কবি অনন্ত পৃথ্বীরাজের সাক্ষাৎকার
এ দেশের গণমানুষের জন্যেই লিখি
কেমন আছেন ?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : জ্বি ভালো আছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হয়েছিল ?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : আসলে লেখালেখি শুরুর প্রসঙ্গটি আমার কাছে একটি গল্পের মতো। প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। আমি তখন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলাধীন ধরইল সরকারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। তখন বিদ্যালয়ের নিয়মিত বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। এমনি এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম নিজের লেখা একটি ছড়া-কবিতা পাঠ করে পুরস্কার পেয়েছিলাম। লেখালেখির মঞ্চে সেটাই ছিল আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ। আমার গ্রামে ছকির আলী নামে এক বাউল সাধক ছিলেন। তিনি নিজে গান লিখতেন, সুর করে গাইতেন। তার কাছে শিখেছি লেখালেখির করণকৌশল। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন, ওনার কাছে লেখালেখির জন্য অনুপ্রেরণা পেতাম। তার (ছকির আলীর) ছেলে লোককবি জহিরুল ইসলাম ছিলেন এক অর্থে আমার লেখক গুরু।
প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কিছু বলুন?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় লেখালেখি করলেও আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম। লেখা হলেই তা প্রকাশ করতে হবে এই ধারণায় আমি বিশ্বাসী নই। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর ‘বাঙালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধে লেখালেখি ও বইপ্রকাশের প্রবণতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। আমি তা অনুসরণ করি। আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি এর মধ্যে দুইটি গল্পগ্রন্থ, বাকি দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ।
এখন (আজকাল) কি লিখছেন?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমফিল কোর্সের একজন গবেষক ও রেজিস্ট্যাট ফেলো। আমার গবেষণার শিরোনাম, ‘সৈয়দ শামসুল হকের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ : নিম্নবর্গের স্বপ্ন ও সংগ্রাম’এই বিষয়ের উপর কাজ করছি। তবে মাঝে মাঝে শখের বশে অথবা বলতে পারেন, মনের আনন্দে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রভৃতি লিখি।
আপনার লেখালেখির বিষয়বস্তু বা উপজীব্য নিয়ে বলুন।
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : লেখালেখি আমার কাছে হলো এক ধরনের ধ্যান, অথবা বলতে পারেন, একনিষ্ঠ সাধনার ফসল। আমি আমার দেশ ও দেশের মানুষকে খুব ভালোবাসি। এদেশের গণমানুষের জন্যেই লিখি। তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, সমাজের ভালো-মন্দ দিক এসব আমার লেখার বিষয় হয়ে ওঠে। এদেশের মানুষ, প্রকৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও অন্যায়-অবিচার ও যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিষয়কে উপজীব্য করে আমি লিখতে চেষ্টা করি।
আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : কোনো বিশেষ উৎসব বা মেলাকে কেন্দ্র করে আমি আসলে লেখালেখি করি না। সারা বছর লিখতে চাই। সারা বছরই বই প্রকাশিত হবে-এমনটাই প্রত্যাশা করি। তবে বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের একটি ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। একুশের বইমেলা এখন শুধু বই বিক্রির কেন্দ্র নয় বরং এটি প্রকাশক, লেখক, পাঠকের একটি মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। তাই পাঠকদের মতো লেখক, প্রকাশকেরাও বইমেলার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকে। এ বছর প্রকাশের উপযোগী আমার একটি প্রবন্ধের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত আছে। কোনো প্রকাশক চাইলে এবার বইটি প্রকাশিত হতে পারে।
পাঠকদের থেকে একজন লেখকের প্রত্যাশা কি থাকে? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কি?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : লেখকদের আমি বলি শব্দশ্রমিক। শব্দের উপর শব্দের কাঠামো গড়ে লেখক সৃষ্টি করেন তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্ম। লেখকের সৃজনকর্ম পূর্ণতা পায় পাঠকের কাছে। পাঠকই জাত লেখকের শেষ ভরসা। পাঠক যদি লেখা পড়ে পছন্দ করেন, আনন্দ পান, সাহিত্যের রস উপভোগ করেন তবেই লেখকের আত্মতৃপ্তি। আমি মূলত পাঠকের জন্যেই লিখি। পাঠকের ভালো লাগলে আনন্দ পাই। পাঠক অপছন্দ করলে সেই দায় বিনম্র চিত্তে মেনে নিয়ে পূর্ণউদ্যোমে নতুন লেখার চেষ্টা করি।
প্রকাশকদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : প্রকাশক ও লেখক উভয় পরস্পর পরস্পরের সহায়ক ও পরিপূরক। লেখক লিখেন আর প্রকাশকের কাজ লেখাটি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বই আকারে প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে প্রকাশক বই ব্যবসায়ী ও বিক্রয়কর্মির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা ব্যবসায়িক স্বার্থটা এখন খুব বড়ো করে দেখেন। এটা প্রকাশনা শিল্পের জন্য ভালো দিক নয়। বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধিকল্পে আমি কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমানের মতো সম্পাদক যেমন আশা করি, তেমনি কবি হাসান হাফিজুর রহমানের মতো প্রকাশক প্রত্যাশা করি।
কবি বা লেখকের কি স্বীকৃতি প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : একজন কবি বা লেখক কখনো স্বীকৃতি পাবার জন্য লিখেন না। বরং তাঁর লেখা মূল্যায়ন করে পাঠক, সমাজ-সংগঠন ও রাষ্ট্র- কবি বা লেখককে সম্মান দিয়ে নিজেরাই পরোক্ষভাবে সম্মানিত হন। তবে একথা সত্যি যে, ব্যক্তিমাত্রই কাজের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রত্যাশা করেন। আর শিল্পসাহিত্যে যে কোনো সম্মানজনক স্বীকৃতি কবি বা লেখককে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। মনের মধ্যে স্পিরিট তৈরি করে, আত্মপ্রত্যয়ী করে।
লোকে বলে কবিরা ভাতে মরে- এ নিয়ে কিছু বলুন।
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : কবি, লেখকগণ আজীবন খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। কারণ তাদের চেতনায় সব সময় খেলা করে সমাজ, রাষ্ট্র ও গণমানুষের কল্যাণ। দুএকজন বাদে সাহিত্যিকেরা বেশিরভাগই বৈশ্বয়িক হতে পারেন না। উল্টো, সত্য-সুন্দর ও ন্যায়ের চর্চা করার জন্য কবি, সাহিত্যিকগণকে রাষ্ট্রের শাসক, শোষকের দ্বারা পদে পদে লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত ও অপমানিত হতে হয়। কবি, লেখকদের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ বা শক্তি হলো তাদের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। জীবনে নানা অভাব, অভিযোগ আসে তবে তাঁরা নিজের পারসোনালিটি বিকিয়ে দেন না বলেই দারিদ্র কবিদের পিছু ছাড়ে না।
একজন লেখক কবির জন্য পড়াশোনা (সাহিত্যপাঠ) কতটুকু জরুরী?
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : একজন লেখক বা কবির জন্য সার্বক্ষণিক পড়াশোনা বা জ্ঞানচর্চা জরুরি। পড়াশোনা না করলে সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ধারণা পাবেন কীভাবে! লেখককে সব সময় সমসাময়িক ও স্মার্ট থাকতে হয়। আধুনিক সময়ে লেখককে শুধু সাহিত্য পাঠ করলে চলে না। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম-দর্শন, ন্যায় ও নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখতে হয়।
নিজের লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা জানতে চাই।
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : সাহিত্য মানেই ঘরের কথা পরকে জানানো। নিজের কথাগুলো পরেরকথা করে তুলতে পারাই লেখকের বড় সফলতা। মানুষের ভালোবাসা লেখকের সবচেয়েবড়ো প্রাপ্তি। আমৃত্যু মানুষের কথা লিখে যেতে চাই। দেশের কথা লিখে যেতে চাই। লেখা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আরও বড়ো পরিসরে কাজ করতে চাই।
যারা লিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
অনন্ত পৃথ্বীরাজ : আমি নতুনের পূজারি। যারা লেখালেখি করতে চায় আমি তাদের স্বাগত জানাই। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো উত্তরপ্রজন্ম দূর করে দেবেন। তবে, তার আগে তাদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আমি সবার কল্যাণ কামনা করি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। পরিক্রমা সাহিত্য পত্রিকার সকল পাঠককে ধন্যবাদ জানাই।
কবি পরিচিতি: অনন্ত পৃথ্বীরাজ বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, কথাকার ও গবেষক। তিনি ১৯৮৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলাধীন চেংটিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হলেও বর্তমানে সলংগা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, সিরাজগঞ্জ-এ বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত। ত্রৈমাসিক পালকি নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ চারটি।
আরো পড়ুন- কবি তাজ ইসলামের সাক্ষাৎকার