মুহূর্তের টান, মুহূর্তে স্মরণ- মুনজুরুল আহসান ওলি- গল্প
বহুদিন পর, আজকে যখন সে বিএডিসি কলোনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখন চৈত্রের মেঘহীন ঘাঢ় আকাশের নিচে রৌদ্রতপ্ত দুপুর ক্রমেই আরও অগ্নিময় হচ্ছিলো।
যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ঢাকা শহরের শান্ত ও প্রশস্তময় বড় রাস্তাগুলির একটা। দু’পাশে সাদা, শূন্য ফুটপাথ রোদে ঘামছিল। অল্পবিস্তর পথচারী, কিছু হুডতোলা রিকশা আর কিছুক্ষণ পরপর দু’একটা বাস চলে যাচ্ছিলো। এদিকে ওদিকে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায়-ধূসর একঘেয়ে দালান। বারান্দায় শুকাতে দেয়া কাপড় চোপড়গুলো সংসারী নৈরাশ্য ছড়াচ্ছিলো। এই সবকিছুই তার কত পরিচিত! এমনকি আট বছর আগে সন্ধ্যা নামলে এই ফুটপাথের কোথায় কিসের দোকান বসতো তাও সে বলে দিতে পারে। ওই তো। ওইখানে বসতো এক বৃদ্ধ কলাবিক্রেতা, কালো ফ্রেমের পুরু চশমার পেছন থেকে তার চোখ দু’টো দুনিয়ার সমস্ত কিছুর দিকে আশাহত দৃষ্টিতে তাকাতো। নিজের সামনে সাজানো সামান্য কয়েক ছড়া, কালো-ছোপ-পড়া কলাও, ঐ দৃষ্টি থেকে মুক্তি পেতো না।
কলোনীতে ঢোকার সরু গলিতে পা রেখে সে ভাবে- ‘সবকিছুই বদলে গেছে।’ গলিটা ফাঁকা, দু’পাশের দোকানগুলি সম্ভবত ‘উচ্ছেদ অভিযান’-এর ফলস্বরুপ স্তূপীকৃত, এলোমেলো কিছু ইট ছাড়া একেবারেই চিহ্নহীন। গলির শেষমাথায় সেলুনের চিহ্নস্বরুপ পেছনের দেয়ালে একটা কাঠের-লাইনিং দেয়া ভাঙা আয়না ঝোলানো। পোলাপান সেটা সরায়ে ফ্যালেনি কেন কে জানে! আয়নাটা তার মাথার ভেতরে বিভ্রমাত্মক কীসব জাগায়ে তোলে তার লেখক জীবনের প্রথম দিককার কথা। এই কলোনীর শেষ প্রান্তের একটা দালানের পাঁচতলায় এক ঘরে, আরও দু’টা ছেলের সাথে যখন সে থাকত। হতদরিদ্র, উদ্ভান্ত, উচ্চাকাঙ্খী, রুগ্নবালক। পুরো বিশ্বজগতের প্রতি এক ধরনের অমানুষিক বিতৃষ্ণা আর অসীম ভালোবাসা। সদ্য ছেড়ে আসা মফস্বলের স্মৃতিখন্ড আর সদ্য শুরু করা মিথ্যাময় বিভীষিকার মতো নেশা।
সে কলোনীর ভেতর গিয়ে দাঁড়ায়। খেলার মাঠে ঘাসগুলি রৌদ্রদগ্ধ, দালানগুলিতে নীরবতা, পুরো কলোনীতে বিষের মতো নীরবতা। শুধু কিছু কিশোর ছেলে ছায়ায় দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলছে। এক ফেরিঅলা মহিলা মাথায় মোটাসোটা কালো ব্যাগ নিয়ে ডাকছে- ‘ওই ছো-ও-ওটো কাপুড়!’ কলোনীর এক কোণায় সুউচ্চ পানির ট্যাংকিটাতে আসে, ওর স্যালাইন’এর লিখিত বিজ্ঞাপন ছিল এখন সেখানে ঘাঢ় গোলাপি রঙ, ‘ফেমিকন’ ‘জন্মনিয়ন্ত্রণকারী পিল’- লেখা।
ইটবিছানো সরু রাস্তাগুলি ধরে সে হাঁটতে থাকে, আর কিছুক্ষণের ভেতরেই পৌঁছে যায় একেবারে শেশপ্রান্তের দালানটার সামনে। আট বছর আগের মতোই শ্যাওলাসবুজ, স্যাঁতস্যাঁতে, গাঢ় ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারসমূহের পয়-পরিচ্ছন্ন জানালার পর্দাগুলি নিথর।সে তার ধীর দৃষ্টি বুলাতে থাকে পুরো দালানটার শরীরে। ছোটো-ছোটো আড়াই বর্গফিটের ঝুলন্ত বারান্দা কোথায় একটা পাম্প মেশিনের গোপন গুঞ্জন তাকে অতীতের দিনরাত্রিগুলো স্মরণে সাহায্য করে।
…যখন সে সারাদিনে এক প্যাকেট বিসকিট খেয়ে থাকতো… যখন সাড়ে বারোটায় চতুর্থতলার সিঁড়িতে কিনে-আনা একমাত্র ডিমটা পড়ে ভেঙে যায়… যখন কলোনী মসজিদের সামনে এক রিকশাঅলা গোল হয়ে ঘিরে থাকা জনতা ও পুলিশের মাঝখানে তড়পাতে তড়পাতে মারা যায়… গভীর-গহীন রাত্রে নির্জন ছাদে যখন সে বসে থাকতো আর নেশার ঘোরে কেঁপে উঠতো, কেঁদে ফেলতো… দূরে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের আলো আর স্টিল-ওয়েল্ডিং করার শব্দ ভেসে আসতো… যখন প্রতিটা দিনই সে ভাবতো যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস সে অচিরেই শুরু করতে যাচ্ছে… যখন একদিন, এরকমই এক দুপুরে সিঁড়িঘরে, ছায়াচ্ছন্ন নীরবতায় একটা চায়ামূর্তিকে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো…
অতীত তাকে আরও একবার বিগুত মূহূর্তগুলি পাঠ করে শোনায়, গরম ধাতুর মতো এই দুপুর তার উপরে ভর করে। অতিপরিচিত ধাপগুলিতে পা রেখে-রেখে, সিঁড়ি বেয়ে সে পাঁচতলায় উঠে আসে। ডানদিকের এই দরজা দিয়ে সে রোজ রাতে ঘরে ঢুকতো, ক্লান্ত। ‘একইরকম আছে, কিছুই বদলায়নি্’
সে ফের নেমে যেতে চায়। কিন্তু কি এক দুর্লঙ্ঘ টান সে অনুভব করে বামদিকের অপর দরজাটার প্রতি। মুহূর্তের টান। মুহূর্তে স্মরণ। এই বাসায় কে থাকতো?
সে কড়া নাড়ে আর দু’এক মুহূর্ত পর দরজা খুলে যায়।
সে একজনের নাম উল্লেখ করে(সেই সিঁড়িঘরে কান্নার ছায়ামূর্তি)
বলে, -ও কি বাসায় আছে?
জবাব আসে না। ওই নামে এখানে কেউ থাকে না। সিঁড়ি বেয়ে সে অতঃপর নিচে নামতে থাকে। এখন তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
সবকিছুই হয়তো বদলে গেছে।
আবার কিছুই বদলায়নি।
আরও পড়ুন- আহমেদ রনির গল্প- টোপ