সব হারানোর ব্যথা- রাসেল আহমেদ- গল্প
সন্ধার আকাশটা একদম শূণ্য। কোথাও কোনো মেঘ নেই। সূর্যটা ঢুবেছে অনেকটা সময় হলো। পশ্চিম আকাশে সন্ধার আবিরটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সন্ধা তারাটাও কোথায় যেনো মুখ লুকিয়ে বসে আছে। এর মাছে এক ঝাক পাখির নীড়ে ফেরার দৃশ্য আমার চোখে আটকে গেলো। যেনো হাতে আঁকা শিল্পির কোনো ছবি। দিগন্ত রেখায় আমি আরও কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম। আর কিছু পাখি উড়ে যাক- এই আশায়।
বহুদিন বাদে বাড়িতে ফিরেছি। সত্যি শহরের পরিবেশ থেকে গ্রামের আবহাওয়া অসাধারণ। অবাক করে সব কিছুই কাছে কাটে। আমি প্রথমে হাটতে হাটতে পুকুরের পারে আসলাম। অবশ্য জায়গাটা এতোটাও সুন্দর না যে, মন এখানে টানবে। বহু পুরনো বাশ ঝাড়, বড় বড় হাওড়া গাছ। বলতে গেল সম্পূর্ণ ভূতুরে একটা পরিবেশ। এই জায়গা নিয়েগ্রামের লোকের মুখে অনেক কল্পকাহিনীও আছে। এছাড়া পুকুরের অন্য পাশে একটা কবরস্থান আছে। এজন্য মানুষ এখানে খুব বেশি আসেও না। আমি আমার মতোই চলতে লাগলাম। যদিও মনের ভীতরে ভয় কাজ করতে লাগলো। মনে হলো, কেউ আমাকে ছায়ার মতো অনুসরন করছে। মনে পড়ছে স্মরণ কালের একটি ঘটনা। সেদিন পূর্ণিমা ছিলো কি অমানিশার ঘোর অন্ধকার, তা খুব বেশি খেয়াল নেই। সময়টা রাত আনুমানিক দশটার একটু বেশি। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। তেমাথার ল্যাম্পুষ্টের আলোটা একটা বৃতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আধারের ঘণত্ব এতোটুকু যে দু’চার হাত পরের আর কিছুই দেখা যায় না। ক্ষণে ক্ষণে মৃদু বাতাস চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক ছুটে চলছে। সেই অবস্থার ভীতরেই রুবি নামের একটা মেয়ে এ পথে বাড়ি ফিরছিলো। মাথার উপরে কোনো ছাতা ছিলো না। টর্সের আলোতে যাও কিছু দেখা যাচ্ছেছিলো-তাও আস্পষ্ট। রুবি কবরস্থানের কাছে আসতেই আচমকা বাতাস বইতে লাগলো। ভয়ঙ্কর একটা আওয়াজ বাশ ঝাড় থেকে আসতে লাগলো। রুমি যে খুব সাহসী, এমনটাও নয়। অল্পতেই যে ভয় পায়। এমন আওয়াজের মাঝেও রুমি না দৌড়ে কেনো যেনো সেদিন থমকে দাড়িয়েছিলো। চঞ্চল বাতাসটাই কেমন যেনো উন্মাদ হয়ে উঠলো। তখন সহসাই রুবির চোখে পড়লো, বাশ ঝাড় থেকে একটা বিড়াল দৌড়ে এসে রুমির সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। যেনো মুহুর্তে গায়েব। রুমি একটু এগুতে চাইলে, পাশের কবর থেকে সদ্যভূমিষ্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজের ন্যায় আওয়াজ আসতে লাগলো। এরপর রুমি আর কিছুই বলতে পারেনি। সেদিন যে কি করে বাড়ি ফিরেছিলো। তা সে কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারেনি। অতপর একটানা কিছু দিনের জ্বরে মেয়েটা মারা যায়। আর এ ঘটনার পর গ্রামের মানুষ এ জায়গাটা নিয়ে আরও অনেক কথা বানিয়ে নিয়েছে। আমি সেই কবরস্থানের দিকেই যাচ্ছি। কয়েক বছর হলো দাদা মারা গেছেন। স্মরণ সীমানায় এটাই আমার জীবনের সবচে’ দুঃখজনক ঘটনা। দাদার স্মৃতিগুলো আমাকে প্রায় কাঁদায়। তিনি যে আমার ভালো একজন বন্ধু ছিলেন। তাই শত ভূতুরে পরিবেশেও আমি এখানে আসি। কবরটা জিয়ারত করি। কিন্তু আজ তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। আধার হয়ে এসেছে চারপাশ। চোখের সামনের সব কিছুই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তাও আমি দাদার কবরের পাশে দিয়ে দাড়ালাম। কবরস্থানে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্য পাশে একটা মিটমিট করে আলো জ্বলছে। আমি এই অন্ধকারেই মুনাজাতের জন্য হাত তুলে ধরলাম। আল্লাহ যেনো এই বুড়োকে মাফ করে দেন। I
মুনাজাত শেষ হতেই কবরস্থানের বাকি লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। এই আবছা আলোতেই আমার চোখে পড়লো কেউ একজন হাওড়া গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ভয়ে আমার পা শক্ত হয়ে উঠলো। তবে ছুটে পালানোর আগেই কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞস করলো। কবে আসলি?
কণ্ঠস্বরটা আমার চেনা। মনের ভীতরে একটা কৌতূহল জাগতে লাগলো। বুকে একটু সাহস সঞ্চার। করে একটু এগিয়ে গেলাম। কোনো ভূত প্রেত নয়, আস্ত এক পুরুষ মূর্তি, জ্যান্ত এক অবয়বে কেউ দাড়িয়ে
আছে। আমি আর একটু আগাতেই যে আবার আমাকে প্রশ্ন করলো। কেমন আছিস? এ সময়ে এখানে কেনো?
এবার বুঝতে পারলাম কে ওখানে এমন করে দাড়িয়ে আছে। এই টিমটিমে আলোতে আর একটু এগুতেই চোখে পড়লো, এলামেলো চুলে, ধূলি মলিন চেহারায় শাহিন ওখানে দাড়িয়ে আছে। যার সংক্ষিপ্ত পরিচয় হলো, দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই হয় সে। এক সাথে পড়াশুনার জন্য আমাদের মাঝেও ভালো সম্পর্ক ছিলো। তবে শহরে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেনো দূরত্ব আমাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে।
-কি রে, কবে আসলি? কথা বলছিস না কেনো?
আমি কোনো জবাব না দিয়ে শহিনের কাছাকাছি চলে আসলাম। উল্টো আমিই প্রশ্ন করলাম সে এখানে কেনো? শহিনও আমার ন্যায় কোনো জবাব দিলো না। বুক ভাঙা এক দীর্ঘশ্বাস যেনো তার ভীতরটা ভেঙে বের হয়ে আসলো। তার চারপাশ ঘিরে যে নিরবতাগ্রাস করলো। তাতেই আমাকে মুখ খুলতে হলো। দাদার কবর জিয়ারতের কথা তাকে বললাম।
শাহিন দীর্ঘশ্বাসের পুনরাবৃতি করে বললো। চল এখন, এখন অনেক সন্ধা হয়ে গেছে। এখন আর এখানে দেড়ি করতে হবে না।
এই বলেই শাহিন চলতে লাগলো। আমিও তাকে চুপচাপ অনুসরণ করে কবরস্থান থেকে বের হয়ে আসলাম। একটা আলোতে দেখলাম, শাহিন কেমন মনমরা। বিধ্বস্ত যেনো তার সব কিছু। নিজের অস্তিত্বটুকু যেনো সে অনেক কষ্টে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি বলতে লাগলাম। যাকে কোনো সময় দেখলাম না আমাকে পাওয়ার পর চুপ থাকতে। সে সর্বদাই হাসি খুশির মাঝে থাকে। তাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই শাহিন বললো। এতো ভূমিকা করছিস কেনো? ভূমিকা ছাড়া যদি কোনো কথ্য বলতে পারিস। তবে বল। বেহুদা কথা শুনতে আমার এখন একদম ভালো লাগছে না।
– তোর এমন কবরস্থানে আসাটাও আমার কাছে রহস্যময় লাগছে।
শাহিন আমার কথার কোনো জবাব দিলো না। আমি একটু জোর গলাতেই বললাম। এমন চুপ করে কেনো। কিছু তো বল?
-কি বলবো? খুব সাধারণভাবে সে জবাব দিলো আমাকে।
-এ সময়ে তুই এখানে কেনো? নেশাটেশা করিস না তো আবার?
নেশার কথা উঠতেই সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো। নেশা আমার কাছে নতুন কিছু না। এ পেটে দেশি বিদেশি সবই পড়েছে। অল্পতে এখন নেশাও ঘরে না। আবার এমনও হয়, বোতল সাবার করেও আমার ভীতরে কোনো নেশা উঠে না।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক সময়ের ভালো ছেলেটা এমন করে বকে গেলো। কিন্তু কেনো? অনেক দিন দেখা না হওয়াতে তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু সে বিষয়ে আমি কথা না বলেই কবরস্থানে আসার কথা জানতে চাইলাম। জবাবে শাহিন বললো। এমনি এসেছিলাম। তা, তুই কবে এলি?
-এই তো বিকালের দিকে। কেমন চলতে তোর দিনকাল?
শাহিন ফ্যাকাশে মুখেই বললো। এই তো কোনো মতে।
সত্যি বলতে শাহিনের এমন চুপচাপ ব্যাবহার আমার কাছে সন্দেহ লাগছে। তাই একটু দাড়িয়ে শাহিনকে নিজের সন্দের কথাটুকু বললাম। যে ছেলেটার মুখে হাসি নেই। কথা বলার ঢংটাও অন্য রকম। তার তো কিছু একটা অবশ্যই হয়েছে। তা যেনো সে আমার কাছে একটু খুলে বলে। শাহিন আমার কথাতে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললো। তেমন কিছু নারে। শুধু কাঁদার একটু চেষ্টা করছি।
আমি ওর দিকে একটু বড় বড় চোখ করেই তাকালাম। ওর এই কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। শাহিন আমার এই চাহনি দেখে বললো। ওমন করে তাকিয়ে থাকিসনা। আমি এখন চলি, বাড়িতে কাজ আছে।
এই বলেই শাহিন চলে যেতে লাগলো। কিন্তু দু’চার কদম সামনে দিয়েই আবার সে ঘুরে তাকালো। তুই কি এর মাঝে চলে যাবি না থাকবি?
সপ্তাহখানিক থাকবো। ছুটিতে আসছি।
শাহিন আর কোনো কথাই বললো না। বিপরীত দিকে চলতে লাগলো। আমিও আর দেরি না করে বাড়িতে চলে আসলাম।
সন্ধা কাটিয়ে রাত নামতে লাগলো। আমি নিজের ঘরে এসে পশ্চিমের জানালাটা খুলে বসে রইলাম। সন্ধা তারাটা মিটমিট করে জ্বলছে। খন্ড খন্ড কিছু মেঘের আনাগুনা আকাশে। হয়তো বৃষ্টি হবে। এরই মাঝে মা খাবারের জন্য ডাকলেন। আমি খেয়ে এসে একই জায়গাতেই বসে রইলাম। রাত ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগলো। পশ্চিম আকাশে তারার মেলা বসতে লাগলো। আমি নিস্তব্ধ পৃথিবীতে সাক্ষী হিসাবে একাই জেগে রইলাম।
সকাল কখন হলো, তার কিছুই আমি বলতে পারবো না। সূর্য যখন তার আলো চারপাশে ছড়িয়ে দিতে লাগলো, তখন আমি পুরো ঘুমে। মা ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। দীর্ঘ জার্নি আর গভীর রাত অবধি জেগে থাকার জন্য হয়তো…। সে যাই হোক, ঘুম থেকে উঠে দ্রুত চা নাস্তা সেরে গ্রাম দেখতে বের হয়ে গেলাম। আমারই গ্রাম। কিন্তু তার সাথে কেমন যেনো অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। ইস্কুল, খেলার মাঠ, বড় দিখি-যেখানে আমার জীবনের অনেকটা সময় পার হয়েছে। আজ সবই কেমন যেনো অপরিচিত। তাও আমি ঘুরেঘুরে দেখতে লাগলাম। অতপর যখন বাড়ি ফিরছিলাম। তখন সহসাই শাহিনকে দেখতে পেলাম। গতকালের ন্যায় সেই হাওরা গাছের তলায় সে দাড়িয়ে আছে। মনমরা, চোখ মুখ কেমন লালা হয়ে আছে। তাকে ঘিরে কেমন যেনো একটা নিরবতা বিরাজ করছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। -কিরে, এখানে কেনো?
শাহিনের চারপাশের নিরবতা যেনো ভেঙে গেলো। তার এমন খেয়ালে ছেদ পড়লো। অনেক কষ্টে আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো। প্রশ্নটা কি আমাকে করলি?
শাহিনের চোখে মুখে বিস্বাদ। কালোমেঘের কোনো খন্ড যেনো তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। আমি ওর কাছে এগিয়ে আসতে লাগলাম। শাহিন অতি কষ্টে নিজের ঠোঁটে হাসি ফুটাতে লাগলো। কিন্তু কোথায় যেনো তা হারিয়ে গেলো। আমি একটু গম্ভির মুখেই তার তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম। এখানে কেনো? আরর কি হয়েছে তোর?
– কিছু হয়নি রে।
– কিছু হয়নি বললেই তো আর হলো না। কিছু একটা অবশ্যই হয়েছে। যা তুই আমার থেকে লুকাচ্ছিস।
আমি কোনো চোর নয় যে কিছু করলে লুকিয়ে করতে হবে। আমার কিছুই হয়নি। আর কাল হয়তো আমি তোকে বলেছি, একটু কাঁদার চেষ্টা করছি।
তুই কাঁদবি কেনো? তোর মতো এমন হাসি খুশি একটি ছেলে কাঁদতে চাইছে। ব্যাপারটা কেমন রহস্যময় না। কি হয়েছে আমাকে বল।
শাহিন একবার আমার মুখের দিকে তাকালো। কোনো কিছু না বলেই সে কবরস্থান থেকে বের হওয়ার জন্য হাটতে লাগলো। আমি পিছু ডাকলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শেষে দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরলাম। কি হয়েছে, আমাকে বল।
শাহিনের চোখে মুখে আধার জমাট বাধতে লাগলো। যেনো এখনি শ্রাবনের বর্ষণ শুরু হবে। কিন্তু না, শাহিনের চোখে এক ফোটা অশ্রুর দেখা নেই। কি হয়েছে, আমাকে বলবি না। ঠিক আছে, আমি আর
তোকে জোড় করবো না।
শাহিন নতুন তিনটি কবর দেখিয়ে আমাকে বললো। এই মাটির নীচে আমি সকল স্বপ্নকে দাফন করে ফেলেছিরে।
কথাটা শুনে আমি একেবারে থ হয়ে গেলাম। শেষ বার যখন গ্রামে এসেছিলাম, তখন শুনেছিলাম চাচা চাচী অনেক অসুস্থ। কিন্তু এমন একটা ঘটানা ঘটে গেছে। আমি তার কিছুই জানি না। অপরাধ বোধ আমার ভীতরেও হতে লাগলো। আমার চোখেও পানি আসতে লাগলো। আমি শাহিনকে বলতে লাগলাম। আমরা যেখানে নিজেদের সব কিছু শিয়ার করতাম। কোনো কথাই আমাদের মাঝে গোপন থাকতো না। সেখানে এমন একটি ঘটনায় আমাকে কিছুই বললি না। আমি কি এতোটা পর হয়ে গেছি?
অতীতের দিনগুলো ছিলো আনন্দের। সুখ স্মৃতিগুলো আমরা ভাগ করে নিয়েছি। কিন্তু বর্তমান, বর্তমানে তো আর সেই সুখ নেই। দুঃখ কষ্টগুলো আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
– দুঃখ বেদনা। এর মানে কি আমি আমার চাচা চাচীর মৃত্যুর খবর পাবো না। সত্যি আমি পরই রয়ে গেলাম। আপন আর হয়ে উঠতে পারলাম না।
শাহিন চুপচাপ করে দাড়িয়ে রইলো। আমি বুঝতে পারলাম না এই কথাগুলো আমার বলা ঠিক কি না। এখন কি বলতে হবে-তাও আমি ভেবে পাচ্ছি না। আমি শাহিনকে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলাম। বেশ কিছুদূর যাওয়ার শাহিন আমাকে বাড়ি চলে যেতে বললো। আমি সবার সাথে দেখা করার কথা বলে তার সাথে চলতে লাগলাম। কিন্তু শাহিন বললো। বাড়ির অবস্থা এখন ভালো না। সবাই কান্নাকাটি করবে। এগুলো তোর ভালো লাগবে না। তুই বাড়ি চলে যা, বিকালে মাঠে দেখা করিস।
আমি ওর কথা না শুনেই জোড় করে ওদের বাড়িতে গেলাম। এখনো বেদনার ছায়া বাড়িটার উপরে বিরাজ করছে। পিন পতন নিরবতা। আমাকে দেখেই শাহিনের ছোট বোন ছুটে আসলো। তার চোখের কোনে অশ্রু জমে আছে। মুখটা ভার। তার সমস্ত শ্রী কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। বেদনার সাগরে সেও বিলিন হয়ে গেছে। দাদীও আমাকে দেখে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি তার কাছেই আগে গেলাম। দাদী করুন কণ্ঠেই জিজ্ঞাস করলো। কবে এলি রে বাবা?
-এই তো কাল বিকালে?
– ভীতরে এসে বস। আলো ওকে কিছু খেতে দে।
অনেকটা সময় ছিলাম ও বাড়িতে। অনেক স্মৃতিরা এসে ধরা দিতে লাগলো। কখনো দীর্ঘশ্বাস আর কখনো অগোচরের অশ্রু এসে ধরা দিলো। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেওয়া গেলো না। দুপুরের আগেই বিদায় নিলাম। আলো আমার সাথে আমাদের বাড়িতে আসলো। চঞ্চল মেয়েটাও কেমন নিরব হয়ে গেছে। চোখের গহিনের গভীরতা কমে গেছে। এক সময় ঠোটের হাসি আর এই চাহনির জন্য শাহিনর সাথে ইস্কুল থেকে চলে আসতাম। আজ সেই চোখের চাহনিতে নেই কোনো আকুলতা। নেই কাছে টানার কোনো ব্যাকুলতা। আলো দুপুরে আমাদের সাথেই খেলো। খাওয়া শেষে আমি বারান্দায় গিয়ে একটু বসলাম। বড় ভাইও আমার সাথে গিয়ে বসলো। আমি তার কাছে চাচা চাচীর কথা জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। সাথে ছিলো বিশন বজ্রপাত। চাচার শরীরটাও সেদিন সন্ধার আগ থেকে ভালো ছিলো না। আর এ দিকে চাচীরও শরীর কয়েকদিন আগে থেকেই ছিলো খারাপ। কিন্তু তাও স্বামীর সেবা যত্নের কোনো কমতি ছিলো না। অর্ধরাত অবধি আমি সে বাড়িতে ছিলাম। এ অবস্থায় ডাক্তারও কয়েকবার ডেকে আনা হয়েছিলো। আর ডাক্তারও একটি কথাই বলছিলো। আমার আর এখানে কিছু করার নেই। উপরওয়ালার হাতেই সব। তাকেই ডাকুন।
চাচী সেই রাতে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। অনেক থাকতে চাইলাম। কিন্তু চাচী পাঠিয়েই দিলেন। বাড়িতে এসে হাত পায়ের কাদা ধুয়ে যেই ঘরে উঠলাম। তখন খবর আসলো। চাচা আর নেই। দৌড়ে গিয়ে দেখি, নিথর দেহটা চাদরে আবৃত করে রাখা হয়েছে। চাচীকে দেখলাম পাথরের ন্যায় এক কোনে বসে গ্রাছে। দাদী আর আলো পাগলের মতো কাঁদছে। তখন শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা আমাদের কারোই ছিলো। না। চাচীর পাশে গিয়ে তাকে কত ভাবে বুঝানোর চেষ্ঠা করতে লাগলাম। কিন্তু…। দু’দিন বাদে চাচীও বিদায় নিলেন।
সব কথা শেষ করে আমি আমার ঘরে চলে আসলাম। অলগ দুপুরে আমার একটু ঘুমের দরকার ছিলো। কিন্তু চোখের পাতায় কোনো ঘুম নেই। তাই উঠে পশ্চিমের জানালাটঠ একটু খুলে একটা নোবেল নিয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই আমার ঘরে আলো আসলো। আমি একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললাম। আলো বসেই বললো। তোমার যাগে একটা কথা ছিলো। সময় হবে তো?
আমি নোবেলটা বন্দ করে বললাম। কি বলার বল।
আলো চেয়ারটা টেনে আরও কাছে এসে বসলো। ভেজা চুল। চুপচাপ করে পানি পড়ছে। মার দেওয়া একটা খয়েরী শাড়ী পরেছে। আমিও নিজের লজ্জা দূরে ঠেলে তার চোখের দিকে খেয়াল করলাম। চাঁদের উপর থেকে যেনো এক টুকরো মেঘ সরে গেছে। আলো আমার এমন চাহনি দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো। সেই হাসিতে কৃত্তিমতা থাকলেও সৌন্দের্যের কোনো কমতি হলো না। সে নিজের ভীতরের সব কষ্টকে চাপা দিয়ে বলতে লাগলো। তোমার উপরে আমার রাগ অভিমানের কোনো কমতি নেই। মন চাচ্ছে, তোমাকে চিবিয়ে
গিলে ফেলি। আমি একটু ভ্রুকুলে কলাম। এমন রাগই বা কেনো। আর অভিমান কেনো। তোমরা তো আমাকে। খবর দাওনি। আমি তো সবার থেকে পর হয়ে গেছি।
– তোমাকে খবর দেইনি? এটা মিথ্যা কথা।
-মানে?
-তোমাকে হাজারবার খবর দিয়েছি।
-কিন্তু আমি তো পাইনি।
– তোমার হোস্টেলে কয়েক শ’ বার আমি ফোন করে জানিয়েছি।
– সত্যি বলছি, আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমি জানলে কি আসতাম না?
– তুমি জানতে পারো নি, সেটা তোমার ব্যাপার। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমি যে কথাটা বলতে এসেছি। সেটা শুনো।
এই বলেই আলো আমার দিকে একটু ঝুকে বসলো। আমি মনে মনে একটু খুশি হচ্ছিলাম। কত। দিনের বিচ্ছেদ। হয়তো রঙিন হবে কোনো গোপন ইচ্ছায়। কিন্তু সে যেই বললো। তুমি শ্রাবণীকে চিনো কি না। তখন যেনো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি কয়েক সেকেন্ড দম বন্দ করে রাখলাম। আলো আবার আমাকে জিজ্ঞাস করলো। শ্রাবণীকে তুমি চিনো কি না?
আমি নিজেকে একটু তুলে ধরে বললাম। কেনো বলতো। শ্রাবণীকে দিয়ে তোর কি দরকার?
– দরকার আছে। তুমি চিনো কি না তাই বলো?
– আমার তো মনে হয়, আমি এ নামের কাউকে চিনি না।
– কিন্তু ভাই যে বললো, তুমি না কি শ্রাবণীকে ভালো করে চিনো?
আমি অবাক হয়ে গেলাম। শাহিন কি শ্রাবণীর কথা বাড়িতে সব বলে দিয়েছে। আমি সত্যতা যাচাই করার জন্য আলোকে জিজ্ঞাস করলাম। আর কি কি বলেছে শাহিন?
-ভাই তো বলেছে, তুমি না কি তাদের দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছিলে?
কথাটুকু শুনা মাত্রই যেনো ভাঙা আকাশ থেকেই আমার মাথায় বজ্রপাত হলো। কথাটা একশ ভাগ সত্যি। কিন্তু এ কথা যদি আমার বাড়ির কেউ জানতে পারে। বিশেষ করে বাবা যদি জানতে পারে। তাহলে হয়তো দা বিহীনই আমাকে জবেহ করবে। আমি আর সময় নষ্ট না করে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। এখনি আমার শাহিনকে দরকার। বাড়িতে সে কি কি বলেছে তা জানা দরকার।
সূর্য পশ্চিম আকাশে অনেক আগেই হেলে গিয়েছে। রোদের প্রখরতা অনেকটাই কমে এসেছে। হাটতে হাটতে কবরস্থানের দিকেই আসলাম। বের হওয়ার সময় আলো বলে ছিলো তাকে না কি এখানেই পাওয়া যাবে। তাই এখানেই চলে আসলাম। এবেলাও শূণ্য চার দিক। একচা কুকুরও এ পথে নেই। এদিক ওদিক কয়েকদিক খুজেঁও শাহিনকে এখানে পাওয়া গেলো। তাই সরাসরি ওদের বাড়িতে গেলাম। ওখানেও নেই। তাই খেলার মাঠের দিকে চলে আসলাম। এখনো মাঠে খেলা জমে উঠেনি। কয়েকজন ছোট ছেলে মাঠের পূর্ণ কোনে ফুটবল খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সেখানেই শাহিন চুপ করে বসে আছে। আমি একটা রাগ নিয়েই ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। শাহিন আমকে দেখেই জিজ্ঞাস করলো। তুই এখানে?
-তুই বাড়িতে শ্রাবণীর ব্যাপারে কি বলেছিস? এ ব্যাপারে তো আমাকে জানালিও না। এখন আমার বাবা যদি জানতে পারে। তাহলে কি হবে, তা একবার ভেবে দেখেছিস।
শাহিন আমার এ কথার কোনো জবাব দিলো না। চোখ তুলে একবার তাকালো মাত্র। মুখটা কালো হয়ে গেছে। রাতের আধাঁর যেনো এখনি সব নেমে এসেছে তাকে ঘিরে। চোখ দু’টোও ছলছল। আমি পাশে বসে বললাম। এ ব্যাপারে তো তুই আমাকে জানাতে পারতি। আর আমাদের মাঝে কি কথা ছিলো?
শাহিন দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে বললো। কেমন করে যেনো সব শূণ্য হয়ে গেলো রে। হাসি খুশিতে ভরা জীবনটা আমার কেমন করে যেনো বেদনায় ভরে গেলো। আমার বুকটা যদি চিরে দেখাতে পারতাম। তাহলে…।
এতোটুকু কথা বলেই শাহিন অন্য দিকে চলে যেতে লাগলো। ওর কথা বার্তার আগা মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। চাচা চাচী নেই- সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এখানে কি আমার কথায় কোনো ভুল হলো। আমার কি অন্য কিছু বলার ছিলো। ভাবনায় পড়ে গেলাম। শাহিন আবার বলতে লাগলো। আমার সাথে এমন হলো কেনো বলতে কি পারিস?
আমি এবার একটু সংযত হয়েই বললাম। চাচা চাচীর জন্য মন খারাপ করিস না। নিজেকে শান্ত কর।
শাহিন অন্য দিকে মুখ করেই বলতে লাগলো। উপরওয়ালা আমাকে সব দিয়েছে। কিন্তু বেদনায় যে চোখে দু’ফোটা অশ্রু দিতে হয়। তা হয়তো তিনি ভুলে গিয়েছেন। বাবার লাশটা যখন কবরে নামালাম। তখনো চোখে এক ফোটা অশ্রু ছিলো না। মাকে পাথরে ন্যায় দেখেও কাঁদতে পারেনি। যখন মার লাশটা কাধে তুলে নিলাম। পৃথিবীর সবস্ত বেদনাই যেনো বয়ে নিয়ে চলছিলাম। কিন্তু তখনো এক দিন্দু অশ্রু চোখের কোনে জমে উঠেনি। আজ আমি বুঝতে পারছি। আমার ভীতরের বেদনাই আমাকে পাথর করে দিয়েছি। যেমন মাকে পাথর করে দিয়েছিলো। লোক মুখে একটা কথা শুনতাম, চোখের পানি না কি ভীতরের কষ্টগুলো দূর করে দেয়। কিন্তু দেখ, আমার চোখে কোনো অশ্রু নেই।
আমি উঠে শাহিনের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। কোনো শব্দ খুজে পাচ্ছিনা, যার দ্বারা শাহিনকে শান্তনা দিতে পারি। শাহিন এবার বলতে লাগলো। তোর যেদিন কথা মনে আছে, যেদিন প্রথম শ্রাবণীকে দেখেছিলাম।
আমি সংক্ষেপেই করলাম। হে মনে আছে।
– তুই তো শ্রাবণীকে দেখেই বলেছি। মেয়েটা যে ঘরে যাবে, সেই ঘরকেই আলোকিত করে রাখবে। সত্যি বলতে কি, তোর এই কথার কারণে আমি ওর দিকে বেশি ঝুকে গিয়েছিলাম। তারপর তো কয়েক বছর কেটে গেলো প্রেম ভালোবাসা বুঝতে বুঝতেই। তুই আমাদের দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছিলি।
-হে, তা কি হয়েছে?
পৃথিবীতে তুই ছাড়া আর কেউ এ কথা জানতো না।
– এখন তো সবাই জানে।
শাহিন কিছুটা সময় চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। যেনো তার বুক ভেঙে আসছে। অতপর বলতে লাগলো। লোকলজ্জার ভয়ে আমাদের ভালোবাসার কোনো পরিণতিও দাড়ালো না। আজ ভালোবাসা হারিয়ে। বুঝতে পারছি। শূণ্যতা কি জিনিস।
শাহিনের জীবনের কষ্টগুলো কখনোই আচ করা যায়নি। আজও ব্যতিক্রম না। বিয়ের কয়েক বছর পার হওয়ার পরও যখন ওদের কোনো বাচ্চা আমি দেখিনি। তখন আমি কয়েকবার জিজ্ঞাসও করেছি। শাহিনের তখন একটাই কথা ছিলো। ঘরে তুলে আনি। তারপর দেখা যাবে। আমি বারবার চিন্তা করতাম। বিয়ে করে কি এমন করে কাউকে দূরে রাখা যায়। তবে এই যে ভালোবাসা হারানোর কথা শাহিন বললো- তার মানে বুঝলাম না। শাহিন আর শ্রাবণীর মাঝে অনেকবারই ঝগড়া হয়েছে। দু’জনে দূরেও থেকেছে। কিন্তু কখনো এমন কথা শুনতে পাইনি। আমি সেই ভাব থেকেই শাহিনকে জিজ্ঞাস করলাম। শ্রাবণী কি তোর সাথে ঝগড়া করেছে?তোরা পারিস ও। আর শ্রাবণীই বা কেমন। দেখলো ছেলেটার এই অবস্থা, তখন কাছে আসার বদলে এই ঝগড়া, মান অভিমান।… বুঝ মানের যদি এমন অবুঝের ন্যায় কাজ হয়ে, তবে লোকে শুনলে কি বলবে।
আমি আমার মতো কথাগুলো বলে দাড়িয়ে রইলাম। শাহিন অনেকটা চুপ থেকে বলতে লাগলো।- তোর কথাগুলো একদম সত্য। মেয়েটা বড়ই অভিমানী। সেদিন আমার সাথে অনেকক্ষণ ঝগড়া করলো। কোনো মা বাবার মৃত্যুর সংবাদ আমি ওকে সময় মতো দিলাম না। জানিস, সেদিন খবরটা শুনেই অর্ধেক রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। ওদেরও কাউকে কিছু না বলে। এখানেই নাকি এর ঠিকানা। এখানেই ও চলে আসবে।
শাহিনের কথা কেটে আমি বললাম। শ্রাবণী এখানে? তুই তো আমাকে দেখা করালি না।
শাহিন বড় করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো। শ্রাবণী এখানে? হে, শ্রাবণী এখানেই রে?
ওর কথার মাঝে কেমন যেনো উপেক্ষার ভাব। আমি বললাম। চল, তোদের এই মান অভিমান শেষ করে দিয়ে আসি।
শাহিন সেই উপেক্ষার ভাব নিয়েই বললো।-কি করবি তুই?
আমি মুখে হালকা হাসি টেনে বললাম। ভাব করিয়ে দিবো।
শাহিন আর কোনো না বলে আমার হাতটা ধরে হাটতে লাগলো। আমি মনে করেছিলাম সে বাড়িতে যাবে। কিন্তু সে যখন বাড়ির পথ না ধরে কবরস্থানের পথ ধরলো। তখন আমি জিজ্ঞাস করলাম। কোথায় যাস?
শাহিন ক্ষীণ স্বরেই বললো। পৃথিবীর সবচে’ নিরব ও নিস্তব্ধ জায়গায়।
শাহিন আমাকে সেই হাওরা গাছের তলায় নিয়ে দাড় করালো। যেখানে তার বাবার কবর রয়েছে। তবে সে এবার আমাকে তৃতীয় কবরটার সামনে নিয়ে দাড় করালো। শ্রাবণী আমাকে কতটুকু ভালোবাসতো-তার হিসাব করতে পারবো না। কোনো সীমায় তা সীমাবদ্ধ করা যাবে না। অশীম ভালোবাসা আমাদের মাঝে ছিলো। সেদিন কোনো কথাই শুনেনি পাগলিটা। বলেছিলাম। আজ রাতটুকু তুমি অপেক্ষা করো। কাল সকালে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো। কিন্তু সেই রাতের কষ্টটুকুও তার সহ্য হলো না। সে রাতেই ভাগ করে নিতে চেয়েছিলো আমার বেদনাটুকু ভাগ করে নিতে।
শাহিন এখানে একটু থামলো। যেনো সে নিজেকে আর একটু শক্ত করে নিলো। অতপর বলতে লাগলো। শেষ রাতে অচিনা একটা নাম্বার থেকে কল আসলো। ঘুম ঘুম চোখে কিছুই দেখছিলাম না। চোখ দু’টো খুলে ছিলাম কি না তাও মনে নেই। কলটা ধরতেই কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞাস করলো। আপনি কি শ্রাবণীর স্বামী? প্রশ্ন শুনেই আমার চোখ থেকে ঘুম উবে গেলো। সত্যি বলতে সেই রাতের পর থেকে আমি আর ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, এই বুঝি আবার কোনো অচেনা অজানা নাম্বার থেকে কল আসছে।
শাহিন এখানে এসে চুপ হয়ে গেলো। আমি একটু জোড় দিয়ে বলতে লাগলাম। তারপর কি হলো?
শাহিন দীর্ঘশ্বাসে ছেড়ে বললো। আমি জিজ্ঞাস করলাম। শ্রাবণীর কোনো কিছু হয়েছে কিনা? লোকটা অনেকটা সময় নিয়ে বললো। আপনি ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে চলে আসুন। এরপর আমি অকেবার শ্রাবণীর কথা লোকটার কাছে জিজ্ঞাস করলাম। কিন্তু লোকটা তেমন কিছু না বলেই সে আমাকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বললো।… সেদিন আমি একটু দেরিই করে ফেলেছিলাম রে। যে লোকটা আমাকে ফোন করেছিলো। তার সাথে। দেখা হতেই সে প্রথমে আমাকে বললো। আপনি শক্ত হোন। নিয়তির উপরে আমাদের কারো কোনো হাত নেই। আমি শ্রাবণীর কথা জিজ্ঞাস করতেই লোকটা আমাকে লাশঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। সেদিন বুঝেছিলাম, অল্প পথও কত দীর্ঘ হয়। আমার পা দু’টো অবস হয়ে গিয়েছিলো। দেয়াল ধরে ধরে সেই ঘরে ঢুকলাম। কত লাশ এদিক ওদিক পড়ে ছিলো। কিন্তু যেই আমার শ্রাবণীর লাশটার উপর চোখ পড়লো…। বুকের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গিয়েছিলো। তাড়াহুড়া করে রাস্তা পার হওয়ার সময়…। সে সময়ও শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার সব অঙ্গ নিথর হয়ে গেলেও তার এই চোখ দু’টো, যে কারনে একে অপরের জন্য হাজার স্বপ্ন বুনে ছিলো। সেই চোখ জোড়া নিরব ভাষায় অনেক কিছু বলছিলো।
অতপর শাহিন তিনটা কবরের একটার দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বললো। এটা শ্রাবণীর কবর।
এরপর শাহিন একটু এগিয়ে গিয়ে বললো। জীবনে অনেক ব্যথাই আমি পেয়েছি। সব সময়ই তা হাসির আড়ালে তা লুকিয়ে রেখেছি। আমার জীবনে শ্রাবণীকে হারানোর ব্যথাটাই অনেক বড় রে। যে ব্যখাটা লোকানোর কিছু আমার নেই। তাই তো বুকের পাথরটা সরিয়ে আমি একটু হালকা হতে চাইছি। অশ্রুতে জীবনের সব বেদনাকে ধুয়ে মুছে ফেলতে চাইছি। কিন্তু পারছি না।
এরপর শাহিন আবার চুপ হয়ে গেলো। আমি কিছু বলতে গিয়েও বলত পারছিলাম না। নিজের ভাষা বলতেই তো তখন কিছু ছিলো না। অতপর শাহিন আবার বলতে লাগলো। আমার জীবনে সবচে বড় কষ্ট কি জানিস?
-কি?
আমি যদি একটু কাঁদতে পারতাম। এটাই হয়তো আমার জীবনের বড় কষ্ট।
শাহিন শ্রাবণীর কবরের পাশে গিয়ে হাটু গেরে বসলো। নিথর হয়ে আসছে যেনো তার দেহ। টুপটপ করে ঝড়ে পড়ছে অশ্রু। পরক্ষণেই সে কবরের উপরে পড়ে শিশু বাচ্চার ন্যায় কাঁদতে লাগলো। আমি তার তাকে বাধা দিলাম না। কাঁদুক না আর একটু। আমি পাশেই দাড়িয়ে রইলাম। আর আমি এমন করে কাউকে কাঁদতে দেখিনি। সন্ধা নেমে আসতে লাগলে শাহিনকে অনেক কষ্ট করে তুলে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। শাহিন বারবার ঘুরে শ্রাবণীর কবরটা দেখতে লাগলো। প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা কখনোই অন্যকে বুঝানো যায় না। তবে আমি কেমন ওর ব্যথা কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলাম।
আরো পড়ুন– শাশ্বত বোসের গল্প