কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

ভুল তো আমার ছিল- সুলেখা আক্তার শান্তা- গল্প

প্রতিদিন বিকেল বেলা ফয়সাল তার সকল বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয় মহল্লার কুদ্দুসের চায়ের দোকানে। ফয়সাল কখন দোকানে আসে কখনো যায়। ফাইজা প্রতিনিয়ত তা লক্ষ্য করে। এই বিষয় নিয়েই ছিল ফাইজার ভাবনা। ফাইজার ভালো লেগে যায় ফয়সালকে। ফাইজারদের ভাড়া বাসার বরাবর ছিলো কুদ্দুসের চায়ের দোকান।

তৌহিদ ফাইজার এ বিষয়টি লক্ষ্য করে, ফয়সালকে বলে, বন্ধু দেখ মেয়েটি তোর দিকে তাকিয়ে আছে।

ফয়সাল বলে, মেয়েটি আমার দিকে না তাকিয়ে আছে তোর দিকে।

হিরোর মত চেহারা তোর তাকাবে কি আমার দিকে? বন্ধু মেয়েরা শুধু তোর দিকেই তাকায়।

ফয়সাল দেখল মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফয়সাল প্রতিদিন যে সময় বন্ধুদের নিয়ে দোকানে আসে। ফাইজাও জানলা বরাবর করে বসে ফয়সালে দিকে তাকিয়ে থাকে। একদিন ফাইজা হাত দিয়ে ইশারা করে ফয়সালকে ডাকে। ফয়সাল দেখিও না দেখার ভান করে।

তৌহিদ বলে ফয়সাকে, মেয়েটি কেন ডাকে আমি যেয়ে দেখি?

ফয়সাল বলে, আমার মনে হয় তোর মনে রং লেগেছে?

তৌহিদ কোন কথা না বাড়িয়ে ফাইজার সামনে হাজির। তৌহিদ বলে, আপনি আমাদের কিছু বলতে চান? ফাইজা একটি কাগজ তৌহিদের হাতে দিয়ে ফয়সালকে দেখিয়ে কাগজটি দেওয়ার জন্য বলে।

তৌহিদ ফয়সালের কাছে এসে বলে, মেয়েটি তোকে পছন্দ করে। এবার হলো তো, ধর এই কাগজটি তোকে দিতে বলল। কাগজটি খুলে দেখ কি লেখা আছে। ফয়সাল কাগজটি খুলে দেখে, একটি ফোন নাম্বার। আর লেখা, আমাকে ফোন দিও। তোমার ফোনের অপেক্ষায় আছি।

তৌহিদ বলে, ইস এমন কথা আমাকে কেউ বলে না। তোর কি কপাল।

ফয়সাল রেগে বলে, ফাজলামি পেয়েছিস, তুই যেয়ে কথা বল।

ফয়সাল হঠাৎ একদিন রাতে শুয়ে ভাবলো আচ্ছা নাম্বারটা যেহেতু দিয়েছে, দেখি না ফোন দিয়ে। এরপর নাম্বারে ফোন দেয়। ফোন রিসিভ হলো ওপাশ থেকে কন্ঠ এলো, তাহলে ফোন দিলেন। আমি যে আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। কখন আপনার ফোন আসবে, কখন আপনার সাথে কথা বলতে পারব। যাক অবশেষে অপেক্ষা প্রতিফল পাওয়া গেল। ফাইজা থাকেন বোন নাজিয়ার বাসায়। ফাইজার কোন পড়ালেখা ছিলো না। কিন্তু তার চলন বলনে তা কখনোই বোঝা যায়নি। ফাইজা খুবই স্মার্ট আর রুচিশিল ছিল। এরপর ফাইজার আর ফয়সালের প্রতিনিয়ত কথা হয়। দু’জনের মধ্যে প্রেম হয়। কিন্তু ফয়সাল যে কলেজে পড়ে, সেই কলেজের একটি মেয়ে ভালোবাসে ফয়সালকে। ফাইজা তা জেনে। হঠাৎ একদিন ফয়সালকে বলল, আমি তোমার কলেজে যাব। ফয়সালও ভালোবাসার মানুষটির দাবি পূরণ করতে একবাক্যে রাজি ফাইজাকে কলেজে নেওয়ার জন্য। ফয়সাল ফাইজাকে নিয়ে তার কলেজে আসে। নাহিদা একটু দূর থেকেই দেখতে পেল। ফয়সালের কাছে আসতেই দেখলো নাহিদা। ফয়সাল একটি মেয়েকে কলেজে বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আমার ভালোবাসার মানুষ ফাইজা। একথা শুনে, নাহিদার মনে হলো পৃথিবীর সবকিছুই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

ফয়সাল নাহিদাকে দেখতে পেয়ে বলল, নাহিদা কাছে এসো, তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই।

নাহিদার বুকে বিরহের আগুন জ্বলছে। নাহিদা বলল, আমি একটু সামনে থেকে আসছি।

ফয়সাল নাহিদার ভারাক্রান্ত মুখ দেখে নিজেও থমকে গেল। এরপর নাহিদাকে কিছুই বলল না। ফয়সাল ফাইজার হাত ধরে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। ফাইজা খুব আনন্দিত কারণ যে মেয়েটি ফয়সালকে ভালোবাসে তার সামনেই তাকে নিয়ে ভালোবাসার মানুষ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

হঠাৎ ফাইজার মনে হল মেজো বোন আসমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ বেড়াতে যাবে। ফয়সালের সাথে সম্পর্ক হওয়ার কয়েকদিনপর তার এমন সিদ্ধান্ত। ফাইজা বোনের বাড়ি ঢোকার মুহূর্তেই দেখে মহিউদ্দিন। ভদ্রলোক বয়স একটু বেশি ফাইজাকে দেখে পছন্দ করে। মহিউদ্দিন বোনা আসমা কাছে ফাইজার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আসমা বোন ফাইজার সঙ্গে বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলে। ফাইজা জানায় তার একটি ছেলেকে পছন্দ।

আসমা বলে, এসব ভালোবাসা টাসা বাদ দে। আমরা যেখানে তোর বিয়ে ঠিক করব সেখানে তো মত দিতে হবে। ফাইজা প্রথমে বিয়েতে একটু দ্বিমত করলেও তারপরে সে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।

ফয়সাল এ বিয়ের কথা শুনে ফাইজকে বলে, কেন তুমি বিয়ে মত দিলে?

ফাইজ বলে, আমার বোন ভালো পাত্র পেয়েছে তাই আমাকে বিয়ে দিচ্ছে।

এরপর মহিউদ্দিনের সাথে ফাইজার বিয়ে হয়। বিয়ের তিন মাস ফাইজা ভালোই সংসার করছিল। ফাইজা মিরপুর বোন নাজিয়ার বাসায় আসে। ফাইজা যোগাযোগ করে ফয়সালের সঙ্গে।

ফয়সাল বলে, তোমার বিয়ে হয়েছে তুমি কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছো? এখন আমার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ না করাই ভালো।

ফাইজা বলে, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। তুমি আমার সাথে দেখা করো। আমি বিয়ে করতে চাইনি।পরিবারের কথা মানতে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে। ফাইজার আকুতির কাছে ফয়সাল ভাবে আমিও তো ভালোবাসি ফাইজাকে। তাহলে কেন ফাইজা কষ্ট পাবে। কেন আমি ওকে দূরে সরিয়ে দেবো। এরপর ফয়সাল আর ফাইজার রীতিমতো দু’জনার মধ্যে দেখা কথা চলতে থাকে। ফাইজা বর্তমানে স্বামী মহিউদ্দিনের বাড়ি আর যেতে চায় না। দুলাভাই আলমগীর জানতে চাই কেন তুমি স্বামীর বাড়ি যাবেনা? তখন ফাইজা বিভিন্ন ধরেনের কারণ তুলে ধরে মহিউদ্দিনের বয়স বেশি। সে আমাকে বুঝতে চায় না। তার কাছ থেকে আমি সময় পাই না, বিভিন্ন ধরনের অজুহাত। দুলাভাই আলমগীর এইপর মহিউদ্দিনের অনেক দোষ গুণ দেখে বিবেচনা করে ভাবলো শালী যেহেতু সংসার করতে চাচ্ছে না। তাই সে শালীর মতের সাথে মত মিলায়। ফাইজা সিদ্ধান্ত নেয় সে আর মহিউদ্দিনের সংসার করবে না। সে এরপর মহিউদ্দিনকে ডিভোর্স দেয়। ফাইজার মনে হল সে বন্দী জীবন থেকে মুক্ত।

ফয়সাল আর ফাইজা দুজনে বিয়ে করে। ফয়সালের পরিবার থেকে ফাইজাকে মানতে চায় না। কিছুতেই তারা এই বিয়ে মেনে নেবে না। ফাইজা বোনের বাসায় থাকে সেখান থেকেই ফয়সালের সাথে বাহিরে দেখা করে। এরপর ফাইজার মন ভারী হয়ে ওঠে। স্বামী বেকার তাতে কি। স্বামী খাইতে পারলে আমিও খেতে পারব। ফাইজা উঠে পড়ে ফয়সালের বাড়ি। ফয়সালের বাড়িতে দু’ দিন থাকার পর, ফয়সালের মা ডালিয়া আর ভাবী পারভিন একত্র হয়ে। ফয়সাল না থাকা অবস্থায় ফাইজাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ফাইজা সেখান থেকে বের হয়ে বোনের বাড়িতে উঠে। ফাইজা এরপর ফয়সালের পরিবারের নামে মামলা দেয়। মামলার কারণে ফয়সালের পরিবার ফাইজাকে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফাইজাকে মামলা তুলে নিতে বলে। ফাইজা ভাবে আমি তো আমার সংসার ফিরে পেয়েছি এখন আমার মামলার আর প্রয়োজন নেই। ফাইজা তাই মামলা তুলে নেয়। ফয়সালের মা ডালিয়া ছেলের বউ হিসাবে ফাইজাকে মেনে বাড়ি নিয়ে যায়। মামলা তোলার কয়েকদিন পর ফাইজাকে আবার নির্যাতন শুরু করে। এদিকে পরিবারের এমন অশান্তিতে ফয়সাল অস্থির হয়ে পড়ে। একদিকে স্ত্রী আরেকদিকে মা কাউকেই সামাল দিতে পারছে না ফয়সাল। ফাইজা এমন সমস্যা সমাধান না পেয়ে মামলা চলাকালে আসা-যাওয়ার পথে জাহিদ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। ফাইজা নিজের সুখ-দুঃখের কথা জাহিদের কাছে বলে। ফাইজার এখন জাহিদ খুব আপন মানুষ হয়ে ওঠে। ফাইজা এখন স্বামী ফয়সালের আশা-ভরসা ছেড়ে দিয়ে জাহিদকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ফাইজার বেপরোয়া চলাফেরা দেখে ফয়সাল তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ফাইজা বেপরোয়া হয়ে ওঠে আরো বেশি। ফাইজার পরিবারও তাকে এবেপরোয়া চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। ফাইজা ঝোঁকের মাথায় জাহিদকে বিয়ে করে।

ফাইজাকে ফিরিয়ে আনতে অনেক অনুনয় বিনয় করে ফয়সাল।

ফাইজা বলে, আমার আর ফেরা সম্ভব না। তোমার কাছে আমি সংসার পাইনি পেয়েছি শুধু যন্ত্রনা। এখন আমি সংসার পেয়েছি। এবার তুমি তোমার পথ দেখো।

ফয়সাল মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে ফাইজার জন্য। ফয়সালের দুর্দিনে অনুভব করে নাহিদাকে।

নাহিদা ভালোবাসার মানুষের এমন অবস্থা দেখে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে ফয়সালকে সময় দেয় মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য।

ফয়সাল ভাবে দুর্দিনে সঙ্গী নাহিদাকে সে বিয়ে করবে। তাদের দু’ জনের সিদ্ধান্তেই বিয়ে হয়, সংসার শুরু করে।

এদিকে ফাইজার সংসারে অশান্তি লেগে যায়। স্বামী জাহিদের প্রথম স্ত্রী লোপার সঙ্গে ফাইজার ঝগড়া ঝাড়ি লেগেই থাকে। ফাইজা কিছুতেই লোপার সঙ্গে পেরে ওঠে না। স্বামী জাহিদকে এ বিষয়ে জানালে সে কোন কিছু বলে না। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামী জাহিদ ফাইজাকে রেখে তৃতীয় বিয়ে করে।

ফাইজা দেখে স্বামী জাহিদের মনে তার কোন স্থান নেই। ফাইজা এখন অসহায় হয়ে ফয়সালের কথা স্মরণ করে। এরপর ফয়সালের ফোনে সে যোগাযোগ করে, ফয়সালকে বিস্তারিত খুলে বলে।

ফয়সাল বলে, তুমি তো সুখের আশায় আমার কাছ থেকে চলে গেছো। এখন কেন এসব বলছো? আমার এখন কিছু করার নেই। আমি বিয়ে করেছি।

ফাইজা বলে, আমি কিছু শুনতে চাই না, আমাকে তোমার কাছে নাও।

ফয়সাল বলে, তোমাকে ফিরিয়ে আনার আমার কোনো রাস্তা নেই। ফয়সালকে যখন তখন ফোন দেওয়ায় নাহিদা টের পেয়ে যায়। ফাইজার কারণে ফয়সালের ঘরে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে।

ফাইজা ভাবে সুখ যখন আমার কপালে নেই। আমিও কাউকে সুখী হতে দেব না। ফয়সালের সংসার কিভাবে ভাঙ্গা যায়। সে সেই চেষ্টাই করে। নাহিদা স্বামীর সঙ্গে   ফাইজার যোগাযোগ বন্ধ করতে না পারে। একপর্যায়ে সে  সিদ্ধান্ত নেয়। সে আর ফয়সালের সঙ্গে সংসার করবে না।

ফয়সাল কোনভাবেই নাহিদার ভুল ভাঙতে পারেনা। ফয়সাল বুঝাতে পারেনি নাহিদাকে, ফাইজার জন্য তার হৃদয়ে ভালোবাসা কোন স্থান নেই। নাহিদা তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে সে ফয়সালকে ডিভোর্স দেয়। ফাইজা এতে আনন্দিত হয়।

ফয়সাল বলে ফাইজাকে, তোমার কারণে আমার সংসার ভেঙে গেল।

ফাইজা বলে, তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে নাও।

ফয়সাল বলে, তা কখনোই সম্ভব না। তুমি সুখ দেখে চলে গেছো এখন সুখ নিয়ে থাকো। নাহিদা ফয়সালের কাছ থেকে যাওয়ার পর। সেই সুযোগটা ফাইজা গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু ফয়সাল সুযোগটা দিতে নারাজ ফাইজাকে। ডালিয়া ছেলের মন মানসিকতা ভেঙে পড়ায় এরকম অবস্থা দেখে, সে নিজের পছন্দ মত মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেয়। ফয়সালের বিয়ে হয় সারার সঙ্গে।

ফাইজার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। ফাইজা দেখে ফয়সালকে পাওয়ার সুযোগটা তার হাতছাড়া হলো। ক্ষিপ্ত হয়ে ফয়সালের তৃতীয় বিয়েটা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। ফাইজার মনে সুখ নেই কিন্তু মনে অনেক হিংসা আছে।

ফাইজা বলে ফয়সালকে, আমাকে যখন তুমি প্রত্যাখ্যান করেছো। তখন তোমাকে অন্য কাউকে নিয়ে শান্তিতে সংসার করতে দিব না।

ফয়সাল এতে ঘাবড়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেয় সে আর দেশে থাকবে না। এরপর ফয়সাল স্ত্রী সারাকে নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেয়। ফাইজা এতে হতভম্ব হয়ে পড়ে। সে ফয়সালকে না পেয়ে হতাশ।

লোপা ফাইজাকে বলে, তুই আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়ে, আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে ছিস। এবার দেখ স্বামী তোকে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করে তোর বুকে আগুন জ্বালিয়েছে এবার বোঝ আগুনের জ্বালা কেমন লাগে। ফাইজা অস্থির হয়ে পড়ে ভাবে কোন সুখের ঠিকানা মিলল না তার। সে মনে করে সুখ তার কাছ থেকে দূরে। সে নিজেকে অসহায় ভেবে, ভাবে ‘ভুল তো আমার ছিল’। ফাইজার শত কিছুর মাঝেও ফয়সালের কথা তার মনে পড়ে বার বার।

 

আরো পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প- পুরষ্কার