কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

মরা গাঙে পাতার ছায়া- রাজিয়া নাজমী- গল্প

লাঠিটা শখের বশে কেনা হলেও এখন এটা ছাড়া এক পা বাড়াতেই ভয় করে। কবে কিনেছিল তা মনে নাই। তবে যখন কিনেছিল তখন লাঠিটা হাতে নিলেও তা শূন্যেই দোলাতে দোলাতে জোর কদমে হেঁটে  চলত।  সেই পা এখন ঝিমায়ে থাকে। ওঠে না লাঠি সাহস না দিলে। ভুলেও যদি  লাঠি ছাড়া উঠতে যায় তো জরিনা ‘লাঠি ছাড়া আবার’ বলে এমন চিৎকার করে ওঠে যে লাঠি নিতে গিয়েই পড়ে যাওয়ার অবস্থা।

আর এই জরিনাই একদিন লাঠি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বেহুদা টাকা খরচের জন্য বিষোদ্গার করেও শান্তি পায় নাই। হাতে ধরা লাঠির দিকে তাকিয়ে সন্দেহের চোখে টিপ্পনী মাইরা কইছিলো- হঠাৎ লাঠির শখ হল কেন তোমার?  তুমি  তো হাঁটো না  দৌড়ে চল। তো কে গছালে এইটা?

জরিনা’র এই ধরনের তিতা কথা চামড়ায় সয়ে গেলেও মাঝে মাঝে বেশি পোড়ালে কথার বাড়ি সেও দেয়। কিন্তু লাঠিটা ভেঙে ফেলার মত মেজাজ জরিনার আছে তাই নরম করেই বলেছিলো, জরিনা এই হল তোমাকে নিয়ে সমস্যা। বাড়তি কিছু কিনলেই তোমার মনে হবে আমাকে কেউ গছায়ে দিছে। লাঠির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, কেন যে এটা আমার নজরে পড়ে গেলো, জানি না।  ভাল লাগলো, কিনলাম। কেউ গছায়নি। এখন না হোক কোন না কোন একদিন ঠিকই কাজে লাগবো।

তার রসকষহীন মেজাজি বউটা জরিনা নাম ধরে ডাকলেই পরের ধাপে মেজাজ  দেখাতে একটু সময় নেয়।

জরিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে লাঠির দিকে তাকিয়ে ঝামটা মেরে রান্নাঘরে গিয়ে এককাপ চা এনে কাপটা ঠক করে টেবিলে রেখে আবার গরম সীসা ঢালতে ঢালতে  বলে, আসতে যাইতে নজরে তো কতকিছুই পড়ে হাত দিয়ে ধরতেও মন চায়। পিরিতের নাগর আমার।  বয়সের খেয়াল নাই হাউশের শেষ নাই।

জরিনার এইটা থাকে স্বামীকে উস্কানোর শেষ খোঁচা। কিন্তু তার বউ জানে না এক তরবারি ব্যবহার করতে করতে সে ভোতা করেই ফালাইছে- এখন আর খোঁচা তেমন লাগে না।

আমিষ ছাড়া ডালভাত খেয়েও শরীর চলে শুধু লবন ছাড়া সেই খাবারে কোন তৃপ্তি নাই। জরিনার সঙ্গে তার মানায়ে নেওয়া সংসারী জীবনের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলো।

তিন বাচ্চার জন্ম নিলেও এক বাচ্চা পাঁচ না হতেই  মারা গেলো। জরিনা সেই শোক বছর শেষে কাটায় উঠলেও অনেক কিছুই উঠে আসলো না। তুলে আনার উৎসাহে ভাটা পড়ার দায় জরিনা আর তার  মধ্যে উনিশ বিষের তফাৎ।

দুজনেরই দুজনকে সহ্য করার চেয়ে অসহ্য করাই যেন সহজ হয়ে উঠলো– একে অপরকে দোষারোপ করাতেই যেন শান্তি মেলে।

শফিক আলি বিছানা থেকে লাঠি ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে ইচ্ছা করেই জোরে বলে, যৌবন গেলো চইলা– কাছে আইলো লাঠি।

কি বললে? কে কাছে আইলো?

কে আসব কাছে, জায়গা রাখছো কারো আসার?

ফালতু কথা রাখো।সরিষার তেল গায়ে দিয়ে চলছ সারাজীবন ধরতে পারলাম কই। আমি বলে সহ্য করে গেছি।

আরে রাখো, তোমার ঘ্যানা।সতী সাবিত্রী বউ আমার। কোন জমানায় শার্টের কলারে লিপস্টিক দাগ দেইখা এই যে বচন শুরু করলা ক্ষ্যামা দিলা না। যবে থাইক্যা আইছ, খালি সন্দেহ শুরু করলা। অত না করলে কিছুই করতাম না। এখন এই বুড়া বয়েসও কে কাছে আইলো। লাঠির কথা কইছি। খুব তো রাগ দেখাইছিলা লাঠি দেইখা। এখন কী কাজে লাগছে না! কে দিলো কে দিলো কইরা গোয়েন্দাগিরি করলা। দিতে তো কতজনই চাইছিল।

এই কথাটা পাশ ফিরে শুয়ে থাকা এক কানে কম শোনা মানুষটির কানে যাতে না যায় তাই যদিও বা আস্তে  করেই বলে তবুই সে ঠিকই শোনে।

কি দিতে চাইলো হ্যাঁ? কে? কি নাম?

এই এখন আবার শুরু হল আরেক প্রশ্ন। সারাজীবন প্রশ্ন আর প্রশ্ন। ভালো কথা যখন বলি তখন তো কানে ঢোকে না। আবার  তো দেখি সময় মত কানের পর্দা ঠিক হয়ে যায়।

জবাব তো দেও না। এখন কোথায় যাবার জন্য উঠে বসছ শুনি?

আজ আমি একা কোথায় যাবোই যাবো।

কোথায়?

জানি না। বাইরে পা রাইখ্যা তারপর ভাববো।

আর আমি বাড়িতে বসে তোমার জন্য কোরমা পোলাও বানাবো…। শুয়োর কোথাকার…মুখ খারাপ করবো এখন।

মুখ তোমার কবে ভালো ছিলো সে দেখার জন্য বয়স অর্ধেকের বেশি কমাতেই হবে। বয়স বাড়তে বাড়তে তো এখন… বালের সংসার আমার। কোরমা রাঁধো– গন্ধ পাইলে ফেরত আসুম।

কি বললা? আমি ঝগড়া করি? আর জন্মে তোমারে চোখে পড়ার আগে দশহাত দূরে যাবো। চোখের সীমানায়ও যেন আল্লাহ্‌ আমারে না রাখে। বালের পীরিতি। হাড়মাংস এক করে দিলো। এখন এক পা যদি আইজ বের করছো তয় আজ আর ঘরে ফিরতে হবে না। কি মনে কর? শরীরে জোর কমছে বলে দরজা বন্ধ করতি পারবো না?

শরীরে জোর নাই তো কী?  গলায় যে জোর দিনে দিনে বাড়ছে।  সকাল হতেই নিচে কলপাড়ে পানির লাইন নিয়ে খিস্তি ঝাড়ে বেটিরা আর এক তলায় জরিনা বেগম তার শখের খোপে বসে চালায় মুখ। মুখ তো না যেন…।

আর কত বলবা, আর কত… রে আল্লাহ্‌ আমারে তুমি জাহান্নামী সংসার থিকা তুইলা নেও। মাবুদ আর এত নাল্লত ভালো লাগে না…।

হ হ, আল্লাহ্‌ নাল্লত নাল্লত কে কারে করে দেখে। তোমার চোখের নজরে থাকতে থাকতে জীবন শেষ করছি- এইবার দরজায় খিল দিয়ে রহম করো।

সত্তর বছরের শফিক আলী সাতষট্টি বছরের স্ত্রী’র কান্না কানে না তুলে, হুকুম না মেনে- লাঠিতে ভর দিয়ে দরজা খুলে, দিয়ে রাস্তায় বের হয়ে হাত নাড়িয়ে ডাকার আগেই রিকশাওয়ালাও এসে যখন জানতে চাইল, কোথায়? তখনও তার মাথায় একটু আগে জরিনা’কে বলা ‘জানি না’ ঘুরছে।

কী বলবে রিকশাওয়ালা’কে?  নিয়ে চল… আমার অতীতকালে।  আমার স্বাধীন বয়সে।  যখন মন চাইলে সারাদিন উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রায় বের হয়ে যাওয়ার তাকত ছিল।

রিকশাওয়ালাদের আপত্তি থাকতো না। গন্তব্যহীন যাত্রীকে নিয়ে যেতে যেতে সিদ্ধেশ্বরী’র খোলা রাস্তা পেরিয়ে মিন্টু রোডের একটা বাড়ির সামনে আসলেই, একদিনের দেখা একটি মুখ আবার দেখার বাসনা জাগত। জানতে মন চাইতো দূর দ্বীপবাসিনী হয়ে সে কেমন আছে! মন চাইতো জানতে একদিনের সেই দৃষ্টিতে কী ছিল। জানাইতে মন চাইতো সেই মুখ সেই দৃষ্টি কাঁটার মত আটকায়ে আছে অন্তরে। রাখতেও ব্যথা লাগে তুলতে গেলোও ব্যথা লাগে। প্রেম কী এইটা? কাছে পাইলো না বলেই সারা জীবনে রয়ে যাবে একই রকম? পুরাতন হবো না, বয়স বাড়বে না, বাসি হবো না?

শফিক আলি, বুকে হাত দেয়, ব্যথাটা অনেক জোরে চাপ দিলেই লাগে। আগের মত ছুঁইলেই আর লাগে না। শফিক আলি হাসে; আহা কতকাল পরে মিন্টু রোড নামটা আবার মনে পড়লো।  ছাইচাপা দেওয়া মনের ভিতরে  উঁকিঝুঁকি মারে কত কিছু। বাহির করা আনাই কঠিন। না আছে মন না আছে জোর। লাঠিটা শখ কইরা কিনলেও এখন মনে হয় এইটাও তারে বশে রাখতেই যেন পায়ের ক্ষমতা কমায় দিলো।

দাদু কোথায় যাবেন বলেন।

রিকশাওয়ালার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে উঠে বসে ভাবে, কোথায় যাবে! গন্ধ টানে যেদিকে… সবই তো নিজের হাতে শেষ করে দিছে। বউয়ের আবদার পোলাপানের আবদার; না আবদার কেন ভাবে, আবদারের ঢঙে ছিলো হুকুম।

দাদু কনদিকে?

যাও বাড্ডা পার হয়ে সাঁতারকুলে দিকে। যাইতে যাইতে  ডান বাম বলে দেব।  মনে মনে ভাবে আজ আর ফিরবো না। বাড়ি নেই ঘর নেই আছে এক ডেরা। একফোঁটা শান্তির হাওয়া বয় না যেখানে।

সে তাদের হুকুম ঠিক মানলো, সব বিক্রি করে দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কিনলো ছেলেমেয়ের পছন্দ মত। কিন্তু কই থাকলো তো না ওরা– বাপকে তার আজীবনের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে  আজ দুই সন্তানই দিন রাত্রির সময় ভেদে আরেক দেশের বাসিন্দা হয়ে গেলো। মাসে একবার দুইবার ফোন করে খোঁজ খবর করে। লোক মারফত টাকা পাঠায়। ওষুধ পাঠায়। তাঁদের যে তাতেই খুশি থাকার কথা। ছেলেমেয়ে ভুলেও তো যাইতে পারতো! ভুলে  যে নাই সেই তো আল্লাহ্‌র অসীম রহমত!

শফিক আলী আকাশের দিকে তাকায়– গতকালের বৃষ্টির পরে আজ বড় বেশি নীল হয়ে আছে আকাশ।

মেয়েটি গতকাল ফোনে বলেছিলো ওদের ওখানে না কি বরফ পড়ছে আজ দুদিন ধরে।

কেমন সে দৃশ্য?  নীল আকাশের নীচে সাদা সাদা তুষারে ঢাকা। কেমন সেই সাদা? কর্পূরের মত সাদা  কিন্তু উড়ে যায় না!  ঝরে পড়া বরফ দিনের পর দিন জমাট বেঁধে থাকে– রোদ উঠলে গলতে শুরু করে– বৃষ্টি হলে ধুয়ে মুছে ছাফ করে ফেলে। দুই ছেলেমেয়ের তুষারপাতের কথায় কোন আনন্দ থাকে না বরং বেশ বিরক্ত নিয়ে বলে।

ওদের অভিযোগ শুনতে শুনতে কল্পনায় সে তখন অজানা রাস্তায় তুষারের মধ্যে হেঁটে বেড়ায়। দেখে সারি সারি পাইন গাছের ডাল সাদা কাগজে মোড়ানো। সবুজ পাতার গায়ে মিহি বরফের দানা। গাছের গোঁড়ায় স্তূপ হয়ে আছে কুচিকুচি বরফ। সন্ধ্যে নামলে সারা শহরে যেন সাদা থান পরা ভুতের আগমনে বিস্ময়কর নীরবতা নামে– কোন হল্লা নেই কোন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নেই।

সুনসান নীরবতার মাঝে মাঝে ঘরের ভেতর থেকে আসে কিছু টুংটাং শব্দ গরম চুল্লির তাপের মাঝে বসে থাকে ক্লান্ত  শরীরে তার ছেলেমেয়ে যে যার সংসার নিয়ে।

ওদেরকে তার তেমন কিছু বলার থাকে না। কথা বলতে হয় তাই বলা। জানতে চায় তোদের ওখানে আবহাওয়া কেমন। কখন প্রচণ্ড গরম, কখন শীত শুধু জাঁকিয়ে বসে না তাপ একেবারে নাকি নামতে নামতে এত নীচে নামে যে ওরা বলে মাইনাসের ঘরে। ওদের কথায় মনে হয়ে কোন ঋতু ওদের ঠিক আরাম দেয় না। সে ভাবে এই বয়সেই ওরা যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। বাকী জীবন কী করবে? দেশ ভালো লাগলো না তো বিদেশে ছুটলো।বিদেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ।  জরিনা অবশ্য মনে করে,ওরা ইচ্ছা করেই এত সমস্যার কথা বলে।

নাহ; যাওয়া হয়নি ওদের সংসার দেখতে। কল্পনায় পরবাসী ছেলেমেয়ের সংসারের একটা চিত্র আঁকে। জরিনা ছেলেমেয়ের কাছে দুই একবার ইচ্ছা প্রকাশ করে চুপ হয়ে গেছে। জরিনার মত সে কোনদিনই মনের ভিতরে জেগে উঠতে চাওয়া ইচ্ছাকে প্রশ্রয়ে দেয় নাই– মেরেই ফেলেছে জন্ম নেবার সাথে সাথেই!

সাঁতারকুলের কাছে রিকশা যতই আগাচ্ছে ততই অন্যরকম মাটির গন্ধ। দূরে ধোঁয়া উড়ছে। বোধহয় ইটের খোলায় ইট পোড়াচ্ছে। ধোঁয়াগুলো আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে উঁচুতে ছুটতে চাইলেও যেতে পারে কী? বাতাস তাকে যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই যে তার গতিপথ নির্ধারিত হয়ে যায়।

ছেলেমেয়েরা কেন তাঁদেরকে ওদের সংসার দেখাতে নেওয়ার কোন আগ্রহ প্রকাশ করে না তা সে জানতে চায় না। কী হবে জেনে। হাতেগোনা আর তো মাত্র কটা দিন।

শফিক আলী বহুচেনা পাখির ডাকে একটু চমক খেলেন। সময়টা কী এখন বসন্তকাল! বোঝার যে আজকাল আর উপায় নেই। গায়ে গায়ে লাগানো দালানের গা ঘেঁসে যদিও বা দুই একটা গাছ থাকে তাতে কোকিল এসে বসে না।

সাঁতারকুলে এখনও আমগাছ আছে। আমের মঞ্জুরি  ধরেছে ডালে ডালে। বাতাসে ধুলার গন্ধ ছাপিয়ে আমের বোলের সুগন্ধ ঠিকই ছড়াচ্ছে। কচিকচি নূতন পাতা একটু উঁকি মারতেই পুরনো গাঢ় সবুজ পাতাগুলো স্ব-ইচ্ছায় টুপটাপ করে ঝরে পড়ে– প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। শুধু বোধহয় মানুষের মন ঝরে যেতে যায় না। যাবার কথায় মন কাঁদে। একাকীত্বে নিঃস্ব হয়ে যায়, ভালোবাসাহীন জীবনের যন্ত্রণায় কাঁতর হয়েও বেঁচে থাকতে চায়-মৃত্যু তো আসবেই এই সত্য জানে বলেই কী? মৃত্যু জন্মের মত কোন জীবন নয় জানে বলেই কী খেয়ে না খেয়ে জরাজীর্ণ শরীরেও বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কাঁদে?

রিকশা থামে বাজার পার করে সাঁতারকুলের ব্রিজের বায়ে পাঁচতলা বাড়ির সামনে।

শফিক আলীর চোখে ভাসে টিনের বাড়ি, নিকানো উঠোনে আঙ্গুলের ছাপ, বাঁশের সাঁকোর উপরে লুঙ্গি আর খালি পায়ে হেঁটে যায় এক যুবক।

দৃষ্টি আরও গভীরে আরও নিচে যায়। সাঁকোর কিনার ধরে কাঁদার গায়ে উদাম শরীর বসতেই  সড়াৎ করে নিয়ে আসে একেবারে পানির কাছে। একহাতে খপ করে ধরা ঢোঁড়া সাপ, আরেক হাতে মুঠি ভরে বেঙ্গাচি নিয়ে উপরে আসতে না আসতেই পিছন থেকে পিঠে ঠাস ঠাস চড়– বাজান এক ঝাঁকি দিয়ে তার দুইহাত খালি করে আর কয়েকটা চড় দিয়ে কানে ধরে টেনে আনে বাড়িতে।  লাল গলা ঢোড়া সাপ তো নির্বিষ। তারপরেও কেন বাজান পালতে দেয় না? হাতের আঙুল গুনে হিসাব করতো আর কত বছর পরে তার যা মন চায় তাই সে করতে পারবে। মা তেল গরম করে বোনের হাতে দিলে, বোন পিঠে তেল ডলতে ডলতে বলতো, সাপ ঘরে তুলতে নাই ভাই।

বোনটার কথা মনে পড়লে বুকের মধ্যে ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে জ্বলে। বাজান তাঁর ময়লা রঙের মাইয়ারে বিয়ে দিলো দোজবরের সাথে। স্বামীর মার সহ্য করতে না পাইরা বাজানের মাইয়া  বাপের বাড়ি আসলেও পরদিন আবার ফেরত যাইত চোখের পানি মুছতে মুছতে। বইনটার পিঠে মারের মোটা দাগ দেখলেও সে কোনদিন গরম তেল  মালিস করতে পারে নাই। মার খাইতে খাইতে বইনটা একদিন নিজেরেই মাইরা ফালাইলো। বাজান বিছানায় পইড়া থাকলো কয়েক বছর।  মা সব শোক সামাল দিয়া ঠিক থাকার চেষ্টায় টিকে থাকলো ছেলের সংসার হওয়া পর্যন্ত।

সাঁতারকুল গ্রামের সাঁকোর এপার ওপাড়ের মধ্যে মা কুটুম্বিতা করলো। শানাই বাজলো দুই পাড়ে।

একহাত ঘোমটা মাথায়  সদ্য বিবাহিত জরিনা স্বামীর পিছে পিছে সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে পা রাখে মায়ের নিকানো উঠোনে রাখা ঠাণ্ডা পানির বড় মালসায়। নতুন বউয়ের ভেজা পায়ে উঠোন পার হওয়া দেখে সবাই। সেও দেখে পানিতে ভিজে গলে পড়া আলতায় মাখামাখি  সুন্দর পা জোড়া। একটা কেমন শিহরণ বয়ে যায় শরীরে।  বউ হেঁটে হেঁটে দাওয়া বসে থাকা বিধবা শাশুড়ির পায়ে ছালাম করে। মা তাঁর চাবির গোছা বাড়ির লক্ষ্মীর আঁচলে বেঁধে দিয়ে বলে– এইবার আমার ছুটি। মা তাঁর ছেলের হাতে নববধূর হাত তুলে দিয়ে বলে, দুজনে সুখে সংসার কর, বংশ রক্ষা কইরো।

সে টের পায় জরিনার হাত কেঁপে ওঠে। সে আরও শক্ত করে নরম হাতটা ধরে থাকে। সদ্য বিবাহিত বউ লজ্জায় মাথা আরও নিচু করলেও সে বোঝে শক্ত হাতের উষ্ণতার আবেগে সেও কাতর, রাত বাড়ে, বসনের আড়াল খুলে একে অপরের কাছে আসে– সারাদিনের ঘোমটায় ঢেকে থাকে মানুষটার মায়াবী চোখে কী ছিল সে জানে না– নেশাগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিলো। জরিনার উন্মুখ ঠোঁট তাঁকে টেনে নিয়ে গেলে আর গভীরে। জরিনা একবারের জন্য লজ্জায় আড়ষ্ট  হয়নি। বাসরের সবটা দিয়ে সে একার করে নিয়েছিলো তার পুরুষকে।

তারপরের দিন মাস বছর গড়াল তাদের দায় দায়িত্বের জোয়াল টেনে– ঘরে বাইরে, অনেক দুঃখের মাঝে কিছু সুখ,সময় চলে গেলো- চলেই গেলো কী অদ্ভদভাবে। কখন সময়কে বড় বেশি দীর্ঘ মনে হয় আবার কোন সময় যেন কিছু লেনাদেনা  করার  জন্য এসেই চলে যায়। বয়স বাড়ায়ে দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন! সময় তাকে পিতাও বানালো, অনাথ করলো, কত দ্রুত সময় সব বদলে দিলো তার জীবনে।

আরেকবার ভালো করে বাড়িটার দিকে শফিক আলি তাকায়। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা পাঁচতলা বাড়ি। বাঁশের সাঁকো নেই! রিকশা আবার চলে পাকা ব্রিজের উপর দিয়ে। চারদিকে লোহা পেটার আওয়াজ, ব্রিজের উপরে দিয়ে যায় ইট বালুর গাড়ি। সাঁতারকুল গ্রাম কী কেউ আর বলে? গ্রাম শব্দটা কবে থেকে বাদ পড়ে গেলো?

রিকশা থামে ব্রিজের ঢালে।

চার কদম দূরের চেনা বাড়ির চেহারা বদলে গেলেও বাড়ির বড় মেয়ে জরিনার লাগানো জামগাছ এখন আছে। গাছের সবুজ পাতাগুলো এত পেরেশানির মধ্যেও দোল খায়। এখন ফুল ধরে,ফলের জন্ম দেয়। জরিনার কী মনে পড়ে জামফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ? বাটি ভরা জাম ঝাঁকিয়ে খাওয়ার সুখ? জরিনার মুখে এসব ইচ্ছার কথা বহুদিন শোনে নাই।

জরিনা কী বলে না? না ভুলেই গেছে?

শফিক আলী হাতের তালুতে চোখ মুছে রিকশাওয়ালা’কে  বলে,বাবা আমারে শান্তিবাগে ফেরত নিয়ে যা এখন!  সন্ধ্যে লাগার আগেই ঘরে নিয়া যা।

*রাজিয়া নাজমী: নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক ও প্রযুক্তিবিদ।

আরও পড়ুন- আহমেদ রনি’র গল্প – টোপ