প্রচ্ছদসাক্ষাৎকার

কবি শাহিন চাষীর সাথে কথোপকথন

কেমন আছেন?

জ্বি! সবকিছু মিলে ভালোই আছি।

 

লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?

আমি আসলে কোন আয়োজন করে লিখতে আসিনি। কোনদিন লিখবো, এমন ভাবনাও ছিল না। এখন যতটুকু যা লিখি তাতে নিজেকে লেখক পরিচয় দিতে পারি না… লজ্জা পাই। আসলে আমার জানাশোনা কিংবা পাঠ ও ভাষাবোধ খুব দরিদ্র! তবুও একটা শূন্যতার অনুভব থেকে নিঃসঙ্গতা দূর করতেই একদিন কলম হাতে উঠে আসে। সেই থেকে শূন্যজ্ঞানে এই আট বছর চলছে।

 

প্রকাশিত বইগুলি নিয়ে কিছু বলুন।

এ বিষয়ে গলা উঁচু করে বলার মতো কিছু নেই। এ পর্যন্ত তিনটি কবিতার বই—“প্রতিধ্বনি মনে মনে”, “জোছনায় ধূসর ছায়া”, “জলের বুকে আগুন” প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে ‘জোছনায় ধূসর ছায়া’ মুদ্রণজনিত ত্রুটির কারণে কয়েকটা কপিরাইটের পর বন্ধ করা। সবগুলোই ছিন্নপত্র প্রকাশন থেকে। আর একটা গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্ত বই হবার পর অনুভব করলাম, লেখাগুলোর পরিমার্জন দরকার ছিল! ইচ্ছে আছে, উদীয়মান কথাশিল্পী ডাক্তার মুহিম মুনিরের সহযোগিতা নিয়ে সংশোধন করে আবার প্রিন্ট করবো। মুহিম আমার উপর এক মহৎ ছায়া।

 

এখন কী লিখছেন?

আমি মূলত কবিতা লিখি। অবশ্য  লিরিক, গদ্য লিখতেও চেষ্টা করি। এছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে চেষ্টা করি আর পাশাপাশি হাইকু, তানকা লিখছি। এ ছাড়া স্বরবৃত্তের ছয় মাত্রায় ও ছয় লাইনে ষটকা লেখার চেষ্টা করছি। ষটকা নামকরণ আমার কল্পনাপ্রসূত।

 

আপনার লেখালেখির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাই।

আমি মনে-প্রাণে জীবনের জন্য একটা নিরাপদ ভূমি চাই। তাই যে কোন অনিয়মের বিপক্ষেই আমার অবস্থান। আমার লেখা জীবনের পক্ষে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এছাড়া প্রেম, প্রকৃতি সহ অন্যান্য বিষয়াদিও আমার লেখার উপাদান।

 

আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।

আসছে বইমেলা ২০২৫ নিয়ে তেমন কোন ভাবনা নেই। তবে মেলাতে যাবো একদিন। যশোর থেকে তো আর প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব না। আর এ বইমেলাতে নতুন কোন বই প্রকাশ করার ইচ্ছে নেই। আসলে হুটহাট করে আর বই প্রকাশ করতে চাই না। বই প্রকাশের আগে প্রয়োজনীয় সম্পাদনাসহ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পাঠকের হাতে যাবার আগে লেখা ত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক। আপাতত পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার মতো সময় ও সুযোগ হাতে নেই।

 

পাঠকের থেকে একজন লেখকের কী প্রত্যাশা থাকে? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কী?

সব লেখক হয়তো মনে মনে পাঠকের ঘর ও মন ছুঁতে চান। এটা অস্বাভাবিক কোন বিষয় না। অধিকাংশ লেখক মনে হয় ভাবেন, তিনি ভালো লেখেন। সেই ভাবনা থেকে পাঠকের পাঠ্য হতে কল্পনা করাটা স্বাভাবিক। সব লেখক ভাবেন, পাঠক বেশি বই কিনুক ও পড়ুক। কেউ পাঠকের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা ভাবেন কিনা জানি না। তবে হ্যাঁ, আমি চাই পাঠক বিভিন্ন ধরণের বই পড়ুক। যেহেতু পাঠকই লেখককে বিকশিত করে, লেখককে বাঁচিয়ে রাখে বলে বিশ্বাস করি, সেহেতু চাই, আমাকেও পাঠক একটু পড়ুক, ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলুক। তবে আমি পাঠকের কাছে প্রত্যাশার আগে পাঠকের প্রত্যাশিত হবার পক্ষে।

 

প্রকাশকের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

প্রকাশকের ব্যাপারে কোন কথার আগে বলতে চাই, আমার মতে আমাদের দেশে প্রকাশনা আজও  শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে বেশিরভাগ প্রকাশক ঠিক প্রকাশক হয়ে উঠতে পারছেন না। আমরা দিনদিন পাঠবিমুখ হয়ে পড়ছি যেন! পাঠক বৃদ্ধি পেলে প্রকাশক অর্থলগ্নিতে উৎসাহী হন। আবার এটাও বলা যায়, প্রকাশক ঠিকঠাক প্রকাশক হয়ে উঠলে ভালো মানের বই হতো, পাঠক বৃদ্ধি পেত। আমার অনুরোধ কিংবা প্রস্তাব, সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন ও সম্পাদনা পরিষদ থাক। বই প্রকাশের নামে বই ছাপানো বন্ধ হোক। আমি চাই প্রকাশনাকে শিল্প হিসেবে গড়তে রাষ্ট্র ও বাংলা একাডেমি যথাযথ ভূমিকা রাখুক ও পৃষ্ঠপোষকতা করুক। বোদ্ধা প্রকাশক লেখক ও পাঠক তৈরির অন্যতম সহায়ক।

 

কবি বা লেখকের স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি কিভাবে দেখেন?

যদি মন খুলে সরলভাবে বলি, তাহলে বলবো, স্বীকৃতির দরকার আছে… স্বীকৃতি মানে দায়বদ্ধতা, দায়বদ্ধতা মানে তীক্ষ্ণ সৃষ্টিশীলতা। তবে স্বীকৃতিকে আমি মধ্যমনি, পুরষ্কার এসবে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। আমি চাই রাষ্ট্রের সংস্কৃতি পরিষদ লেখককে জাতির সামনে তুলে ধরতে বা পরিচিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। এমন পদক্ষেপ প্রেরণাদায়ক।

কবি হিসেবে, কেবল কবি কেন– লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপার কবি বা লেখকের ভাবনাতে না থাকা ভালো বলে মনে করি। লেখকের মনে প্রাপ্তির প্রত্যাশার চেয়ে সৃষ্টির নেশা গভীর হলেই ভালো। নিজেকে ভেঙে-গড়ে সমৃদ্ধ করা গেলে প্রতিষ্ঠা পাঠকের হাত ধরে এসেই যায়।

 

কবিতার পাঠক দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন কী?

এটা ঠিক বলে মনে করি না। কবিতা এক রহস্যময়তা নিয়ে সাহিত্যের বনেদি গোত্র। সমাজে গম্ভীর মানুষের আশেপাশে সাধারণের ভিড় কম থাকে– তবে যারা থাকার তারা ঠিকই থাকেন। কবিতার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমন। তবে কবিতাকে কেবল শিল্পের অজুহাতে সহজে গভীর করা গেলে পাঠকের সংখ্যা আরও বাড়তো। আমার মনে হয়, কবিতায় শিল্প বা রহস্য থাক তবে তা দুর্ভেদ্য না হোক।

 

লোকে বলে, কবিরা ভাতে মরে– এ বিষয়ে কিছু বলুন।

আমাদের প্রেক্ষাপটে কেবল কবি নয়, বলতে গেলে সব লেখকের জন্যই কথাটা ঠিক। পেশা হিসেবে কবিতা বা লেখালেখি বেছে নেওয়ার পরিবেশ আমরা আজও তৈরি করতে পারিনি। এর অনেক কারণ যা অল্পে বলা যায় না। শুধু একপাশ থেকে বলি– আমাদের পাঠের অভ্যাস খুব কম। আমরা বই কেনার চেয়ে আরকিছু কেনাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বই বিক্রি না হলে লেখকের ঘরে খাবার আসার কথা না। হাতে গোনা কিছু কবি-লেখক বাদ দিলে সবার জন্য কথাটা সমানভাবে প্রযোজ্য। হয়তো সে কারণে জীবনের জন্য অন্য পেশা  করে অবসরে বা সুযোগ করে লেখক লিখছেন যা ঠিক বলিষ্ঠ লেখক তৈরির অন্তরায়।

 

একজন কবি বা লেখকের জন্য পড়াশোনা (সাহিত্যপাঠ ) কতটুকু জরুরী?

খুব জরুরী। তবে কেবল সাহিত্য নয়, লিখতে হলে সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রকৃতি এমন আরো অনেক বিষয় পড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তবে পাঠের পাশাপাশি বোধের চর্চাও অধিক জরুরী। ভাবনা বা বোধের চর্চা সৃষ্টির সহায়ক। আমি সবসময় ভাবনা ও বোধের চর্চাকে বড় মনে করি। ভাবনা না এলে আপেল হয় মাটিতে পচতো, নয় পাকস্থলীতে হজম হতো– মহাকর্ষের রহস্য উদঘাটিত হতো না।

 

নিজের লেখালেখি নিয়ে কিছু বলুন।

বলার মতো তেমন কিছু নেই। মূলত, নিঃসঙ্গতা দূর করতেই খেয়ালের বশে এই ২০১৬ সালের দিকে, বুড়ো বয়সে কলম ধরি। আমার পুঁজি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। লিখতে লিখতে যতটুকু যা শেখা। সাহিত্য খুব উঁচু একটা বিষয়। আমি আসলে সাহিত্য করার জন্য লিখতে শুরু করিনি, কেবল নিঃসঙ্গতা দূর করতে চেয়েছিলাম। এখনও তাই করি। এভাবে কিছু পড়ে, কিছু শিখে একটু লিখে সময় যাচ্ছে।

 

যাঁরা লিখতে চান, তাঁদের জন্য কিছু বলুন।

আমি আসলে কিছু বলার মতো উপযুক্ত নিজেকে মনে করি না। তবুও বলি, লিখতে আসার আগে প্রচুর পড়ুন, বুঝুন– পরিণত হতে চেষ্টা করুন। তবে এটাও মনে রাখা দরকার– পরিণত হয়ে কেউ জন্মে না, যথাযথ চর্চা পরিণত করে। আর লিখতে গিয়ে নিজেকে বারবার ভাঙতে চেষ্টা করুন– নিজেকে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করতে চেষ্টা করুন আর লেখাতে শিকড়ের ঘ্রাণটুকু যেন থাকে। অস্তিত্বকে ছেঁটে ফেললে পরিচয় হারিয়ে যায়।

 

আরও পড়ুন- কবি সৌপর্ণ মাছূমের সাক্ষাৎকার