প্রচ্ছদবই আলোচনা

বই রিভিউ- মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা মেলান্দহ 

গ্রন্থের নাম: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা মেলান্দহ

গ্রন্থের ধরন: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা

লেখক: মোঃ শাহ-জামাল

প্রকাশনায়: উপজেলা প্রশাসন, মেলান্দহ, জামালপুর

প্রচ্ছদ: মোঃ সুজন রানা

প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ২০২৩

প্রচ্ছদ মূল্য: ৩০০/- টাকা

পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১০৪

 

একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ সে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। তিরিশ লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে, এক সাগর রক্তের দামে সেই স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর আগে। গণহত্যা, লুন্ঠন, নির্বিচারে জুলুম অত্যাচারের সেই সময়গুলো ছিল ভয়াবহ আতঙ্কের। সেই আতঙ্কের মধ্যেও জান বাজি রেখে এ দেশের বীর লড়াকু সংগ্রামী জনতা ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা। সেই উত্তাল সময়গুলোতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় কোণায়। এর ব্যতিক্রম ছিল না জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলাও। ঢাকা থেকে প্রায় ১৮৬ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই নিভৃত উপজেলা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপূর্বের অস্থির সময়ের এখানেও রাজনীতির  ধাক্কা লেগেছিল অন্যান্য সব জায়গার মতোই যার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে সেই সন্ধিক্ষণ সময়ের স্মৃতি। সে ইতিহাসের  সাক্ষী সেখানকার ধূলিকণাও। সেই ধূলিকণা হাতড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশত বছরের বেশি সময় পর গৌরবময় ইতিহাস সংগ্রহ করা শুধুমাত্র পরিশ্রমের বিষয়ই নয়,  নিদারুণ অধ্যবসায়, অনুরাগ এবং  ভালোবাসা- না থাকলে এ ধরনের কাজ অসম্ভবও বটে। প্রায় অসম্ভব রকম এই কাজটি অন্তরে ধারণ করে দেশপ্রেমের মহান ব্রত নিয়ে মেলান্দহের ইতিহাসে প্রথম যিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা গ্রন্থাকারে উপহার দিয়েছেন; তিনি মেলান্দহের বানিপাকুরিয়া  গ্রামের সন্তান মোঃ শাহ জামাল। তিনি একাধারে একজন লেখক, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিক। কাজ করছেন দেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এবং একাত্তর টেলিভিশনে। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি যার মধ্যে একটি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা মেলান্দহ” তার প্রকাশিত চতুর্থ গ্রন্থ। এটি মূলত তার রচিত একটি আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ যেখানে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মেলান্দহের গৌরবময় ইতিহাস সংগ্রহ করে  তুলে ধরেছেন পাঠক সমাজের কাছে। তার মতে, রক্তের বিনিময়ে  স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ বলতেই রক্তের মূল্য। বাংলা ভাষা বলতেই রক্তের মর্যাদা। গোটা দেশের ন্যায় মেলান্দহের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। সেখানকার খন্ড খন্ড যুদ্ধ ও গণহত্যার ইতিহাস সেভাবে লিপিবদ্ধ ছিল না। কিন্তু একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানা খুবই প্রয়োজন এবং বাঞ্ছনীয়।সেই তাড়না থেকেই বইটি লিখেছেন। বইটি লিখতে গিয়ে তার এক বছরের বেশি সময় লেগেছে। যার বড় কারণ তথ্যের দুষ্প্রাপ্যতা। সুনির্দিষ্ট কোন লিখিত ইতিহাস না থাকায় তাকে ছুটতে হয়েছে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অথবা যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবার পরিজন এবং আত্মীয়দের কাছে। এ ছাড়াও উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচিত ঘটনা, লিফলেট,  বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বিভিন্ন ক্রোড়পত্র বা নিবন্ধ রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সম্পূর্ণ বইটি সাজিয়েছেন ছোট ছোট শিরোনামে। শিরোনাম ধরে আলোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু। অর্থাৎ সম্পূর্ণ বইটি জুড়ে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যা পাঠককে পৌঁছে দেবে সেই উত্তাল দিনগুলোতে। লেখক শাহ জামাল আরও লিপিবদ্ধ করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ যেমন–

 

“পাক সেনাদের আগত ৩টি গাড়ির বহরে একযোগে হামলা চালাই। গাড়িতেই কিছু সৈন্য মারা যায়।  ছত্রভঙ্গ হওয়া সৈন্যদের ফায়ার করি। আমি গেরিলা গতিতে ক্রলিং করে রাস্তার একপাশ থেকে আরেক পাশে গিয়ে এম্বোস নিই।”  (পৃষ্ঠা-৪৭)

 

“উথানুপাড়া যুদ্ধ” শিরোনামে বীর প্রতিক সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলালের স্মতিচারণ কথপোকথনসহ উল্লেখ করেছেন।

” তাহের সাব আমাদের পরিচয়ের এক পর্যায়ে হেলালের পরিচয় জেনে জিজ্ঞেস করলেন-

-তুমি আজ কোথায় গিয়েছিল?

-উথানুপাড়ায় অপারেশনে।

-কি করেছো?

– রাইফেলসহ দুই রাজাকার ধরে নিয়ে এনেছি। ”

(পৃষ্ঠা-৩১)

এর পাশাপাশি মেলান্দহের খন্ড খন্ড গেরিলা যুদ্ধের কাহিনি, অপারেশন,  এ্যামবুশ এবং পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের বিস্তারিত বিবরণ তুলে এনেছেন।  পাতায় পাতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি ও উল্লেখযোগ্য ঘটনার স্থানসমূহের ছবি এঁটে দেয়ার প্রয়াসও ছিল চোখে পড়ার মতো। লেখক শাহ-জামাল অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার বিভিন্ন দূর্লভ দলিল দস্তাবেজ যেমন পত্রিকার কাটিং,  মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীকে প্রদত্ত শোকজপত্র, বধ্যভূমির স্থিরচিত্র যোগ করে বইটির সমৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। শেষের দিকে চার পাতা জুড়ে পাঁচটি দেশাত্মবোধক কবিতা এতে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা ও বৈচিত্র্যময়তা।

রুশিয়া জামান রত্না

গাঢ় সবুজ মলাটে লাল রক্তের ছোপ। মাঝে হলুদ বৃত্তে স্বাধীন দেশের পতাকা ও কলমের সংমিশ্রণে দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ। রক্তের ফোটায় ঝড়িয়ে আছে ৭১ এ যুদ্ধ শিশুর প্রতিকী। যা মহান মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বহন করে।

বইটি সহজ সরল সাবলীল প্রাঞ্জল ভাষা সকল বয়সী পাঠককে দেবে সুখপাঠ্যের অনুভূতি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়বিদারক ঘটনা কাঁদাবে পাঠকদের। অপেক্ষায় থাকা পরিজনের আর্তনাদ,  নিখোঁজ হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চেয়ে দিনের পর দিন পার করাসহ বহু করুন কাহিনির অবতারণা পাঠক সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা এই শব্দ দুটির প্রতি আলাদা মমত্ববোধ জাগ্রত করাবে নিঃসন্দেহে।

গবেষক শাহ জামালের এই গ্রন্থটি শুধুমাত্র মেলান্দহ উপজেলার গৌরবের প্রতীকীই নয় বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া এক নিখাদ ইতিহাস।  এর মাধ্যমেই লেখক নজির রেখেছেন দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত যা পথ দেখাবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে।

রিভিউ লেখক- রুশিয়া জামান রত্না- সমাজসেবা অফিসার।