একগুচ্ছ কবিতা- বদরুজ্জামান আলমগীর
বৃষ্টিঝিম একরাত
সব মানুষই চন্দন কাঠ, উনুনে আগুনের মূল
নক্ষত্রের মত মানুষও জ্বলে, আলো ধরে
মিনাবাজার ঝকমক, সাইকেলের চাকায় ভুল।
বয়সের বেড়িবাঁধগুলো পেরিয়ে আনপাড়ে জ্যাম
একের পর এক বালিয়াড়ি, বদ্বীপ, বালুচর
আর পরাণ উচ্ছলিয়া ভুতগাছ নদীর টোটেম।
দেখা হবার মোচড়গুলো জংধরা চাবির গোছা
ছক্কার ছয় ও পাঁচ, বাঘের মুখে শিশুর প্রথম হাঁটা
ঘর নাই তবু পায়ের দাগগুলি রয়ে রয়ে মোছা।
দরজা খুলতেই তিনসন্ধ্যা আর ঢালুর চোরাবালি
শিউরে ওঠা ধূসর ও খয়েরি নকশিকাঁথার ফোঁড়
দুধের সরে বসা একলা মাছির নিশিপাওয়া কালিঝুলি।
ফুটে আছে কখন হাওয়ার ঘরে বৃষ্টিঝিম এক রাত
কিছু বুঝে ওঠা, না-ওঠার মাঝখানে নীল জংশনে
তোমাকে খুঁজে পাওয়া আর হারানোর বসন্ত সংঘাত।।
সেলাই করা সংসারে
মেটে রঙের বাইরে ফাটা বিচ্ছুরণে কোথায় কী রঙ
দূর নক্ষত্র ধোঁয়া ধোঁয়া, আগুন না জ্বলা উনুনের
বুক নিথর, অনাদি কালের মেঘলা ছায়া ছায়া
অপু খয়েরি, খয়েরি দুর্গার জোড়া ভৈরবী চোখ
রবিশঙ্করের প্রাণমোচর সেতারে ফোটে মেঘবতী টঙ্কার
মরচেপড়া জলের রেখায় ওপারে ছানিপড়া ঘন্টাধ্বনি
বেড়ার পাশে একলা তুলসিগাছের মাথায় মায়ার ছিটা
দুর্গার বয়ঃসন্ধি দোটানায় দোলে পথের পাঁচালী সংসার
স্বপ্নের একফোঁটা আগুন নির্বিকার তামাকপাতায় জ্বলে
শীতের সমুখে ছেঁড়া কাঁথায় সেলাই তুলবে বলে
ইন্দির ঠাকুরুন সুই ছিদ্রে যেই না সুতোটি পার করে
ছলকে ওঠা হাসির বিভায় আমাদের বসন্তকাল আসে।।
আত্মার ফাটল
পাথর এতোটাই পাথর বৃষ্টির ফোঁটা যতোটা কোমল
কাউকে না জানিয়ে কালের অতীত নড়ে ওঠে সে
গভীর মৃত পাথর এক জীবনের ইশকুলে পাশ ফেরে
যখনই সে সমাধি লাভ করে, দুগ্ধময় স্তনের অন্বেষায়
সরবতা আর নৈঃশব্দ্যের বারজাক লুপ্ত হয়ে যায়।
কালের কল্লোলে কে তুমি উড়িয়েছো স্মৃতি সত্তার ছাই
জীবনের অধিক ভিন সন্তাপে রুয়েছো রক্তের নুন
আবছায়ায় গুমরে কাঁদে মরচেপড়া বেহুলা আমার
মরীচিকার ফাটলে দাঁড়াও, বাজাও শঙখখানি তোমার।
আকাশ থেকে ছলকে নামে ছেঁড়া বিদ্যুতের ছিন্ন বাকল
কঠিনে কোমল অঙ্কুরে ফোটে তোমার আত্মার ফাটল।।
উপকথার সবজি বাগান
ধূলা কীর্তনের দিন আগুন সংহারের ঋণ
ঝাড়পোছ করে ডেকে আনি
দেড় সহস্র বছরের পুরনো হালখাতা নীতিশাস্ত্র
খুলে দেখি- টগবগ ফুটছে উপকথার আপেল।
সেখানে আগুনের নাম নূর
নূর নূর বলে গরুর কাঁচা দুধে ফেরেশতার মুখ ধোয়
সেই তল্লাটে একজাতি আছে- খান্দান বংশ জ্ঞাতি
সে নূরের জেল্লা জাতির নাম জিনের জাতি।
মানুষ আদমের বালবাচ্চা- শোকতাপ, জ্বর জারি
লেগেই থাকে তাদের সকাল সন্ধ্যা
সর্দিকাশি ছেঁড়া শার্ট, একটু বয়েস হতে না হতেই
চোখে পড়ে ছানি, গতি বলতে রীতিমত নেই
প্রতিবন্ধী তারা, মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ধান গম সবজি লাগায়।
অপর পাড়ে, পাটিগণিত জ্যামিতি ছাড়াই
মুখে মুখে হাতের কড়ায় হিসাব কষে দেখুন
জিনের সম্মানের কাছে মানুষ ও মানুষতত্ত্ব ছাড়
কানাকড়ি মূল্য নেই, নস্যি, আলোর গতির কাছে
আহাম্মক, কাম ঘাম, তামাটে জলের পাক।
তাজ্জব, কী যে আচানক- মাটির মানুষ অরক্ষিত
মরলেই গলে যায় এতোটা নাজুক,
তবু আগুনের জিন, কোটি খান্দানের প্রতাপে সঙ্গীন
নেহায়েত আদম, খুদকুঁড়া মানুষের কাছে আসে
ঘুরে ঘুরে তার উপর আছর করে।
মানুষ দুঃখ পাবার আটপৌরে ক্ষমতা রোদে জলে
ভিজতে ও শুকাতে দেয়, সবজি ক্ষেত নিড়ানোয় বসে,
নূরের তীরন্দাজ জিন, উচ্চতর প্রশাসন ও শ্রেণী
কী আজব তাজ্জব ব্যাপার- লক্ষ বছর ধরে এমন
কাদামাটির গড়ন জবুথবু মানুষের কাছে আসে।।
প্রজাপতি রীতি
আজকাল এরকম হচ্ছে হরহামেশাই
সত্যিই হচ্ছে এমন
ভাবছি আমি আকাশ সামিয়ানা হয়ে
দিব্যি ঝুলে আছি
আর আকাশ আমার নিচ দিয়ে ছায়ার
অধিকারে হেঁটে যাচ্ছে আনমনা।
ফুল হাতে কাঁটাবন মোড় থেকে
হেঁটে যায় উদ্বাহু প্রেমিক
ফুলের বদলে সে-কি হাতের সংগোপনে
নিয়ে যাচ্ছে এক কাটা রাইফেল?
সংসদে বিল উত্থাপন করছেন অতি দূর
বিল পাড় থেকে উঠে আসা জনপ্রতিনিধি
ভেতরে ভেতরে তিনি সংসদের আসনে নেই
সুতী কাপড়ের বদলে লোহার বর্ম পরে
নিজ দেশের সীমা ছাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছেন তিনি।
আকাশের ঠিক হাতের নিচে
বীজধান ছিটাতে ছিটাতে যাচ্ছে হেলিকপ্টার
বীজধান কোথায়- এরা সব শূন্য থেকে
ছিটকে এসে মাটিতে পড়া নুড়ি, পাথর কণা।
বাতাসে ডুবতে ডুবতে ভাবি-
এতো বছর পরও জুয়াং জু’র স্বপ্ন আছে
আগের মতই যেই কী সেই
চোখের মণি আর কাঁকর বিছানো সরু পথ
গড়াতে গড়াতে কোন দিকে যে গেল!
পুরনো তাও রীতি আজও স্বপ্নের কথা বলে
জুয়াং জু স্বপ্নে প্রজাপতি হয়ে ওড়ে
প্রজাপতি স্বপ্নে দ্যাখে-
জুয়াং জু বেশে সে আকাশে চমকায়, ঘোরে!
আরও পড়ুন- সৌপর্ণ মাছুমের কবিতা