হেলাল সালাহউদ্দীনের কবিতা
বিহ্বল করো আরও
বিড়ালাক্ষীর মতো আঁখি, আশ্বিনের নদী-প্রমত্ত ঢেউয়ের ভাজে ভাজে প্রেমের বুনন;
এতো গভীরে থাকো হে চতুর্দশ নক্ষত্রী?
শস্যফুলের হলুদ খেত, তোমার সবুজ বুকে বিছানা পেতে ডাকে!
বিদ্যুৎ হরিণী এসে ধুয়ে দেয় হৃদয় ফেড়ে রক্ত ক্ষরণ;
অকালে অবিরল বর্ষা, বর্শাধারী প্রেমিকার নিশানায় ধরাশায়ী।
খলখল করে বইছে বন্যা হে অনন্যা মিহিন শরীরে;
চঞ্চল আনন্দ তুমি, ডানায় ঝড় এঁকে উড়ছো দোলনচাঁপায়;
অনতিক্রম্য তৃষ্ণায় কাঁপছে আঙুলগুলো।
ত্রিকাল ফুঁড়ে সময়কাল উড়ে উড়ে দূরের কোনো তীর্থযজ্ঞে-
নিষ্পলক দেখার মতো অলৌকিক চোখে,- বজ্র উৎসব!
শরৎ ভেজা তন্বী রাত, রক্তজবা ওষ্ঠে মাখে আঁধার;
মন্ত্রে কী জাদু তোমার! মুহূর্তে সমস্ত বিষ নাশ করো হে অমৃতা অনন্তকালের।
ক্ষয় এবং খরস্রোতা
আলোআঁধারির গভীর সে ভাষা পার হয়ে, ফেরা হয় না আর তীব্রতর কাছাকাছি তোমার; আশ্বিনের স্তব্ধ রাতের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে অতলান্তিক ঢেউ! অভিমানজড়ানো পথ বেয়ে গোপন শিহরণগুলো অযথাই কেনো ফিরে আসে?
পাঁজরে চিনচিনে ব্যথার দমকে, অস্থির উপত্যকাজুড়ে বিষম ক্লান্ত জবুথবু, মোমের মতো গলে গলে প্রাণ- পোড়ায় আয়ুর ছাই! অনিঃশেষ মায়ার কারাগারে মুষড়ে- ঘাই মারে অনাগত ইতিহাস।
অনির্বচনীয় উপশম এ আমার! অথই নীরবতাচূর্ণ থতমত নৈঃশব্দ্যের কোমলে, বাড়ন্ত সময়ের দিনলিপি আরও দীর্ঘতর, আরও প্রগাঢ়? অবাক জলসায় তুরীয় স্বপ্নভষ্মের ভীড়ে ধীরে একা মুছে যায় প্রেমকাতর কোকিল!
ঊর্ধমুখী হাহাকারে বিলাপ এবং করুণ বিরহে; নতুন বিবাহের সানাই- ভবিষ্যের নিশ্চিহ্ন মগনে এঁকে দেয় দীঘল দীর্ঘশ্বাস।
ভ্রমণ শেষে
ভালোবেসে গলে যেতে ইচ্ছে করে, বৃষ্টির মতো মানুষের দীঘল সবুজ বুকে, পৃথিবীর প্রথম ভোর দেখেনি কোনো মানুষ!
প্রাণী থেকে মানুষ আলাদা করেছে প্রগাঢ় দুঃখ দুপুর,
অরণ্যই মানুষের আবাসস্থল, শিখেছে সে বিস্মিত হতে; বিহ্বল রাতের মায়াবী দ্বীপে-
একা কেউ জৈবজের ওপারে জেগেছে সারারাত।
প্রথম কবিতা গর্ভে নিয়ে বেভুল শরীর হয়েছে শ্বাপদের খাবার!
অমিত কৌতূহলের তেজে, সে দিয়েছে নাম, নিবিড় উত্তাপে দেখেছে ঋতুচক্র, অবিরাম ঘূর্ণন, শোভা দেখতে দেখতে হয়েছে শেষ।
অনুধ্যানে প্রত্যক্ষণে রেখে গেছে অভিজ্ঞতা ফুল, সুমুখের অনির্দিষ্ট পথ; অবিরাম উৎসের দিকে মানুষের পরম্পরা-
অজস্র সাধনা, কারুবাসনায় ডুবে, ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে! তবু সৌন্দর্যে শিল্পে প্রকৌশলে গড়ে নিয়ে সুরম্য পথ।
এই গ্রহ চিরঘুমের দেশে শান্ত হয়ে যাবে! মানুষের ভ্রমণ ফুরাবে না, উড়ে যাবে সশরীরে শূন্যের পাড়ায়- অন্য কোথাও।
ভোগে নিরাপত্তা- প্রতাপে : সার্বভৌম শক্তিও হয় চূর্ণ, নিশ্ছিদ্র বাসরেও ঢুকে পড়ে সাপ।
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, মানুষ ধ্বংস হবে না কোনোদিন।
মানুষের ভ্রমণ নক্ষত্র হতে নক্ষত্রে, আকাশের পাড়ায় পাড়ায়; রূপান্তরের নিগূঢ় রাতের পরও- থাকে বিরল জাতিস্মর!
ছাঁচে ঢুকে নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায়ও, মানুষ কেবল সাড়ম্বরে দুঃখ কেনে।
আজও যাঁরা কষ্টে, বিষম অসমতায়- মেনে নিয়েছে জীবনের সহজ পরাজয়; যুগে যুগে লেখা আছে মানুষের অভিজ্ঞতায়- নৃশংস রক্তের করুণ ইতিহাস!
বিভাজনে বিদ্ধ মানুষের মুখ, পৃথিবীকে বানিয়েছে পাগলাগারদ।
সব মিথ্যা, শুধু সুমুখ যাত্রা সত্য। অনিশ্চিত অভিক্ষেপ, এখানে যুদ্ধ ও লুণ্ঠনের পর- কৌশল, নীতির শৃঙ্খলায়, বিপুল বিশৃঙ্খলা!
ধ্বংস মৃত্যুর মধ্যে, মানবজাহাজ সুমুখের নীলে নিয়ে যাচ্ছে সারেং; একদিন কেউ পৌঁছে দেবে অখণ্ড সুনীলে।
ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়
তারপর ঠগ বাছতে উজাড় হলো সমস্ত গাঁ,
আইন, বিচার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ঠগেদের আস্তানা!
প্রশাসন ও শাসনে শানিত ঠগেরা শকুনের মতো উড়ছে…
যখন দলবদ্ধ শকুন কোনো মৃত গরুর গন্ধ শুকে এসে বসতো তালগাছের পাতায়;
( এ যুগের ছেলেমেয়েরা দেখেনি এ দৃশ্য, তাই বুঝবে না!)
বৃদ্ধ শকুনেরা কেমন দুর্দান্ত ওৎ পেতে থাকে! হঠাৎ লাফাতে লাফাতে এসে সাবাড় করে বীভৎসভাবে।
ছেলেমেয়েরা শোনো, এখন এতো বিচিত্র শকুনের ভীড়ে- আসল শকুন আর আসে না।
ঠগে ঠনঠন করবে রূপকথার এক দেশ,
সমস্ত দেশটাকে কারাগার করে হোক ঠগ নিধন প্রক্রিয়া!
শিক্ষক কারাগারে পাঠ বিতরণ করুক,
বিচারক কারাগারের এজলাসে বসে করুক বিচার,
মন্ত্রী, সচিবেরা কারাগারে শুয়ে শুদ্ধি অভিযান চালাক,
এ ও সে বাহিনী আবদ্ধ হাতে অন্তরীণে উদ্ধার করুক দেশ,
ব্যবসায়ী কারাগৃহে ভেজাল মিশিয়ে পণ্য বেচুক দেদার,
ধর্ম, নীতি ও তন্ত্রের কবচ ঝুলিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের তরবারি ঘুরাক সকলে!
গণমাধ্যম ও সাংবাদিক বেড়ি পরে লাইভ দেখাক এইসব;
বুদ্ধিজীবী সেলে শুয়ে টিভির নব ঘুরাক।
কৃষক, শ্রমিক কেবল বাইরে থাকুক,
প্রাণান্ত পরিশ্রমে পৃথিবীকে সচল রাখুক ওঁরা।
একমাত্র পাগল ও সমাধিস্থ সাধক ছাড়া- এই ঠগ তরঙ্গে সকলেই ভেসে যায়।
একজন পাগল প্রকৌশলীর প্রচেষ্টা
ব্রিজগুলো ভেঙে পড়ছে মচমচ করে,
শব্দহীন জানালায় মেঘ ভেঙে পড়ছে,
পাগুলো দুমড়েমুচড়ে গেঁথে যাচ্ছে মাটির মধ্যে,
চোখ ভেঙে নামছে অশ্রুহীন ধাতব কান্না!
প্রীতির কাঁচের কাকন ভেঙে ফিনকি দিয়ে গড়াচ্ছে খুন।
ভাঙা আকাশের আড়াল থেকে দেখা যায়- আরেক আকাশের ভাঙন;
নক্ষত্রের ভেঙে পড়া কণা নিয়ে তোমাকে দেবে বলে-
আহ্লাদে ভেঙে পড়ে ছুটলো মতিয়ার….
তখন বিয়ে ভাঙার বাজ পড়েছে মাথায়!
জুয়ার টেবিল ভেঙে গেছে, ঝাড়বাতি, চরকাও;
একজন পাগল তবুও ভোলামনে,
ভাঙাহৃদয় জোড়া দেবে বলে- টুকরোগুলো খুঁজছে আনমনে বেভুল।
যে গোলাপ দেখে না কেউ
আর কখনো তোমাকে দেখবো না,
কৈশোরের দুপুরগুলো সন্ধ্যা হলো-
রাতের রণাঙ্গনে বিক্ষত বাসনা,
ভোর না হতেই শিশির হবে; গলে যাবে-
শুধু তোমাকে আর দেখা যাবে না!
কতো ছবির ভিড়ে থাকিয়ে থাকি,
কোনো রং এসে লাগে না চোখে;
হঠাৎ ভুলে যেতে যেতে কেনো আসো?
মন্থর হেঁটে যাও আল বেয়ে বেয়ে-
বন্ধ্যা গোলাপের কাটা ভেঙে যায়,
রুধির হৃদয়ে তখন অপরূপ ফোটে-
ব্যথার গোলাপ নীলাভ নির্জনে।
নভে শারদরাকা নাচে
ডহরভরা শালুক আঁকছে ছবি-
পাঁপড়িতে পাঁপড়িতে কার বিরল মুখ,
বন্যার্ত চোখে স্ফটিক উদাস;
ঝিল ঝলসে ওঠে বিজলী ইশারায়।
শারদ পৃথিবীতে এতো নীরবতা!
নির্জন তীর্থ : ধূপের মতো উড়ছে প্রেম,
গন্ধে পুড়ছে গোপন অলঙ্কার;
ধবল ছায়া গৌরী শীতল শ্যামল-
ছুঁয়ে ছুঁয়ে থরথর ওষ্ঠে থই থই দহন।
এই নিশি পাশাপাশি মৌন নিমেষ,
পিয়া অঞ্চলে হঠাৎ চঞ্চল মেঘ-
চোখে চোখে লাগে বর্ষার ছাট!
ডহরে ব্যাকুল ডাহুক ডাকে পিয়া পিয়া
কৈলাস ভেঙে নটরাজ কেঁপে ওঠে,
গলছে নীলাভ জ্যোৎস্না : পৃথিবীও-
গলে গলে ওকিন্নর গলে দেবে মালা?
জ্যোৎস্না মদির আকণ্ঠ ভরেছে,
এই সুরভিত রাতও সহসা ফুরোবে।
আরো পড়ুন- সুমি কায়সারের কবিতা