সফেদ আলীর অলৌকিক মৃত্যু- মুহাম্মদ ফজলুল হক
বিশাল বটবৃক্ষের নীচে তিনটি কবর। তৃতীয় কবরটি ফাঁকা। সারাদিন বটবৃক্ষের ঝরে পড়া পাতা, ফল, পাখির বিষ্ঠাসহ অন্যান্য আবর্জনা পরিষ্কার করে সফেদ আলী। তাকে অন্য কোন কাজ করতে কেউ দেখিনি। কবর কেন্দ্র করে যা সাহায্য আসে তা দিয়েই চলে তার। আশপাশের বাড়িঘর থেকেও মাঝে মাঝে খাবার আসে। কেউ আবার দাওয়াতও করে। প্রচলিত আছে, ফাঁকা করবই সফেদ আলীর শয্যা। দিন শেষে ফাঁকা
করবে শয়ন করে সে। সফেদ আলী কাউকে বিরক্ত করে না তার বিষয় নিয়েও কেউ মাথা ঘামায় না। কৌতুহলী লোকজন বৃক্ষের নীচে এসে বসে। সফেদ আলীর সাথে খোশগল্প করে।
সফেদ আলী সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় নি। মাঝ বয়েসী সুমাম দেহের লোকটি দীর্ঘদিন যাবত এখানে বসবাস করছে। কবরের যত্ন নেয়। করবের পাশে ঘুমায়। আগে দুইটি করব ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে তৃতীয় করবটি মানুষের নজরে আসে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে অনেকেই দেখেছে। খালি। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। প্রথম দিকে উদোম ছিল। এখন লাল কাপড়ে ঢাকা। দিনের বেলা সফেদ আলীকে করবে প্রবেশ করতে কেউ দেখেনি। দেখেনি রাতেও। তবু এই কথা সবাই বিশ্বাস করে দিনশেষে সফেদ আলী কবরেই রাত্রীযাপন করে।
সফেদ আলীর কবরে রাত্রীযাপনের কথা আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। দুর গ্রাম থেকে নারী-পুরুষ ও শিশু তাকে দেখতে আসে। খালি হাতে কেউ আসে না। কিছু না কিছু দিয়ে যায়। প্রাপ্তির কোন লোভ নেই সফেদ আলীর। ভক্তদের নিকট থেকে পাওয়া উপকরণ দিয়ে আগত লোকজনের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে। দিন দিন তাঁর অলৌকিতার কথা চাওর হয়। ভক্তের মনে বিশ্বাস জম্মে সফেদ আলী সিদ্ধ পুরুষ। মানুষের কল্যাণে তাঁর জীবন উৎসর্গকৃত। তাঁর আশীর্বাদ চায়। তাঁর দোয়া নিলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কেউ সুস্থ হতে আসে। কেউ আসে পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তির আশায়।
মানুষের আগমন দিন দিন বৃদ্ধি পায়। সফেদ আলীর কোন ভাবান্তর নেই। নৈমিত্তিক কাজ বাড়লেও সামলে নেয়। ঝামেলা করছে নতুন কিছু ভক্ত। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সফেদ আলীর সব কাজ এখন তারা করে। কবর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ সে নিজেই করে। এ কাজে কারো সহায়তা নেয় না। ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষার কথা বলে কবর কেন্দ্র করে টিনের চালা নির্মাণ করে। চারপাশ ঘিরে আবরণ তৈরিতে বারণ করে সফেদ আলী। উম্মুক্ত থাকায় সর্বদিক থেকে কবর দেখতে কারো কষ্ট হয় না। সফেদ আলীর সাফল্যে সবাই খুশি ছিল না। গ্রামের মানুষ চেয়েছিল এখানে মাজার বানিয়ে ব্যবসা করতে। সফেদ আলীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। পাকা ঘর তৈরি করে দরগাহ করা হবে। । মৃদু হাসে সফেদ আলী। আমি বেঁচে থাকতে কোনো দেয়াল উঠবে না।
মানুষের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে ব্যস্ত সবাই। সচেতন হয় সফেদ আলী। সবার কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ তাঁর কাজ নয়। মানুষের মনের আভা উপলব্ধি করে সহায়তা করে সে। দীর্ঘকাল আরাধনা করে মানব মনের বিকাশ বুঝতে সক্ষম সফেদ আলী। মানুষ আত্মার পর্যবেক্ষণে সে খেয়াল করেছে মানব মন আলো বিচ্ছুরিত করে। সে আলোর আভায় চেতনা ভেসে উঠে। ভালোমন্দের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। চেতনার পরিবর্তন করা অসাধ্য সফেদ আলীর। আভায় আলো দেখে তাকে সহায়তা করতে চেষ্টা করে। সফেদ আলী খেয়াল করেছে অপেক্ষাকৃত অভাবী মানুষের মন ভালো আভা বিচ্ছুরণ করে।
তাদের ক্ষেত্রে তাঁর প্রার্থনাও অনেকটা সফল হয়। দিনে দিনে মানুষের আগমন আরো বৃদ্ধি পায়। সফেদ আলীর স্পর্শে বহুমাত্রিকভাবে উপকৃত হয় মানুষ। দশ গ্রামের মানুষ ভক্ত হয়। তাঁর আভায় গ্রামের পর গ্রাম আলোকিত হয়। শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মনে সহানুভূতি ও মানবাধিকারোধ জেগে উঠে। সফেদ আলীর বয়স বাড়ে। কর্মক্ষমতা কমে আসে। আগের মত নড়াচড়া করেনা। ফাঁকা কববের পাশে বসেই মানুষের সেবা করে ভক্তকূল সারাক্ষণ ঘিরে রাখে সফেদ আলীকে। তাঁর ইশারায় কাজ করে নীরবে। সাঈদ আলী, রহম আলী ও করিম মুন্সী ইশারা ভালো উপলব্ধি করে। সাঈদ আলী পরিপক্ব। অন্তরের আভা অন্যদের তুলনায় পরিষ্কার। সফেদ আলীর সুধিধা হয় সে উপস্থিত থাকলে। তাঁর সব ভক্ত ভালো। মানবসেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে। এ অনুভূতি সুখ দেয় সফেদ আলীকে।
সফেদ আলী উপলব্ধি করে তাঁর কর্মকাল ফুরিয়ে আসছে। সে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সাঈদ আলীকে ডেকে বলে, “একদিন হয়তো আমার ঘুম ভাঙবে না। তখন ডাকবে না। সে অবস্থায় জানাজা সম্পন্ন করবে”। সাঈদ আলী চমকে উঠলেও নিরব থাকে। সব স্বাভাবিক নিয়মে চলে। মানুষের ভিড় লেগেই আছে। সাতসকালে লোকজন উপস্থিত হয়। সারদিন তারাই কাজকর্ম করে। সকাল, দুপুর ও সন্ধার খাবার শেষে সফেদ আলীর নামে ধন্য ধন্য করে বাড়ি ফিরে। সফেদ আলী শান্তিতে ঘুমায়।
ফজর নামাজ পড়ে সফেদ আলীর সাথে দেখা করতে রওয়ানা হয় লাল মিয়া। তিতাস নদী পারাপার ঘাটে সফেদ আলীকে দেখে অবাক হয় সে। লাল মিয়া কিছু বলার আগেই সফেদ আলী বলে মফিজকে দেখতে যাই। ইশারায় কি যেন বলে সফেদ আলী। লাল মিয়া সফেদ আলীর আস্তানার উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করে। একই সময়ে মফিজ চৌধুরীর সাথে রামচন্দ্রপুর বাজারে এবং রুছমত আলীর সাথে সফেদ আলীর কথা হয় ডুমুরিয়া খেয়াঘাটে। এমনি ভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সফেদ আলীর উদেশ্যে আসা বেশ কয়েক জন লোকের সাথে বিভিন্ন জায়গায় সফেদ আলী মুখোমুখি হয়। তাঁর সাথে দেখা হয়েছে একথা কাউকে বলতে বারণ করে সফেদ আলী বলে আস্তানায় যাও, আসছি আমি।
সফেদ আলীর আস্তানায় এসে অবাক হয় লাল মিয়া, মফিজ চৌধুরী ও রুছমত আলীসহ লোকজন। কিভাবে সম্ভব এমন অলৌকিতা! একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সফেদ আলী কিভাবে উপস্থিত হলেন? তাদের দেখা দিলেন? তারা জেনেছে তাদের সাথে সাক্ষাতের আগেই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর আত্মাহীন দেহ কবরে শায়িত। তারা সিদ্ধান্ত নেয় একথা কাউকে বলা যাবে না। ইতোমধ্যে প্রচার হয় সফেদ আলী দেহত্যাগ করেছেন। কিছুক্ষণ পরে জানাজা।
সুবেহ-সাদিকের সময় সাঈদ আলী লক্ষ্য করে সাদা কাপড়ে মোড়া সফেদ আলী ঘুমিয়ে আছে। অনাবিল শান্তির আভা মুখমন্ডলে। সে আলতো করে কাপড়ের বাড়তি অংশ টেনে মুখ ঢেকে পাঠ করে ” আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব”।
বহুকাল পর বটবৃক্ষের ছায়ায় একদল শিশুকে ধুলো উড়িয়ে খেলতে দেখা যায়। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে বাতাসে বটের পাতায় পুরনো গানের সুর উঠে। পাতা ঝরা পানিতে কাঁদামাক্ত মাটিতে ছুটে চলে শিশুর দল। পা পিছলে পরে একজন। দৃষ্টি তার কবরের দিকে। সে জানে এখানে সফেদ আলীর কবর। সফেদ আলীর গল্প শুনেছে কিন্তু দেখেনি। তার মনে হয় তিনি আবার আসবেন। সফেদ আলীর আত্মা মুক্ত হয়। তাঁর চেয়ে ভালো মানুষ পৃথিবীতে আসার সময় এসেছে।
আরো পড়ুন- সাঈদ কামালের বিলাই বান্দরের গল্প