কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

সিরাজ নরসুন্দর ও অন্যান্য গল্প- মুহম্মদ আল-আমীন

.

 

‘দেখ রাশেদা,কানের গোড়ত আসি ফ্যাদলা পাড়িস না তো! ভাগ এটে থাকি।’

বিরক্তির স্বরে কথাগুলো বউকে বলছে সিরাজ নরসুন্দর।

 

এই বিরক্তি দুই একদিন নয়, আল্লাহর ত্রিশটা দিনই চলে। সেই কবেকার কথা, দিন-ক্ষণটা ঠিকঠাক মনে আসে না; তবে দেশ স্বাধীনের বছর চারেক পরে, সেই সময় রাশেদাকে বিয়ে করে ঘরে আনে সিরাজ। কোথায় যেন শুনেছিল, জাতের মেয়ে কালো ভালো। তাই, খুব একটা বাছ-বিচার না করে ওস্তাদের আইবুড়ো শ্যামলা মেয়েকে বিয়ে করে সিরাজ। কন্যা দায়গ্রস্থ একজন বাবা হাফ ছেড়ে বাঁচেন।

পুরোপুরি বাঁচেন না তিনি; কারণ আরো দুই মেয়ের বিয়ে দেয়ার চিন্তা আছে ওনার। একটা ছেলের আশায় তিন বছরে তিনটা মেয়ের জন্ম দিয়েছেন সিরাজের শাশুড়ি।

 

সিরাজ যে বিয়ের সময় বাছ-বিচার করে নি, তা ঠিক নয়; আসলে সুযোগ পায় নি। কারণ, ওস্তাদের কাছে কাজ শিখতে যাওয়ার সময় থেকেই রাশেদাকে পছন্দ তার। সুঠামদেহী একুশ বছরের তাগড়া যুবক সিরাজের মনের আবেদন, চোখের চাওয়াকে রাশেদাও ফেরাতে চায় নি।

 

রাশেদা ফেরাতে না চাইলেও এখন সিরাজ রোজ রোজ রাশেদাকে ফেরাতে চায়, চলে যেতে বলে বাপের ভিটায়। অসহ্য লাগে আজকাল।

 

জীবনচক্রের প্রয়োজনে বিয়ের পর সংসার গড়িয়েছে। ভালোবাসা ঠিকই ছিল। সংসার চলতো নিম্ন মধ্যবিত্তের বেশে, একজন নরসুন্দরের জীবন যেভাবে যায় আর কি! হয়তো এক গ্রাম পরে মাসে ছয় মাসে একটা আকিকা হয়, সেখানে বাচ্চার মাথা ন্যাড়ানোর জন্য ডাক পড়ে তার। এতে কোনো বিপত্তি নেই। কিন্তু, কষ্ট লাগে তখন যখন সেই বাচ্চার মাথা ন্যাড়ানোর পরে গোটা গোষ্ঠীর আবাল, বৃদ্ধের কারো মাথা ন্যাড়াতে হয়, গোফ-দাড়ি কামাতে হয়! সেখান থেকে যা পায় আর দশ গ্রাম ঘুরে যে দুই-একটা মাথা ন্যাড়ানো, চুল ছাটানো, গোফ-দাড়ি কামানো তাতেই চলে সংসারযান।

 

জীবনচক্রকে পূর্ণতা দিতে সৃষ্টিকর্তা তাদের বিয়ের প্রথম তিন বছরে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে সন্তান উপহার দেন। এটা আনন্দের সংবাদ হলেও প্রতিবারই সিরাজের মনে হয়েছে- ‘এটা কি হইলো! এত তাড়াতাড়ি। নিজেরাই  তো খায়া-না খায়া চলি! ‘

অবশ্য ছেলের জন্মের সময় খুশি ছিল সিরাজ, বংশের বাতি হয়ে থাকবে ছেলে- এটা ভেবে।

 

সময়ের সাথে সিরাজ নরসুন্দরদের পেশায় আকাল পড়েছে। এখনকার জামানায় সেলুন আছে, আছে স্মার্ট নরসুন্দর; হালে যারা নাপিত বলে পরিচিত। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সিরাজের মতন বুড়ো নরসুন্দরদের চলা কঠিন।

 

কঠিন বললেই তো আর চলে না, দায়িত্ব থেকে মুখ ফেরানো যায় না। মেয়েটা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে মাত্র। এতেই যেন তথাকথিত সমাজ মতে, মেয়ের বিয়ের উপযুক্ত বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু, বখাটেদের আনাগোনাও বেড়েছে বাড়ির আশপাশে।

বয়স বেড়েছে সিরাজের, আগের মতন গ্রামে গ্রামে যাওয়াটা কষ্টের। হাতে সঞ্চয়ও তেমন নেই। কিভাবে বিয়ে দেবে মেয়েটার, ভেবে পায় না। আর বংশের বাতি হয়ে ওঠার কথা ছিল যে ছেলেটার, হ্যাঁ, সিরাজের বড় সন্তান জাবেদ; সে এখন ঠিকই বাতি হয়েছে৷ বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করেছে আস্ত এক বড়লোকের মেয়েকে। টরেন্টোতে থাকে। বাতি হয়ে আলো দিচ্ছে অন্য ঘরে! সেই আলোর খানিকটা ভাগ সিরাজেরও তো প্রাপ্য। ছোট বোনের বিয়ের সময় কি তার বড় ভাইয়ের উপস্থিত থাকাটা উচিত ছিল না?

 

অথচ এই সন্তানের জন্য কি করে নি সিরাজ? চেয়ে-চিন্তে, খেয়ে-না খেয়ে জাবেদকে দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছে সে। কানাডায় স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার সময় মানুষের হাতে পায়ে ধরে টাকা তুলে জাবেদকে দেয় সিরাজ। পতিত জমির সিংহভাগ বেচে পড়াশোনার খরচ পাঠিয়েছে।

চাকরি পাওয়ার আগে মাসে ছয়মাসে এনায়েত মাতবরের মোবাইলে ফোন করে খোঁজ নিত, এখন আর কোনো খোঁজ নেয় না। হায় রে সন্তান! বাপের জন্য না হোক, মায়ের জন্য কিংবা বোনের জন্যও কি তার মন পোড়ে না? এই সন্তানের জন্য কেঁদে বুক ভাসায় রাশেদা!

 

রাশেদা কেঁদে বুক ভাসিয়ে হালকা হলেও সিরাজ তো পারে না। আইবুড়ো মেয়েকে কিভাবে কার হাতে তুলে দেবে, সেটা ভেবে ভেবে ভাবনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে সে।

 

সপ্তাহ গড়িয়ে সপ্তাহ আসে। কিন্তু, কোনো উপযুক্ত সমন্ধের সন্ধান মেলে না। ছেলে ভালো হলে দেখা যায় ছেলের বাপের স্বভাব মন্দ। ছেলের বাপ ভালো তো মায়ের স্বভাব খুবটা সুবিধার হয়- এমনই শ’খানেক সমীকরণের মুখোমুখি রাশেদা-সিরাজ দম্পতি।

 

মাস খানেক এই চেষ্টা-চরিত্তির চলে। অবশেষে একটা একটা ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়। উপশহরে একটা সেলুনে কাজ করে। মা-বাপ মরা ছেলে, চাচার কাছে মানুষ। চাচার ভিটেবাড়িতে একটা জীর্ণ কুঁড়েঘরে থাকে ছেলে। গরীবের ঘরে গরীবের পা! সিরাজের আদুরে মেয়েটা তবুও যদি একটু সুখে থাকে।

 

বিধি বাম!  বাস্তবে হলো উল্টো। মেয়ের কপাল জুড়ে দুঃখের ছায়ারেখা। উপশহরে নিজের একটা দোকান দেবে জামাই, তার জন্য লাখ পাঁচেক টাকা দরকার। সেই টাকা পুরোটাই সিরাজের কাছে দাবি করে জামাই, না দিতে পারলে মেয়েকে তালাকের মঞ্চে তুলবে।

রাশেদার হাতের বালা দুইটা আর বসতভিটার অর্ধেকের মতন জমি বেচে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছে। বাকিটুকু বেচলে মাথা গুঁজবার ঠিকানাও তো হারাবে। মহাজনের কাছে ধার চাইতে গেলে চড়া সুদের অংক কষতে হবে। সে টাকা শোধ করার সামর্থ্য নেই সিরাজের।

 

রাশেদাও বসে নেই। মেয়ের সংসার বাঁচাতে সে-ও ছুটছে, এর-ওর দুয়ারে দুয়ারে। দুই জনের মাধ্যমে দুইটা এনজিও থেকে বাধ্য হয়ে তুলনামূলক কম সুদে পুরো টাকাই জোগাড় করে রাশেদা।

 

সে যাত্রায় মেয়ের সংসারে সুখ আসলেও নিজেদের সংসারে অশান্তি নামে; চিন্তার রেখা দেখা দেয় সিরাজ, রাশেদার সংসারযানে। লোন নেয়ার পরের সপ্তাহ থেকে দুই এনজিওর দুই কর্মকর্তা ভোরবেলায় হাজির হয় কিস্তির টাকার জন্য।

এক কর্মকর্তাকে কিস্তি দিয়ে বিদায় করলেও আরেকজনের কাছে কয়েক দিন সময় চেয়ে নেয় তারা।

 

কার্তিকের কুয়াশামাখা জোছনা রাত।

বাড়ির উঠানের কোণে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বন আসরার গাছটাকে আলিঙ্গন করছে কুয়াশা কিংবা জোছনা।

ঝিরঝিরে কুয়াশা পড়ছে। সিরাজ ও রাশেদার ছোট্ট কুঁড়েঘরে সেই জোছনা উঁকি দেয়। মনোরম পরিবেশ। কিন্তু, সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ নেই এই বয়সে। হায় সময়! ভালোবাসা, ভালো লাগার মুহূর্তগুলো অভাবের দায়ে যেন হারিয়ে গেছে।

 

সপ্তাহ গড়াতে দুই দিন বাকি। ভোরবেলাতেই সেই এনজিওর কর্মকর্তা তার বকেয়া কিস্তির টাকা নিতে হাজির। টাকা ভর্তি একটা ভারী বান্ডিল কর্মকর্তার হাতে দিতে দিতে সিরাজ বলে- স্যার, এই নেও বাহে তোমার সোগ কিস্তির টাকা; একেবারে সুদ সুন্দায় আছে।

কর্মকর্তা বেশ অবাক হয়। কিভাবে সম্ভব? এত টাকা, এত দ্রুত পরিশোধ! টাকা গণনা শেষে কর্মকর্তা বলে- হুম, টাকা ঠিক আছে চাচা। আসি তাহলে, পরের গ্রামের জমির ভাইয়ের বকেয়া কিস্তি তুলতে হবে। তা না হলে আমার এ মাসের বেতনও অফিস আটকে দেবে।

 

আরেক এনজিও কর্মকর্তাকেও ডেকে পাঠিয়ে ছিল সিরাজ। যথাসময়ে চলে এসেছে সে। তার হাতেও মস্ত একটি টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিল।

টাকা গণনার আগে কর্মকর্তা বলল- তো চাচী, এতদিনে আপনাদের ছেলে তাহলে আপনাদের খোঁজ নিল! ভালোই, বাবা-মার ঋণ সন্তানেরা পরিশোধ না করে পারে! তা না হলে আপনারা তো কোনোদিনও মনে হয় লোনের টাকা শোধ করতে পারতেন না।

 

জ্বি, স্যার তোমরা ঠিকই কইছেন বাহে । নিজের ব্যাটা বুলি কথা!

 

সিরাজ ও রাশেদা একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে যেন অসহায়ত্বের মানচিত্র আঁকছে। চোখ ভিজে আসছে তাদের। বারবার বসতভিটের দিকে তাকাচ্ছে।  রাশেদার প্রিয় বন আসরা ফুলের গাছটা যেন বৃষ্টি চোখে তাকিয়ে দেখছে।

 

লোনের টাকা বুঝে নিয়ে চলে গেল কর্মকর্তা।

 

শেষবারের মতন বসতভিটে চার চোখে দেখে নেয় রাশেদা ও সিরাজ। দীর্ঘদিনের বাসস্থান ছাড়তে বুক ফেটে যাচ্ছে তাদের। মেয়েটার জন্য বাবার বাড়ি বলে কোনো চিহ্ন রইল না। কিন্তু, মায়া বাড়িয়েই বা কি লাভ! এই জমির মালিকানা তো এখন এনায়েত মাতবরের। এ ছাড়া কি বা করার ছিল সিরাজের!

 

২.

বসতি ভিটে হারানো সিরাজ নরসুন্দর ও রাশেদা দম্পতির একমাত্র ছেলে বাপের ভিটেতে ফিরে এসেছে অর্ধযুগ বাদে। এনায়েত মাতবরের ছেলের কাছে বাপ-মায়ের এই করুণ গল্প শুনতে শুনতে ফুপিয়ে কাঁদছে জাবেদ, সাথে আছে জাবেদের ছয় বছরের ছেলে আবেদ। তার চোখও টলমল করছে।

 

আর রাশেদা-সিরাজ হয়তো এখন চেয়ে-চিন্তে, ভিক্ষা করে দিনাতিপাত করছে দূরের কোনো শহরে। কারণ, সিরাজের কাজ করার সেই শক্তি আজকাল নেই। নয়তো কোনো বস্তির জীর্ণ কুঠিরে শুয়ে রাশেদার প্রতি বিরক্ত হয়ে সিরাজ নরসুন্দর বলছে-

 

‘দেখ রাশেদা,কানের গোড়ত আসি ফ্যাদলা পাড়িস না তো! ভাগ এটে থাকি।’

 

আরও পড়ুন: পলাশ মজুমদারের গল্প