কবি আশরাফ চঞ্চলের সাক্ষাৎকার
কেমন আছেন?
দেশের এমন পরিস্থিতিতে কতটুকই আর ভালো থাকা যায়? তবুও সার্বিক বিবেচনায় আগের চেয়ে ভালো আছি।
লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?
আমি যখন এইট কিংবা নাইনে পড়ি ঠিক তখন থেকেই লেখালেখির বিষয়টা মনের ভেতর জেঁকে বসে। আমার প্রফেসর মামার বাড়িতে ব্যক্তিগত বিশাল একটা লাইব্রেরি ছিল। সেখানে পারস্য, গ্রিক সাহিত্য থেকে শুরু করে ইংরেজি, উর্দু, ফারসি ও বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখারই বই ছিল। মামার চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই বই এনে পড়তাম। বই পড়তে পড়তেই লেখালেখি শুরু। আমার লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা বই পড়াকে কেন্দ্র করেই।অর্থাৎ লিখতে হলে পড়তে হবে।
প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কিছু বলুন।
ছাপা অক্ষরে আমার প্রথম লেখা ‘আমার প্রিয় গ্রাম’ নামক একটি ছড়া কবিতা ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আলোর ফোয়ারা পত্রিকায়। সেই থেকে অদ্যাবধি দৈনিক থেকে শুরু করে সাহিত্য ম্যাগগুলোতে নিয়মিত লিখেই চলেছি। এক সময় নিজ গ্রামের সাহিত্য সংগঠন ‘সূর্যকুঁড়ি সাহিত্য পরিষদ’ কর্তৃক মাসিক সূর্যকুঁড়ি প্রকাশনার দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। অদৃষ্টের কারণেই হয়তোবা আজও আমার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। তাছাড়া আমিও মন থেকে বই প্রকাশের উদ্যোগ নিইনি। আমার অনেক পরিচিত পকেটের টাকায় বই প্রকাশ করে দশটি বইও পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারেনি! দেশে পাঠক তৈরী না করে বই প্রকাশ করা আদতেই বোকামি!
এখন কি লিখছেন?
লেখালেখির অভ্যাস ছড়া দিয়ে শুরু হলেও পরে অবশ্য গল্প ও অণুগল্প লেখা শুরু করি। এককালে জাতীয় দৈনিক সমূহে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমার একটা না একটা অণুগল্প প্রকাশিত হতোই! তারপর প্রেম ঘটিত কারণে লেখালেখিতে ভাটা পড়ে! মূলতঃ লেখালেখির জগত থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়ি। এখন লেখালেখিতে এতটা সরব উপস্থিতি না থাকলেও কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেছি। যদিও আমার পক্ষে কবিতা লেখা সহজ কাজ নয় তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতে তো আর দোষ নেই!
আপনার লেখালেখির বিষয়বস্তু বা উপজীব্য নিয়ে বলুন।
আমার লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু বা উপজীব্য হলো নারী, প্রেম, ভালোবাসা! শরীরী উন্মাদনার জটিল হিসেব নিকাশ! এসব নিয়ে লিখি বলে কেউ কেউ বলে আমার লেখায় নাকি শুধু গদগদে অশ্লীলতা! শরীরী অতি গোপন বিষয় আশয়কে আমি নাকি নির্লজ্জের মতো জনসম্মুখে তুলে আনি! বাস্তবতা নিয়ে লিখতে গিয়ে জনরোষে শিকার হয়েছি অনেকবার! আমার লেখা নিয়ে কে কী বলল তা নিয়ে আমি একটুও কুন্ঠিত নই! কারন আমার ভেতরে বাস করে স্বাধীন এক লেখক সত্তা!
এছাড়া আমার লেখায় রাষ্ট্র সমাজ পরিবার ধর্ম ও প্রকৃতিও বাদ যায় না। অসঙ্গতি অন্যায় অবিচারের বিপক্ষে আমি সর্বদাই সোচ্চার!
আসন্ন বইমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।
আসলে বইমেলা সম্পর্কে আমার আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার জীবনে শুধু একবারই বইমেলায় গিয়েছি। বর্তমানে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বইমেলার যে বিশৃঙ্খলার চিত্র চোখে ভেসে উঠে তা দেখে বইমেলার আগ্রহ মন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে! মেলার ৯০% মানুষ বই কিনতে যায় না! যায় আড্ডা ও খাবার খেতে! শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে খাবারের হোটেল মেলার চৌহদ্দিতে রাখা যাবে না।
পাঠকদের কাছ থেকে একজন লেখকের প্রত্যাশা কি থাকে? আপনার ক্ষেত্রে তার প্রভাব কি?
প্রায় সব লেখকেরই প্রত্যাশা থাকে পাঠক তার লেখা পড়ুক। একজন লেখক তো বেঁচে থাকেন পাঠকের মাঝেই।মনের তাগিদে লিখলেও তা পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারলেই তো নিজের আত্মতুষ্টি! নিজের পাঠক তৈরী করতে না পারলে সহসাই লেখকের মৃত্যু অনিবার্য!
হ্যাঁ, আমার নিজের একটা পাঠক বলয় আছে। এ প্রভাবটা আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহের যোগান দেয় বলেই নিয়মিত লিখেই চলেছি! এবং এ লেখালেখি আমৃত্যু অব্যাহত রাখতে মনের দিক থেকে আমি বদ্ধপরিকর!
প্রকাশকদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য চাই।
আগেই বলেছি আমার কোনো প্রকাশিত বই নেই। ফলে প্রকাশকদের বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে যতদূর জেনেছি, অধিকাংশ প্রকাশকই নাকি লেখকদের সাথে প্রতারণা করে! পান্ডুলিপি নিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নামমাত্র সখ্যক বই প্রকাশ করলেও বই বিক্রির ক্ষেতে ততটা আন্তরিক না। তাছাড়া লেখকের প্রাপ্য রয়্যালিটি কখনোই তাঁরা ঠিকমতো বুঝিয়ে দেন না। এ বিষয়ে প্রকাশকরা আন্তরিক না হলে লেখকরা এক সময় বই প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে! আর সেটা হবে বাংলা সাহিত্য তথা প্রকাশনা শিল্পের জন্য অশনিসংকেত!
কবি বা লেখকের কি স্বীকৃতি প্রয়োজন আছে? কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?
স্বীকৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সবাই লিখে না। লেখা তো আসে মনের তাগিদ থেকে। কেউ লিখতে চাইলেই লিখতে পারে না। লেখা হচ্ছে ঐশ্বরিক দান! তবে অধিকাংশ লেখক/কবিই চায় তার লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছুক। স্বীকৃতি মুখ্য উদ্দেশ্য না হলেও ভালো কিছু লেখার জন্য স্বীকৃতি অবশ্যই জরুরী। এতে অনুপ্রেরণার মাধ্যমে লেখক/কবি সত্তার সহজেই বিকাশ ঘটে! তাছাড়া ‘কবি’ একটি আকর্ষিক শব্দ। অনেকটা সম্মানেরও। কবিকে সম্মান করে না পৃথিবীতে এমন লোক খুব কমই আছে! আমি একজন কবি হয়ে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ব্যাপারটিকে পজিটভ হিসেবেই দেখি। নিজের কবিতা পড়ে পাঠক যখন উৎসাহ দেয় তখন ঠিকই ভালোলাগা কাজ করে। আনন্দে পুলকিত হই!
লোকে বলে কবিরা ভাতে মরে- এ বিষয়ে কিছু বলুন।
এটা পুরনো কথা।বর্তমানে কবিরা যতটা সচেতন তারচেয়ে স্বাবলম্বী। একজন কবির অস্বচ্ছলতা থাকতেই পারে তাই বলে ভাতের অভাব এখন আর নেই!
একজন লেখক/কবির জন্য পড়াশোনা(সাহিত্য পাঠ) কতটুকু জরুরী?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি ২নং প্রশ্নেই দিয়ে দিয়েছি। লেখালেখি করতে হলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। যে যতবেশি পড়বে তার লেখা ততবেশি সুন্দর ও আধুনিক হবে। পড়তে পড়তেই নিজের মধ্যে লেখালেখির ভাব জাগ্রত হয়! অর্থাৎ লিখতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে। এটাই লেখালেখির মূল সুত্র!
নিজের লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা জানতে চাই।
অতীতেও অনেক পরিকল্পনা ছিল লেখালেখি নিয়ে। বলতে গেলে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে গেছে! ভবিষ্যতে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যেতে পারলে বই প্রকাশের ইচ্ছে আছে।
আমার লেখালেখির জীবনে অসংখ্য পাঠকের অপরিসীম ভালোবাসা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো প্রাপ্তি নেই।
১.দৈনিক যুগান্তর সেরা গল্প লেখক পুরস্কার ২০০৭
২.দৈনিক নয়াদিগন্ত সেরা কবি পুরস্কার-২০০৭ এবং ২০০৮
৩.ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম সেরা লেখক পুরস্কার ২০১৪ পাওয়ায় নতুন করে লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
আসলে লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রাপ্তি বড়কিছু নয়। আমার মতে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব উহ্য রেখে নিজের গতিতে লেখালেখিকে এগিয়ে যাওয়া। আমি এভাবেই নিজেকে এগিয়ে নিতে চাই।
যারা লিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন।
বর্তমানে নতুনরা ভালো লিখছে। তাদের লেখায় আধুনিকতার ছোঁয়া লক্ষণীয়। চর্যাপদ থেকে শুরু করলেও বাংলা সাহিত্যের বয়স হয়েছে কয়েকশো বছর কিন্তু আমরা বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে আমাদের অবস্থান দাঁড় করাতে পারিনি! আমার বিশ্বাস নতুনরা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের বুকে পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হবে। আমার মতো একজন অখ্যাত কবির ইন্টারভিউ প্রকাশ করার জন্য৷ পরমপাঠ কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
কবি পরিচিতি: ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার প্রত্যন্ত টাওয়াইল গ্রামে ১৯৮২ সালের ১৫ নভেম্বরে এক কৃষক পরিবারে জন্ম।বাবার নাম বাহার উদ্দিন। মা মৃত খালেদা আক্তার। তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞান মাস্টার্স। পেশায় সরকারি চাকরিজীবী।
আরো পড়ুন- কবি সুশান্ত হালদারের সাক্ষাৎকার