কথাসাহিত্যপ্রচ্ছদ

টোপ- আহমেদ রনির গল্প

টানা তিন ঘন্টা ধরে বসে আছি। টোপকাঠিটা যেমন ছিল তেমনই আছে। মাছ ধরা প্রতিযোগিতায় বড়শিতে মাছ ঠোকর দিচ্ছে না। এটা আমার দ্বিতীয় বারের মতো অভিজ্ঞতা। বিকাল তিনটা অথচ সূর্যের উত্তাপ এখনও প্রখর। মাথার উপর গাছের ঘন আচ্ছাদন থাকায় গরম কম লাগছে। পেটে ক্ষিদে লেগেছে বেশ। মঙ্গলকে নিয়ে এই এক ঝামেলা, সময় অসময় নেই, তারি খেয়ে টাল হয়ে থাকে। আমার নিকটতম প্রতিযোগীল অবস্থা বিগত দিনগুলোর মতোই। পাঁচ ছয় বছর ধরে দেশের যত জায়গায় মাছ ধরা প্রতিযোগিতায় গিয়েছিল ঠিক তত জায়গায় তিনিও গিয়েছেন। এত বছরে তাকে একটি ছোট মাছ পর্যন্ত ধরতে দেখিনি। সমস্ত প্রতিযোগী যখন টোপ ফেলে টোপকাঠির দিকে মনযোগী তখন উনি আসবেন। দ্রুত বড়শী ফেলবেন। উনার কাজ শেষ। উনি খাতা কলমে মগ্ন। আশেপাশে কি ঘটছে? কে কত মাছ ধরল? কে বড় মাছটা ধরে প্রথম পুরস্কার পেল? এসব বিষয়ে তাকে কোনদিন উৎসাহিত হতে দেখিনি। এতগুলো বছর ধরে আমি শুধু তার একপাশ দেখে আসছি। টোপের প্রতি মাছের উদাসীনতা, খিদে; একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য পাশের ভদ্র লোকের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করি।

ভাইয়া শুনছেন। হ্যালো ভাইয়া। এই যে লেখক ভাইয়া, শুনছেন। তিনবার ডাকার পর উনি আমার দিকে সরাসরি তাকালেন। এত বছরে এই প্রথম তার সমস্ত মুখমণ্ডল দেখলাম। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আমার সাথে প্রায় ১৪/১৫ বছরের ব্যবধান।

আস্তে বললেন, কি ভাইয়া?

বলতে পারেন আজ মাছ ধরছে না কেন? আপনি বিলাসী গল্প পড়েছেন?

পড়েছি। কিন্তু গল্পের সাথে মাছের সম্পর্ক কী?

উনি উত্তর না দিয়েই বলা শুরু করলেন, আমার এক চাচা মাছ ধরায় ভীষণ ওস্তাদ। ‍উনার মাছ ধরতে বড়শী লাগে না, ডুব দিয়েই খালি হাতে মাছ ধরতে পারেন। উনি বলেছিলেন, যেদিন মাছ ধরা প্রতিযোগিতা হবে তার আগের দিন আয়োজকরা মাছের খাবারের সাথে রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে দেয়। সে খাবার খেয়ে মাছের মুখে ক্ষত সৃষ্টি হয়। পরের দিন যতই মজাদার খাবার হোক মাছ ভয়ে সে খাবার মুখে তোলে না। ছ্যাঁকা খাওয়া সাপ তাবিজ দেখে যেমন পালায়, হা হা হা।

সব শোনে আমি নীরব। ভাবছি লোকটা উপমা ব্যবহার করে আলাপ অযথাই দীর্ঘ করল। তবে উনার সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। আয়োজকরা কেন আমাদের সাথে ঠকবাজি করবে?

ছিপ হাতে ব্যর্থ, খিদে, একাকিত্ব সব মিলিয়ে হয়ত-বা খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। আয়োজকদের একজনের সাথে তর্কের এক পর্যায়ে ঐ ভদ্রলোক আয়োজক এবং আমাকে শান্ত করল। আমার সহযোগী মঙ্গল কোথা থেকে এসে হাজির হল। টলতে টলতে আমার পাশে হাঁটছে। হঠাৎ বলল, ছাব ওসব ছালা চোর আছে। আর কোনোদিন এমন জায়গায় মাছ ধরতে আছব না। নিজে একটা পুকুর কিনে লন। মঙ্গলের মুখে তাড়ির গন্ধ।

সেদিন মঙ্গলের কথায় কান দেইনি। সেই ভদ্রলোকের মধ্যস্থতায় একটা পুকুর কিনেছিলাম। আজ নিজের পুকুরে প্রথম মাছ ধরতে এসেছি। সারা শরীর উত্তেজিত। আমার স্ত্রীও মাছ ধরা দেখতে এসেছে। ভদ্রলোককে আগেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আজ দেখছি উনি আমার আগেই বড়শী পেতে বসে আছেন। সব কছিু এত দ্রুত ঘটল যে উনার নাম জানা হয়নি। অতিথি আর আমি প্রায় পাশাপাশি। দু’জনই টোপকাঠির দিকে নিমগ্ন। পেছন থেকে আমার স্ত্রী দু’কাপ চা এনে আমাদের মাঝে রাখল। সকালের শান্ত বাতাস, পুকুর; সবকিছুই ভাল লাগছে। হঠাৎ আমার স্ত্রী প্রশ্ন করল, ভাইয়া আপনি নাকি পাঁচ ছয় বছরে একটি মাছও ধরতে পারেননি? অতিথির শান্ত মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। গম্ভীর মুখেই বললেন, মুন্নি একটা ঘটনা বলি, হাদীস সংগ্রাহক ইমাম বোখারী খবর পেলেন দূরদেশে একজনের নিকট হাদীস আছে। ছয় মাস হেঁটে যখন তার নিকট পৌঁছেন লোকটি তখন বড়শীতে মাছ ধরছিল। ইমাম বোখারী ঐ লোকের হাদিস গ্রহণ করলেন না। কেন জান? যে লোক অবোধ মাছকে ধোঁকা দেয়, সে সৎ হতে পারে না। লোভনীয় খাবারের আড়ালে ঢেকে রাখা হয় সুতীক্ষ্ণ বড়শী। অবোধ মাছ তাতে বিদ্ধ হয়। হায় মাছ!

পুকুর পাড়ে সকল কথক, শ্রোতা, পরিবেশ সবকিছু শান্ত। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে ছিপ গোছাতে লাগলেন। আমরা অতিথির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছি। ছিপ গোছানো শেষে উনি ছিপটা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। ‘দেখ মু্ন্নি আমার বড়শীতে টোপ নেই। তাই এত বছরে একটি মাছও ধরতে পারিনি। আটত্রিশ বছর আগেও আমার বুকের ভেতর কোন টোপ ছিল না।’

ছিপ রেখে লোকটা দ্রুদ চলে যাচ্ছে দেখে মুন্নি যেকে বলল, ‘চা খাবেন না ভাইয়া?’

আমার মাছ চা খায় না। আমিও চা খাই না। দূর থেকেই উত্তর দিলেন।

ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো উত্তরটা লাফাচ্ছে। আমি ভাবলাম অতিথি আমার স্ত্রীর নাম জানল কীভাবে?

জানো, আমরা চা বাগানে বড় হয়েছি। অথচ ছোট আপু কখনোও চা খায় না। লোকটাও দেখছি ছোট আপুর মতো চা খায় না। মুন্নির বিস্ময়ভরা উক্তি।

 

আরো পড়ুন- পলাশ মজুমদারের গল্প