প্রচ্ছদসাক্ষাৎকার

কবি ও গীতিকার সৌপর্ণ মাছুম-এর সাক্ষাৎকার

কেমন আছেন ?

আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি ।

 

লেখালেখির শুরুটা কিভাবে ?

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি ; বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুলে । ১৯৯৮ সালের কথা । আমার বন্ধু আলিমুল রাযী একদিন ক্লাসে একটি ডায়ারি দেখালো । তাতে কয়েকটি ছড়া ও কবিতা লেখা ছিল । সে বলল, “এগুলি সব আমি নিজেই লিখেছি।” রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম । বন্ধুকে বললাম, “দারুণ হয়েছে, প্রজাপতি কবিতাটি তো অসাধারণ হয়েছে।” আমার কথা শুনে সে খুবই খুশি হলো । আমাকে বললো, “দোস্ত, তুইও চেষ্টা কর, তুইও লিখতে পারবি।” বন্ধুুর কথা শুনে প্রেরণা পেলাম । বাসায় এসে রাতে খাতা কলম নিয়ে বসলাম। অনেক চিন্তা করে ছন্দের মিল করে নিজেকে নিয়ে একটি ছড়া লিখে ফেললাম ।

নামটি আমার মাছুম

ভালোবাসি ডিমের কুসুম…..

ইত্যাদি…. ইত্যাদি……

পরদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুুকে স্বরচিত ছড়াটি দেখালাম । সে বলল খুব ভালো হয়েছে। তখন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করলাম । কয়েক মাস পর বন্ধুুর কবিতার ডায়ারিটা হারিয়ে গেল । সে কবিতা লেখা ছেড়ে দিল কিন্তু আমি লেখা চালিয়ে গেলাম । কবিতা লেখায় তখন আমায় নেশা পেয়ে বসল । আমাদের ক্লাসে মাছুম নামে তিন জন ছাত্র ছিল। কবিতা লেখা আর বইপড়া নিয়ে মেতে থাকতাম বলে সহপাঠীরা আমায় সাহিত্যিক মাছুম নামে ডাকতো । এরপর বছর দুই পর কৌতূহলের বশে একটি গান লিখলাম । আমার প্রিয় বন্ধু কামরুল হাসান এমরান গানটিতে সুরারোপ করল এবং গেয়ে শোনালো । আমার আনন্দ তখন দেখে কে !  এরপর থেকেই গান লেখাতেও নেশা ধরে গেল । নতুন কোনো গান কিংবা গজল লেখা শেষ হলেই ছুটতাম  প্রিয় বন্ধু এমরানের কাছে । করতোয়া নদীর পাড়ে গাছে বসে চলত গানের মহড়া । এক দুই ঘন্টার প্রচেষ্টার পর এমরানের সুরে গানটি যেন প্রাণ ফিরে পেত । আমার লেখা প্রায় পঞ্চাশটি গানে গীতিকার ও সুরকার বন্ধু কামরুল হাসান এমরান সুর সংযোজন করেছেন ।

ছোটোবেলা থেকেই ছড়া-কবিতার প্রতি আমি আসক্ত ছিলাম । নার্সারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে পড়ার সময় বাংলা বইয়ের প্রায় সব কবিতাই মুখস্থ করে ফেলতাম । বাংলা বইয়ের শব্দার্থ এবং বাংলা ব্যকারণ বইয়ের প্রতিশব্দ সব মুখস্থ করে ফেলেছিলাম । প্রচুর বই পড়তাম আর বই কিনতাম । রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, গীতাঞ্জলি ; নজরুলের সঞ্চিতা, অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, দোলনচাঁপা, সাম্যবাদী ইত্যাদি  ইত্যাদি পড়ে ফেলেছি । বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুলের নুরুল ইসলাম স্যার ক্লাসে অনেক সুন্দর করে কবিতা বুঝাতেন। অনেক বড়ো বড়ো কবিতা তিনি মুখস্থ বলতেন । একদিন স্যার কাজী নজরুল ইসলামের বিখয়াত মহরম কবিতা আবৃত্তি করলেন । আমি অবাক ও মুগ্ধ হয়ে স্যারের আবৃত্তি শুনলাম । তখন থেকেই আমি বড়ো বড়ো কবিতা মুখস্থ করা শুরু করলাম । নুরুল ইসলাম স্যারের অনুপ্রেরণায় কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটি আমি মুখস্থ করেছিলাম, আজো তা অনর্গল মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারি । বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন চন্দ্র স্যার লেখালিখি করতেন । তিনিও আমাদের বাংলা ক্লাস নিতেন এবং অনেক ভালো কবিতা বুঝাতেন । মাধ্যমিকে এই দুই স্যার ছিলেন আমার কবিতাপ্রেমিক হওয়ার অনুপ্রেরণা ।

মাধ্যমিক শেষ করে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম । আমাদের কবিতার ক্লাস নিতেন  তোফাজ্জল হোসেন স্যার (স্যারের সাহিত্যিক নাম শোয়েব শাহরিয়ার) । বাংলা সাহিত্যের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি ! স্যারের ক্লাস আমরা এতটাই উপভোগ করতাম যে, ক্লাস শুরু হলে আমরা আর ক্লাসে থাকতাম না,  কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম, আমরা প্রতিনিয়ত বৈচিত্র্যময় সাহিত্যরাজ্যে বিচরণ করতাম ! মনে হতো “এই ক্লাস যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো” !! এরপর জীবনানন্দ, মাইকেল, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, শার্লক হোমস পড়া শুরু করলাম । স্যারের ক্লাস করার পর মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো  মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম বড়ো হয়ে কবি হবো । বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করব, নজরুলের মতো লম্বা চুল রাখবো । উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর বাংলায় অনার্স করতে চাইলে বাসা থেকে রাজি হলো না । মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভালো রেজাল্ট, মা-বাবার ইচ্ছা সাইন্স নিয়েই পড়তে হবে । আমি তখন ভাবলাম, রবীন্দ্রনাথ নজরুল তো বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করে নি, মাইকেল, সুকান্ত, জসীম উদদীন, জীবনানন্দ তো বাংলা নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন নি, তো তাঁরা কবি হতে পারলে আমি কেনো বাংলায় ডিগ্রি না নিয়ে কবি হতে পারব না ? এই ভেবে মা-বাবার ইচ্ছা ও অন্যান্যদের চাপে অবশেষে আর বিভাগ পরিবর্তন করলাম না । অবশেষে বিজ্ঞানের মৌলিক শাখা রসায়ন বিষয়ে আমি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্ত করি ।

 

প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কিছু বলুন ।

এ পর্যন্ত আমার চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে । বইগুলো হলো

কাব্যগ্রন্থ :

(১) আদিগন্ত শস্যজলে নিরন্তর বাঁশি : ২০১৮, পৃষ্ঠা প্রকাশন

(২) জোছনাপত্রে ভেজানো শ্লোক : ২০২০, চর্যা প্রকাশ

(৩) কলসে বালির কাঁথা : ২০২২, চর্যা প্রকাশ

সংগীত :

(৪) সপ্তসুরে নন্দনহার : ২০১৯, ইশা প্রকাশন

২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আদিগন্ত শস্যজলে নিরন্তর বাঁশি’ । আমার প্রিয়তমা সহধর্মিণী জাকিয়া সুলতানা বইটি প্রকাশে অনুপ্রেরণা  দিয়েছে এবং বই প্রকাশের সকল ব্যয়ভার বহন করেছে । আমার শিক্ষাগুরু কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শোয়েব শাহরিয়ার বইটির প্রুফ দেখে দিয়েছেন এবং বইটির প্রথমে একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছেন । আমার প্রথম বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন :

“বিজ্ঞান-ভিত্তি নিয়েই কবিতা ভুবনে পদচারণা শুরু করেছেন কবি সৌপর্ণ মাছুম। কবিতায় প্রসাদীয় ব্যঞ্জনা উৎসারণের ব্যাপারটি সৃজন ক্ষমতা আর বোধ-অনুভবের গভীরতার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বহু কর্ষিত ‘প্রতিভা’ নামক অলৌকিক বিষয়টির সঙ্গে গভীরতর পঠন-পাঠনের তাদাত্ম্য-সঙ্গম অগ্রসরমান কবিসত্তার পরিস্ফুটনের জন্য অতীব প্রয়োজন। কবিত্ব শক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা হলেও আমি বিশ্বাস করি সৌপর্ণ মাছুম অভ্যন্তরে, গোপনে, পেলবকোমল একটা কবিস্বভাব লালন করেন। কবি সৌপর্ণ মাছুমের কবি-প্রকৃতির যতটুকুই পরিচয় আমার কাছে ধরা পড়েছে তাতে মনে হয়েছে যে, কবি আপন স্বভাবে বেড়ে ওঠা সংগ্রামশীল কবি। আগ্রাসী অরণ্যের মধ্যে নানা প্রতিকূল আবহাওয়ায় একটি কোমল স্বভাবী পুষ্পবৃক্ষ অপরাপর বিশাল-অবয়বী মহীরূহকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আপন আসনটিকে পবিত্রতার সঙ্গে বাঁচিয়ে রেখে অন্যান্য বৃক্ষবৃন্দের সাথে বেড়ে উঠতে প্রচেষ্টা চালায় সৌপর্ণ মাছুম সেই পুষ্পবৃক্ষ, যাঁকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে আপন অস্তিত্বের জন্য নিয়ত সংগ্রাম করতে হয়।

‘আদিগন্ত শস্যজলে নিরন্তর বাঁশি’ কবি সৌপর্ণ মাছুমের কবিতার প্রথম সংকলন। স্বভাবতই কবিতাগুলো কৈশোরিক এবং অপরিপুষ্ট যৌবনকালীন। তারুণ্যের অতিতরলীয় আবেগ কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে এটাই স্বাভাবিক। উষ্ণ আবেগের পরল দিয়ে কবিতাগুলোর দেহ ও অন্তরগুলো তৈরি হয়েছে এবং এ সৃষ্টিশীলতায় স্বল্প বয়সের অমার্জিত উত্তেজনা ও সংবেদন জড়িত রয়েছে, তাই এই কবিতাগুচ্ছের প্রতি কবির মমতা, ভালোবাসা ও সংরাগ শর্তাতীত জনকের ন্যায়। তাই শত দুর্বলতা সত্ত্বেও এ সংকলনের আত্মপ্রকাশ।

বৈশিষ্ট্য অনুসারে কবিতাগুলোকে তিন পর্যায়ভুক্ত করা যেতে পারে। প্রথম পর্বে রয়েছে কিছু রোমান্টিক হার্দিক প্রেমগীতি। বাংলা গানের ঐতিহ্যিক চতুঃপর্ব মেনেই গীতিগুচ্ছ রচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রস্তুতিপর্বের কবিতাগুচ্ছ। বাংলা কবিতা ধারায় প্রাক-রাবীন্দ্রিক বা রাবীন্দ্রিক রীতিকে মেনে নিয়েই কবি সৌপর্ণ মাছুম প্রথম পর্বের কবিতাগুলো রচনা করেছেন। যে কারণে কবিতায় প্রাচনীগন্ধী কিছু শব্দ যেমন, লাগি, মোরে, লভিতে, মম ইত্যাদি ব্যবহার কবি করেছেন। তৃতীয় পর্বে কবি আধুনিক চেতনাঋদ্ধ হবার প্রতি সচেষ্ট থেকেছেন। আধুনিক যুগ-নির্যাসকে অন্তরের পরিশীলিত ললিত রসে আর্দ্র করে প্রস্ফুটিত করার গাঢ় ইচ্ছা কবি পোষণ করেন, এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। পরবর্তী সংকলনে সমসাময়িক চেতনাবিষ্ট একজন অত্যাধুনিক যুগ-প্রতিনিধি হিসেবে কবির আত্মপ্রকাশ ঘটুক এই প্রত্যাশায়।

কবি সৌপর্ণ মাছুমের কবিতার বহুল প্রচার ও প্রসার হোক এই আমার সর্বাত্মক প্রার্থনা।”

 

২০১৯ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় বই ‘সপ্তসুরে নন্দনহার’। এটি আমার রচিত একটি গানের বই ।

এই বইয়ের ভূমিকায় কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শোয়েব শাহরিয়ার লিখেছেন :

“মহান স্রষ্টার বিশাল, অপরিমেয় সত্তার সঙ্গে একান্তে লীন হবার আকুতি ও বেদনা থেকেই সুফীসঙ্গীতের উৎসারণ। বেদনা থেকে আর্তি, আর্তি থেকে মিলনের সকরুণ নিবেদন। বিশস্রষ্টার অপার মহিমার সঙ্গে অংশভাগী হবার তাগিদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ নিঃশর্ত নিবেদনের বেদনা-সিঞ্চিত করুণ সুরের আবেদনে। ঈশ্বর-মিলনের বহুমাত্রিক প্রার্থনার মধ্যে ইসলামে গুহ্য সঙ্গীত বা সাধনসঙ্গীত বা মরমী সঙ্গীতের উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকে-ইরানে আরবী-ফারসি ভাষায়, পরবর্তীতে উর্দুতে ভারতবর্ষে এবং বাঙ্গাল মুলুকে এ-ধারার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ বাংলার অদ্বিতীয় বুলবুল কাজী নজরুল ইসলামের গানে। পরবর্তীকালে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন মুসলমান সুফী সঙ্গীত বা সাধন সঙ্গীত রচয়িতা আর কেউ নেই।

এ-কথাই প্রমাণিত যে, এ-কাল অবধি কবিরাই শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত রচনা করেছেন। সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতসমূহের অধিকাংশই কোন না কোন কবির সমৃদ্ধ রসনন্দিত অনুভব। তবে শুধুমাত্র গীতিকার হিসেবে একক মাত্রাও যোগ করেছেন এমন অনেক স্রষ্টাও রয়েছেন। তবে সর্বদাই যে তাঁরা সৃষ্টিতত্ত্বের সাধন মার্গে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন এমন নয়। সৃষ্টি ও গুরুতত্ত্ব গভীর রহস্য নিয়ে সারস্বত সঙ্গীত সৃষ্টি করে বাংলা গানে অমর হয়ে আছেন যাঁরা তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, লালন ফকির, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ প্রমুখ পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিবর্গ।

সৌপর্ণ মাছুম, মূলত একজন কবি। গত বছর (২০১৮) তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘আদিগন্ত শস্যজলে নিরন্তর বাঁশি’ প্রকাশিত হয়েছে। নবীন এবং তরুণ কবির আন্তর- রসায়নে বহুমাত্রিকতার প্রেরণা আছে বলেই কবিতার পাশাপাশি গান রচনায় তিনি সিদ্ধি প্রত্যাশী। কবি হিসেবে এখনো অনেক পথ তাঁর সামনে পড়ে রয়েছে, সে পথ অতিক্রমণে নিরন্তর রক্তক্ষরণ অপরিহার্য, আর সে দুঃসহ, কণ্টকদীর্ণ, ধূসর-পিঙ্গল- নিষ্করুণ-নির্মম পথে চলতে চলতেই তাঁর সঙ্গীত কথামালার শস্যক্ষেত্রে হলকর্ষণ একটু দুঃসাহসিকতাই বটে। কবিতার ক্ষেত্রখানা জটিল, তবে গীতি-কবিতার ক্ষেত্র প্রায় অকর্ষণযোগ্য, ঊষর, কাঁকর-পরিবৃত এবং জটিলতর। আর সে ক্ষেত্রে কবি সৌপর্ণ মাছুম একক সাহসিকতায় অদম্য এবং নির্ভয়।

সাধন-সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিছু পৌনঃপুনিকতা বা পুনরাবৃত্তির বৃত্ত অনেক সময় এ-গীতি সংকলনে কবি-কল্পনার অপ্রতুলতার কথা বললেও তার ছন্দ বেশ টানটান, দোলা আছে। বেশ কিছু গান পড়ে মনে হয়েছে যেন তারা মধুরতর কোন সুরের আচ্ছাদন পরে ফেলতে দ্রুত আগ্রহী। প্রবল সুষমার সুরে কেউ যদি কথামালার অভ্যন্তরীণ আবেগ আর প্রবৃত্তিকে বেঁধে ফেলতে পারেন তাহলে কবি সৌপর্ণ মাছুমের দীর্ঘকালের শ্রম আর ভালবাসায় অভিষিক্ত মুর্শিদ ও ঈশ্বর নিবেদনের পবিত্র আকুতি শীলিত-স্নিগ্ধ অবয়ব পাবে।

এ-সংকলনের শেষ পর্যায়ে কিছু আধুনিক বাংলা গানের সংযোজনা রয়েছে। মানবিক এবং হার্দিক আকুতিই যার মূল বিষয়-আশয়। অতলান্ত বেদনা, আকুতি, আর্তি, অপ্রাপ্তি, হাহাকার এবং তীব্রতর মিলনাকাঙ্ক্ষা গানগুলোর মূল নির্মাণ ভিত্তি। বাংলা গানে প্রিয়তমকে হারানোর ব্যথা ও বিরহ চিরন্তন অভিপ্রায়।

‘আমায় নিয়ে খেললে কেন নিঠুর প্রেমের খেলা / ভালোবেসে আবার কেন কর অবহেলা’ বা যায় যদি যাক বছর শত / তোমায় তবু চাইব ততো / ‘বাড়লে বাড়ুক হৃদয় ক্ষত যাব তোমায় চেয়ে’ বা ‘অশ্রু হয়ে শোক ঝরে যায়/ মেশে সে শোক শ্রাবণ ধারায় / ‘এত জল তবু কেন আমার এ প্রাণ সাহারা’- উপর্যুক্ত পঙক্তিগুলোর ভেতরে বিরহ-বেদনা গগন-স্পর্শ করার মত। আবার যখন বলেন, ‘শ্যামল ছায়াতরুর মতো / নিজকে সাজাও ফুলের মতো / সুবাস ছড়াও অবিরত, ঘুচাও রুদ্র-খরা’- তখন দয়িতার প্রাণ উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে ওঠে গীতিকবির অন্তর-ভুবন।

 

শুদ্ধ সঙ্গীতের আক্রা বা দুর্ভিক্ষের কালে আলাদাভাবে শিষ্ট ও শিল্পসম্মত গান সৃষ্টি সত্যিই আশাব্যঞ্জক ঘটনা। রুচিহীন ও অশ্লীল কথা ও সুরের ভরা প্লাবনের কালে কবি ও গীতিকার সৌপর্ণ মাছুমের ‘সপ্তসুরে নন্দনহার’-এর অর্ধ-শতাধিক প্রমিত গানসমূহ সুধীজনের অন্তরে সুধার সিঞ্চনে ভরিয়ে তুলুক এই কামনা করি।”

 

২০২০ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার তৃতীয় বই ‘জোছনাপত্রে ভেজানো শ্লোক’। এটি আমার রচিত একটি কবিতার বই । এই বইয়ের ভূমিকায় আমার শিক্ষাগুরু কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শোয়েব শাহরিয়ার লিখেছেন :

“এ-যেন রীতিমত কক্ষচ্যুতি, একজন বিজ্ঞান-শিক্ষক, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, তিনি কবিতার রসঘন মৌতাতে সিঞ্চিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন বাগদেবীর চরণ- আশির্বচনে, আঠেরোতে বের করলেন সুষমাস্নাত গীতি-কবিতার সংকলন ‘আদিগন্ত শস্যজলে নিরন্তর বাঁশি’, উনিশে ‘সপ্তসুরে নন্দনহার’, আর এবার (২০২০) প্রকাশ করছেন দ্বিপদী (Couplet) কবিতার নন্দনগুচ্ছ। সৌপর্ণ মাছুমের ধারাবাহিক তৃতীয় প্রকাশনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবনযোগ্য। প্রথমত সাম্প্রতিক ধারার বিজ্ঞান- শিক্ষকদের বাণিজ্যিক লোভাতুর জগত থেকে নিজেকে উদ্ধার করা এবং দ্বিতীয়ত আপন জৈবিক অস্তিত্বকে শিল্পিত তৃণে নির্মাণ করা। শিল্প-সৌকুমার্যের বিষয়টি এখানে বিচার্য নয়।

শুধু প্রণিপাত নয়, এবার অন্দর-গালিচায় রক্তক্ষরণ জরুরী। নইলে মন্ত্র-প্রেষণার শব্দরাখাল হওয়া যাবে না। এর জন্য বিনিদ্র অরণ্যচারী হতে হবে। কখনো ফুটন্ত বালুকার ভাপে ঝলসে যাবে সুশ্রী মুখমণ্ডল, কঙ্করময় অজানা বন্ধুর পথে একাকী বেপথু হতে হবে, ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়-ক্লান্তিতে চেতনাকে আলোকময় করে আপন হৃদয়কে শরবিদ্ধ করতে হবে, মুমূর্ষু অবস্থায় শুশ্রূষার শান্তি অর্জন করা জরুরী ভাবতে হবে। একজন সার্থক কবি হবার এই উৎকৃষ্ট পথ বলে আমার মনে হয়। সৌপর্ণ যদি কবি হিসেবে নির্বাণ পেতে চান তাহলে নিবিড় নিবিষ্ট ধ্যানগ্রস্ততার দ্বিতীয় কোন অবলম্বন নেই।

আমি বিশ্বাস করি, কবির অকৃত্রিম নিষ্ঠা, সাধনা আর নিবেদনে লীন হবার ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করতে আগামী অপেক্ষা করে আছে।”

২০২২ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার চতুর্থ বই ‘কলসে বালির কাঁথা’। এটি আমার রচিত একটি কবিতার বই । এই বইয়ের ভূমিকাও লিখে দিয়েছেন  আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শোয়েব শাহরিয়ার। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন :

“ধীরে ধীরে কবি সৌপর্ণ মাছুম পরিণত পর্বে  পৌঁছে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । নতুন গৃহাঙ্গনে ঝলকানো  আলোর দীপ্তি বাড়াতে গেলে বহু ব্যবহৃত জীর্ণ চেরাগ আর পলতের বদল ঘটাতে হয়, চেরাগের আয়তন,  উপকরণ সামগ্রিও নবকলেবরে সংযুক্ত করতে হয়, এমনকি জ্বালানির পরিমাণ ও গুণগত মানে কোনো ছাড় চলে না। এর নেপথ্যে  ঢের কালব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ও নিঃশব্দ ধ্যান ক্রিয়াশীল থাকে। আমার বিশ্বাস, কবি সৌপর্ণ মাছুম সম্প্রতি ধ্যানমগ্নতার দিকে ঝুঁকছেন, বিশেষত সৃষ্টিশীলতার বাঁক-বদলের চেতনায়।

নিছক প্রকৃতি-প্রেম থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে কবি সৌপর্ণ  এখন বিজ্ঞান মোহনায়, জীবনকে অন্বেষণ করতে নেমেছেন, অনুভবের পরিধি সম্প্রসারণ এখন ওঁর অভীপ্সা, উপলব্ধির অদৃশ্য ও অনুক্ত নিঃশ্বাস ঢেলে ঢেলে সমুদ্রের তল স্পর্শের প্রকল্প এখন ওঁর চিন্তায়, মেধায়। কবি সৌপর্ণ এখন মহাবিস্ফোরণে গতিমান, নেতি- ইলেকট্রনের মতো স্থির অরবিটে নিরন্তর চলিষ্ণু ,আবার  প্রত্ন-পুরাণ বেহুলা-লখিন্দরের প্রতীকায়নে এ-কালের স্বার্থপদী পর্যবেক্ষণেও সিদ্ধহস্ত । কিছুক্ষেত্রে আবার ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানের পরিভাষা ।  যেমন, ব্ল্যাকহোল, ঘটনাদিগন্ত,আকাশগঙ্গা, স্হিতিজড়তা, ল্যাক্রিমাল অ্যাকুয়াস হিউমার, আইরিশ, রোডোপসিন, রেটিনা, সমত্বরণে, ইস্ট্রোজেন, ফ্রুটবডি ইত্যাদি। তবে শ্রুতিস্নিগ্ধ কিছু সমাসবদ্ধ পদও তৈরি করেছেন কবি, প্রিজমপ্রণয়চোখে, কাফনকুয়াশা,রেতঃসান্দ্রতা, চরণদানি, পলিদ্বীপদেশে, শরণছায়া, হরিণকবি, দৃষ্টিশীতলবানে, মাকালহৃদয়, প্যারাসমুদ্র,  স্বপ্নভোজী ইত্যাদি ।

তবে পরবর্তীকালে কবি সৌপর্ণ মাছুম পাঠকের বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে  এমন প্রাত্যহিক বিজ্ঞান বা প্রচলিত বৈজ্ঞানিক টার্ম-কে যদি শিল্পসম্মতভাবে  বিমূর্ত করতে পারেন, তাহলে কবিতার শুভ্রত্ব বাড়বে বৈ কমবে না।

এ-যাত্রায় কবি অধিক অগ্রসরতার প্রতিজ্ঞা ধারণ করেছেন সেকথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ।

সৃষ্টি জগতে কবি সৌপর্ণ মাছুম-এর কলসে বালির কাঁথা-র

সিদ্ধি কামনা করছি ।”

 

 এখন কি লিখছেন ?

এখন গান লিখছি । পাশাপাশি করোনাকালে সুফিদর্শন নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ লেখা শুরু করেছিলাম, সে বইটিও লিখছি। বইটির লেখা প্রায় শেষপর্যায়ে । বইটির নাম দিয়েছি “সুফিভাবের বাস্তব উপলব্ধি”।

 

আপনার লেখালেখির বিষয়বস্তু বা উপজীব্য নিয়ে বলুন।

আমার লেখালেখির বিষয়বস্তু বা উপজীব্য হলো, আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি, বিশ্বাস, প্রকৃতি, প্রেম-বিরহ, বিজ্ঞান, পরাবাস্তবতা, নগরজীবন, সুফিবাদ, মরমিবাদ, দেহতত্ব, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি ।

 

আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই ।

আসন্ন বইমেলার জন্য তিনটি পাণ্ডুলিপি রেডি করেছি । কমপক্ষে একটি বা দুটি বই এবার প্রকাশ করব ।

প্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি :

(১) কাব্যগ্রন্থ : হেরার দ্যুতি

(২) সংগীত  : সুরের আগুন

(৩) শিশুতোষ : বর্ণমালায় ছড়া শিখি

এছাড়াও সময় প্রকাশন থেকে সময় অণুকাব্য সংকলনে আমার লেখা অণুকাব্য এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হবে ।

 

  পাঠকদের থেকে একজন লেখকের প্রত্যাশা কি থাকে ? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কি ?

পাঠকরাই লেখকের প্রাণ । সে পাঠক বর্তমানের বা ভবিষ্যতের । বর্তমানের পাঠকরা যদি লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা বা মন্তব্য করে তবে লেখকেরা অনুপ্রাণিত হন । তাই পাঠকদের থেকে একজন লেখকের প্রত্যাশা থাকে, তারা যেন লেখকের বই কিনে পড়েন আর লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা বা মন্তব্য করেন । আর পাঠকদের কাছে একজন লেখক হিসাবে আমার প্রত্যাশা হলো নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়ান । একজন সৎ কবি অবশ্যই সার্থক দুরূহতার আশ্রয় নিবেন । তার এ দুরূহতার ব্যূহ ভেদ করে অমৃতের রসাচ্ছাদন করতে হলে পাঠককে অবশ্যই  জ্ঞানমার্গের ক্রমিক সোপান অগ্রসর হতে হবে । কারণ দুরূহতা আধুনিক যুগমানসেরই প্রতিবিম্ব । ইংরেজ কবি ও সমালোচক স্টিফেন স্পেন্ডার এই দুরূহতার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বহির্জগৎ যতই আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা হারিয়ে-হারিয়ে নিষ্ফলা মরুর রূপ ধারণ করছে কবিও ততই তার থেকে নিজেকে আলাদা ক’রে নিয়ে এক অন্তর্লীন ধ্যানরাজ্য সৃষ্টি করেছেন।

“The result of that excessive outwardness of ‘a spiritually barren external world’ is the ‘excessive inwardness’ of poets who prefer losing themselves within themselves to losing themselves outside themselves in external reality.”

(Stephen Spender, The Creative Element, p. 21)

বহির্জগতের চেতনা অন্তরের পটে ফোটাবার জন্য বা বহির্জগৎ থেকে পলায়ন করবার জন্য- যে-কারণেই হোক না কেন তিনি অন্তর্দৃষ্টির আশ্রয় নেন। যতই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি সম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট হ’য়ে ওঠে ততই তিনি বিশেষ ভাষা, শৈলী ও প্রতীক ব্যবহার করেন। পাঠকগোষ্ঠীর কাছে তা অনিবার্যভাবে নতুন ঠেকে-তথা দুরূহ।

এ কারণে পঞ্চপাণ্ডব কবি সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্যে কবির উপরে দোষারোপ অন্যায়।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, “কাব্যের মুক্তি”, ‘স্বগত’, পৃষ্ঠা ৩৬)

 

প্রকাশকদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য চাই।

প্রত্যেক প্রকাশকদের উচিত প্রতি বইমেলায় প্রকাশনার খরচে নতুন লেখক বা কবিদের মানসম্পন্ন কিছু বই প্রকাশ করা । তাহলে নতুন লেখক বা কবিরা অনুপ্রাণিত হবেন ।

 

কবি বা লেখকের কি স্বীকৃতি প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন ?

দেখুন, কবি বা লেখকের কোনো স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে- আমি তা মনে করি না । প্রমথ চৌধুরী তার সাহিত্যে খেলা প্রবন্ধে বলেছেন :

“আমরা যদি একবার সাহস করে কেবলমাত্র খেলা করবার জন্য সাহিত্যজগতে প্রবেশ করি, তা হলে নির্বিবাদে সে জগতের রাজা-রাজড়ার দলে মিশে যাব। কোনোরূপ উচ্চ আশা নিয়ে সে ক্ষেত্রে উপস্থিত হলেই নিম্নশ্রেণীতে পড়ে যেতে হবে।………….মানুষের দেহমনের সকলপ্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যহীন। মানুষে যখন খেলা করে, তখন সে এক আনন্দ ব্যতীত অপর কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষা রাখে না। যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরিপাওনার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, জুয়াখেলা। ও ব্যাপার সাহিত্যে চলে না, কেননা ধর্মত জুয়াখেলা লক্ষ্মীপূজার অঙ্গ, সরস্বতীপূজার নয়। এবং যেহেতু খেলার আনন্দ নিরর্থক অর্থাৎ অর্থগত নয়, সে কারণ তা কারো নিজস্ব হতে পারে না। এ আনন্দে সকলেরই অধিকার সমান।………যে লেখক সাহিত্যক্ষেত্রে ফলের চাষ করতে ব্রতী হন, যিনি কোনোরূপ কার্য-উদ্ধারের অভিপ্রায়ে লেখনী ধারণ করেন, তিনি গীতের মর্মও বোঝেন না, গীতার ধর্মও বোঝেন না। কেননা খেলা হচ্ছে জীবজগতে একমাত্র নিষ্কাম কর্ম, অতএব মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়। স্বয়ং ভগবান বলেছেন, যদিচ তাঁর কোনোই অভাব নেই তবুও তিনি এই বিশ্ব সৃজন করেছেন, অর্থাৎ সৃষ্টি তাঁর লীলামাত্র। কবির সৃষ্টিও এই বিশ্বসৃষ্টির অনুরূপ, সে সৃজনের মূলে কোনো অভাব দূর করবার অভিপ্রায় নেই—সে সৃষ্টির মূল অন্তরাত্মার স্ফূর্তি এবং তার ফুল আনন্দ। এক কথায় সাহিত্যসৃষ্টি জীবাত্মার লীলামাত্র, এবং সে লীলা বিশ্বলীলার অন্তর্ভূত; কেননা জীবাত্মা পরমাত্মার অঙ্গ এবং অংশ।

 

সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়। এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্যে খেলনা তৈরি করতে বসেন। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে, তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়। কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের চুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রাঙা লাঠি, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল, নীতির টিনের ভেঁপু এবং ধর্মের জয়ঢাক- এই-সব জিনিসে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে। সাহিত্যরাজ্যে খেলনা পেয়ে পাঠকের মনস্তুষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা গড়ে লেখকের মনস্তুষ্টি হতে পারে না। কারণ পাঠকসমাজ যে-খেলনা আজ আদর করে, কাল সেটিকে ভেঙে ফেলে—সে প্রাচ্যই হোক আর পাশ্চাত্যই হোক, কাশীরই হোক আর জর্মানিরই হোক, দুদিন ধরে তা কারো মনোরঞ্জন করতে পারে না। আমি জানি যে, পাঠকসমাজকে আনন্দ দিতে গেলে তাঁরা প্রায়শই বেদনাবোধ করে থাকেন। কিন্তু এতে ভয় পাবার কিছুই নেই; কেননা কাব্যজগতে যার নাম আনন্দ, তারই নাম বেদনা।…………এ যুগে পাঠক হচ্ছে জনসাধারণ, সুতরাং তাঁদের মনোরঞ্জন করতে হলে আমাদের অতি সস্তা খেলনা গড়তে হবে, নইলে তা বাজারে কাটবে না। এবং সস্তা করার অর্থ খেলো করা। বৈশ্য লেখকের পক্ষেই শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সংগত। অতএব সাহিত্যে আর যাই কর-না-কেন, পাঠকসমাজের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টা কোরো না।”

তাই আমার মতে একজন লেখক বা কবির প্রতিষ্ঠা লাভের চেয়ে মৌলিক সৃষ্টিকর্মে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত । নিজের লেখার উপর আত্মবিশ্বাস থাকলে জীবদ্দশায় না হলে মৃত্যুর পরও একজন লেখক বা কবি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে । পঞ্চপাণ্ডব কবি জীবনানন্দ দাশ তার অনন্য উদাহরণ । আর লেখালেখি করলেই যে স্বীকৃতি বা পেতে হবে ব্যাপারটি এমনও নয় । একজন লেখক বা কবি লেখালেখির মাধ্যমে বিমল আনন্দ আর যে প্রশান্তি লাভ করেন, প্রতিষ্ঠালাভ বা স্বীকৃতি পাওয়ার চেয়ে তা কম কিসে ? আর আমি বিশ্বাস করি :

যুগে যুগে কবিরাই হয় যুগ অবতার

যাবে কবি, রয়ে যাবে শাশ্বত বাণী তাঁর !

 

 লোকে বলে কবিরা ভাতে মরে- এ নিয়ে কিছু বলুন ।

দেখুন, কবি হওয়াটা কোনো পেশা নয় যে, তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। কবিত্ব হলো একটি বিরল প্রতিভা যা হৃদয়রাজ্যকে বিমল আনন্দে সুশোভিত করে । কবি হতে হলে সন্ন্যাসী হতে হবে, জগত সংসারে কোনো কাজ করা যাবে না, ব্যাপারটি এমন নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনা করেছেন, উদ্যোক্তা ছিলেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, পল্লীকবি জসীম উদদীন সরকারি তথ্য ও প্রচার বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন, মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একজন আইনজীবী ছিলেন ।

পঞ্চপাণ্ডব কবি অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। এরপর তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার হাওয়ার্ড, বস্টন ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্যে অধ্যাপনা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কবি ইয়েটস, জর্জ বার্নাড’শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্টফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পান্তেরনাক, পাবলো কাসালস্ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য লেখকদের সঙ্গে তাঁর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। প্রায় সব ক’টি মহাদেশের অসংখ্য দেশে নানাবিধ কর্মসূত্রে তিনি ভ্রমণ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন।

বিষ্ণু দে ছিলেন পঞ্চপাণ্ডব কবির একজন । তিনিও ছিলেন একজন অধ্যাপক । পঞ্চপাণ্ডব কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিখ্যাত পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক ও একজন অধ্যাপক ।

পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম কবি, বাংলা সাহিত্য সমালোচনার দিকপাল, বিখ্যাত কবিতা পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক

কবি বুদ্ধদেব বসুও ছিলেন একজন অধ্যাপক । পঞ্চপাণ্ডবের একজন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন ।

কবি সিকান্দার আবু জাফর পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন, কবি আহসান হাবীব সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, কবি শামসুর রাহমান সাংবাদিক ছিলেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ সাংবাদিক ছিলেন, কবি কামাল  চৌধুরী সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন । বর্তমানে দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি ইমতিয়াজ মাহমুদও একজন বিসিএস ক্যাডার ।

উত্তরাধুনিক যুগে কবিরা কবিতা লেখার পাশাপাশি যোগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন রকম কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলে, তার অর্জিত অভিজ্ঞতা কবিতাজগতকে আরো বিষয়বৈচিত্র্যে ও সমৃদ্ধ করবে । সুতরাং আমরা বলতে পারি ‘কবিরা ভাতে মরে’ এটি হাস্যকর ও বাস্তবতা বর্জিত একটি কথার কথা ।

 

একজন লেখক কবির জন্য পড়াশোনা (সাহিত্য পাঠ) কতটুকু জরুরী ?

নতুন কিছু লিখতে না পারাটাতেই একজন কবি বা লেখকের প্রকৃত মৃত্যু নিহিত। লেখার পুনরাবৃত্তি বা চর্বিতচর্বন না করাটাই একজন কবি বা লেখকের প্রকৃত বেঁচে থাকা । আর লেখার এই পুনরাবৃত্তি বা চর্বিতচর্বন রোধ করার জন্য পড়াশোনা বা সাহিত্য পাঠের কোনো বিকল্প নেই । তাই একজন লেখক কবির জন্য নিয়মিত এবং প্রচুর পড়াশোনা বা সাহিত্য পাঠ করা একান্ত প্রয়োজন ।

 

নিজের লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা জানতে চাই।

পাঠে কাব্যরস পায় ছন্দের গতি আর শ্রবণে গীতরস পায় সুরের মূর্ছনা। তাই সঙ্গীতকে বলা হয় স্বর্গলোকের অমৃত আর মর্তলোকের ইন্দ্রজাল। সুরের এই ইন্দ্রজালে যে প্রাণশক্তির জোয়ার সৃষ্টি হয়, তার হিল্লোল হৃদয়কে দোলা দেয়। সঙ্গীতের রাগ-রাগিণী ধীরে ধীরে শ্রোতার মর্মে প্রবেশ করে যে বিচিত্র অনুরণন তৈরি করে, তা হৃদয়ের আবেগকে নিংড়ায়ে বের করে, ফলে তা সংক্রামিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। সরস্বতীর বীণায় যারা সপ্তসুরে নন্দনহার কণ্ঠে ধারণ করেন সঙ্গীতের লয়, সংযমের শুচিতা ও প্রাণশক্তি প্রদান করে তাদের হৃদয়কে নবরূপে বিকশিত করে। সঙ্গীতের সুরলহরী হৃদয়ের সূক্ষ্ম আবেগকে জাগ্রত করে মৃতপ্রায় হৃদয়কে সঞ্জীবিত করে তোলে । সংগীতের এই মোহিনী শক্তির কারণে আমার ইচ্ছা কবিতা লেখার পাশাপাশি হাজার খানিক গান লিখে যাওয়া । অবশ্য এ পর্যন্ত আমি প্রায় আড়াই শত গান রচনা করেছি এবং নিয়মিতভাবে নতুন নতুন বিষয়ে গান লিখে চলছি । আর প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা সম্পর্কে বলবো :

“কবিতা-প্রেমিক কেবল সৌভাগ্যবানরাই হতে পারে। কাব্যসুধা গ্রহণ করে ঊষর-হৃদয়ক্ষেত্র শ্যামল করার প্রয়াস মানব জন্মে ক’জনই বা পায় !

কাব্যচর্চায় নিবেদিত কাব্যকার অনেকেই তো আছেন কিন্তু কাব্যলক্ষ্মীর সাক্ষাৎ পান ক’জন! কাব্যলক্ষ্মীর নিরুপম সঞ্জীবনী শক্তি হৃদয়চারিণী মূর্তরূপে সতত কবির জীবনধারায়, চেতন ও অবচেতন মনে সারথিসম সবার অগোচরে পলে পলে বিচরণ করে ।

যশ-খ্যাতি ও প্রাপ্তির মোহজাল ছিন্ন করে চাতকের ন্যায় কাব্যলক্ষ্মীর প্রতীক্ষায় না হয় জন্মান্তরের এবারকার জন্মটা নির্বাণসুখে সমর্পণ করলাম !”

 

যারা লিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন ।

যারা লিখতে চান তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, লেখার পূর্বশর্ত হলো প্রচুর পড়াশোনা করা । একজন কবিকে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, নজরুলের সঞ্চিতা, সুকান্ত, আল্লামা ইকবাল, মির্জা গালিব, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, শেখ সাদী, রুমি পড়তে হবে। বারবার পড়তে হবে জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাসমগ্র । বর্তমানে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ-এর কবিতাসমূহ পাঠ করতে হবে । আধুনিক কবিতার স্বরূপ বুঝতে হলে দীপ্তি ত্রিপাঠীর লেখা “আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়” গবেষণাগ্রন্থটি প্রত্যেক কবিরই আবশ্যিকভাবে পড়া উচিত ।

*সৌপর্ণ মাছুম: শিক্ষক আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ নিশিন্দারা, উপশহর, বগুড়া, বাংলাদেশ । 

 

আরো পড়ুন- গীতিকবি জহুর কবিরের সাক্ষাৎকার