ্টা করেছেন কবি। যার ফলে অন্যান্য দুটি কাব্যগ্রন্থের থেকে বৈদেহী এক স্বতন্ত্র অভিজ্ঞান অবশ্যই দাবি করতে পারেন। পূর্ব প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ধারাবাহিকতা এবং প্রভাব অনেকটাই এখানে নিস্তরঙ্গ। বরং জীবনকে বিভিন্নভাবে দেখার প্রেরণা এখানে আরও উজ্জ্বল প্রাণশক্তি হয়ে উঠেছে।